ঢাকা : পিয়াজ, আলু ও নিত্যপণ্যের পর এবার অস্থির ভোজ্য তেলের বাজার। এক মাস ধরেই দেশের বাজারে ভোজ্য তেলের দাম একটু একটু করে বাড়ছে । রাজধানীর কাওরান বাজারে প্রতি কেজি খোলা পাম তেল ৯০ টাকা আর সয়াবিন তেল ১০০ টাকায় বিক্রি হতে দেখা গেছে। আর বোতলজাত তেল বিক্রি হচ্ছে ১০৫ টাকা লিটার দরে।ব্যবসায়ীদের দাবি, আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বাড়ায় এই সময়ে দেশেও সয়াবিন ও পাম তেলের দাম লিটারে ১০ থেকে ১৫ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে।
কাওরান বাজারে আলী স্টোরের বিক্রয়কর্মী জসিম জানান, গত সোমবারও প্রতি ব্যারেল সয়াবিন তেলের দাম ৬০০ টাকা বেড়েছে। এখন প্রতি ব্যারেল ১৮ হাজার টাকায় কিনতে হয়েছে। একটি সয়াবিন তেলের ব্যারেল বা ড্রামে ২০৪ লিটার তেল থাকে। সেই হিসাবে প্রতি লিটারের কেনা মূল্য প্রায় ৮৯ টাকা।
পুরান ঢাকার মৌলভীবাজারে পাইকারি ভোজ্য তেল বিক্রেতা ও পাইকারি ভোজ্য তেল ব্যবসায়ী সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক আবুল হাশেম জানান, সয়াবিন তেলের পাইকারি দাম এখনো মণ ৩৫৫০ টাকার মধ্যে আছে। কিন্তু মিল গেইটে প্রতি মণের দাম চাওয়া হচ্ছে ৩ হাজার ৭০০ টাকা। তেলের সরবরাহ আদেশ পেতেও ২/৩ দিন দেরি হচ্ছে। হাশেম জানান, এখন পাইকারিতে প্রতি কেজি সয়াবিন তেলের দাম রয়েছে ৮৮ টাকা ৭৫ পয়সা। আর মিল মালিকরা নতুন দাম চাচ্ছেন ৯২ টাকা ৫০ পয়সা। এর সঙ্গে যোগ হবে পরিবহন ব্যয় ও লভ্যাংশ। সম্পূর্ণ আমদানিনির্ভর এই পণ্যের আন্তর্জাতিক বাজার স্থিতিশীল হলেই কেবল দেশের বাজার আগের অবস্থায় ফিরে আসবে বলে মনে করেন তিনি।
অবশ্য দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির এই সময়ে আপতত দাম আর না বাড়ানোর বিষয়ে সরকারকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে তেল পরিশোধন ও বিপণন কোম্পানিগুলো। মিল গেইটে খোলা সয়াবিন তেল প্রতি লিটার ৯০ টাকা আর পাম তেল ৮০ টাকা করে বিক্রির কথা জানিয়েছে তারা।
প্রধান রপ্তানিকারক দেশগুলোতে সয়াবিনের মজুত কমে যাওয়ার কারণেই মওসুমের শেষ দিকে এসে পণ্যটির দাম বেড়ে যাচ্ছে বলে বাজার সংশ্লিষ্টদের ধারণা। আর ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়া কেন্দ্রিক পাম তেলের দাম বাড়ছে সয়াবিন তেলের দাম বাড়ার কারণে।
বাংলাদেশ ভেজিটেবল অয়েল রিফাইনার্স অ্যান্ড বনস্পতি ম্যানুফ্যাকচারার্স এসোসিয়েশনের সভাপতি মোস্তাফা হায়দার বলেন, আন্তর্জাতিক বাজার ঊর্ধ্বমুখী হওয়ার কারণে দেশের বাজারে এর প্রভাব পড়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে দ্বন্দ্বের কারণে চীন যুক্তরাষ্ট্রের বাজার থেকে সরে গিয়ে লাতিন আমেরিকার বাজারগুলো থেকে সয়াবিন তেল কিনছে। এমনকি তারা আন্তর্জাতিক বাজারের ৫০ শতাংশই বুক করে ফেলেছে বলে শোনা যাচ্ছে।
ব্রাজিল ও আর্জেন্টিনায় সয়াবিনের মজুত কমে যাওয়া ও খরায় নতুন আবাদ বিলম্বিত হওয়ার কারণেও দাম বাড়ছে। তিনি বলেন, এসব কারণে বাজার বেশ অস্থিতিশীল। এই পরিস্থিতিতে সরবরাহ স্বাভাবিক রাখতে বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরা যতটা সম্ভব দাম নিয়ন্ত্রণে রাখার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে সরকারকে। ভবিষ্যতে বাজারে দাম আরো বাড়তে পারে। তবে চীন ব্যাপক হারে আমদানি নীতি থেকে সরে এলে দাম আবার আগের অবস্থায়ও ফিরে যেতে পারে।
যুক্তরাষ্ট্রের ডিপার্টমেন্ট অব এগ্রিকালচারের প্রতিবেদন অনুযায়ী বিশ্বে এবারের মৌসুমে সয়াবিনের মজুত পূর্বাভাসের চেয়ে অনেক কম। শুষ্ক আবহাওয়ার কারণে বিশ্বে তেলবীজ সানফ্লাওয়ার ও রাপিসিড উৎপাদনও প্রত্যাশার তুলনায় কম হয়েছে।
আন্তর্জাতিক বাজার বিশ্লেষণে দেখা গেছে, গত বছরের শেষ দিকে সয়াবিন তেলের দাম প্রতি টন ৭৯৯ ডলারে (এফওবি) পৌঁছেছিল। নতুন বছরে তা ধীরে ধীরে কমতে থাকে। চলতি বছরের মার্চের দিকে দাম নেমে আসে ৫৭৮ ডলারে। বছরের বাকি সময় সামান্য ওঠানামার মধ্য দিয়ে চলতে থাকায় বাংলাদেশের বাজার ছিল স্থিতিশীল। তবে আন্তর্জাতিক বাজারে সয়াবিন তেলের দাম এখন আবার প্রতি টন ৭৫৯ ডলারে পৌঁছেছে। আগস্টের শুরুতে ৬৯০, সেপ্টেম্বরের শুরুতে ৭৩০ এবং অক্টোবরের শেষে দাম গিয়ে পৌঁছায় ৭৬০ ডলারে। এ হিসাবে পণ্যটির দাম গত ২ মাসে প্রতি টনে ৩০ ডলার এবং তিন মাসে ৬০ ডলার পর্যন্ত বেড়েছে। বাংলাদেশে ডলারের দাম ৮৫ টাকা ধরলেও এই তিন মাসে পণ্যটির দাম বেড়েছে প্রতি টনে আড়াই থেকে ৫ হাজার টাকা।
বাংলাদেশ ট্যারিফ কমিশনের হিসাবে দেখা যায়, জাহাজিকরণের সময় সয়াবিন তেলের দাম প্রতি টন ৭৬০ ডলারের মধ্যে থাকলে পাইকারি বাজারে কেজি প্রতি দাম ৯০ টাকার বেশি হওয়ার কথা নয়।
টিসিবির তথ্য অনুযায়ী, বছরের অধিকাংশ সময়জুড়ে খুচরা বাজারে খোলা সয়াবিন তেলের দাম ছিল প্রতি লিটার ৮২ থেকে ৮৬ টাকার মধ্যে। পাম অয়েলের দাম ছিল প্রতি লিটার ৬৫ থেকে ৭০ টাকার মধ্যে। সেপ্টেম্বরের শেষ সপ্তাহ থেকে ধীরে ধীরে ভোজ্য তেলের দাম বাড়তে থাকে। অক্টোবরের শেষ পর্যায়ে এসে খুচরায় সয়াবিন তেল ৯৭ থেকে ১০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। পাম অয়েলও বিক্রি হচ্ছে প্রতি লিটার ৮৫ থেকে ৯০ টাকায়। গত বছরের একই সময়ের তুলনায় সয়াবিন তেলের দাম ১৬ শতাংশ এবং পাম তেলের দাম ৩২ শতাংশ বেড়েছে।