বলাই হয়, সাংবাদিকতা ঝুঁকিপূর্ণ পেশা। কেন ঝুঁকিপূর্ণ ? এ প্রশ্নের সহজ উত্তর হচ্ছে, এখানে জীবন-জীবিকার কোনো নিশ্চয়তা নেই। ঝড়, বন্যা, জলোচ্ছ্বাস, মহামরি যা-ই হোক একজন সরকারি কর্মচারী মাস শেষে নির্দিষ্ট পরিমাণের অর্থ পান। চাকরি শেষে অবসরকালেও তারা পেনশন পান। ফলে কর্মক্ষম থাকার সময় থেকে শুরু করে কর্মহীন অবস্থায়ও সরকারি কর্মচারীদের জীবন-জীবিকার নিশ্চয়তা রয়েছে। কিন্তু সাংবাদিকদের নেই। যে যত বড় প্রতিষ্ঠানেই কাজ করুন না কেন, তিনি যত মেধাবী হোন না কেন, কখন কী কারণে চাকরি যাবে তার কোন ঠিক-ঠিকানা নেই। আবার চাকরি করলেও কবে কখন কোন তারিখে কোন মাসের বেতন পাবেন তারও কোনো নিশ্চয়তা থাকে না।
তবুও সাংবাদিকদের কলম চলে, ক্যামেরা কথা বলে। সমাজের নানা অনিয়ম-অনাচারের চিত্র তুলে ধরার কারণে অনেকের অকালে জীবনও যায়। তারপরও সাংবাদিকরা কাজ করেন, করে যাচ্ছেন নানা সংকটের মধ্যে দিয়ে। যুদ্ধ বিগ্রহ ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময়েও সাংবাদিকরা ঘরে বসে থাকেন না। প্রতিদিন, প্রতি মুহূর্তে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সঠিক তথ্যের সন্ধানে বেরিয়ে যান। খবর সংগ্রহ করে দেশ ও জাতিকে জানান।
তাই সাংবাদিকরা ব্যক্তি মালিকাধীন প্রতিষ্ঠানে চাকরি করলেও তাদের কাজ মূলত রাষ্ট্রের জন্য। সে কারণেই সাংবাদিকতাকে রাষ্ট্রের ‘চতুর্থ স্তম্ভ’ বলা হয়ে থাকে।
এখানেও প্রশ্ন থাকে, সাংবাদিকরা যদি রাষ্ট্রের জন্যই কাজ করে তবে রাষ্ট্র কেন তাদের জীবন-জীবিকার নিশ্চয়তা দেয় না। দেয় না এ কারণে, রাষ্ট্রের বেতনভুক্ত লোকজন রাষ্ট্রের কর্মচারী। রাষ্ট্র পরিচালনাকারি সরকারের ইচ্ছানুযায়ী তাদের কাজ করতে হয়। সরকার রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে কখনো কখনো স্বৈরাচারী, স্বেচ্ছাচারী হয়ে যেতে পারে। বৃহত্তর জনগোষ্ঠীকে মৌলিক মানবিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করতে পারে। রাষ্ট্রের কর্মচারীরা তা দেখলেও সরকারের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে কথা বলতে পারেন না। এক্ষেত্রে একমাত্র বিকল্প হচ্ছে গণমাধ্যম। গণমাধ্যমে কর্মরত সাংবাদিকরা সাহসিকতার সাথে সকল অনিয়ম, অনাচার আর অবিচারের কথা জাতির সামনে তুলে ধরতে পারেন। সাংবাদিকরা যদি সরকারের বেতনভূক্ত কর্মচারী হন তবে এ কাজটি তারা করতে পারবেন না। এ কারণেই রাষ্ট্র সাংবাদিকদের বিবেকের স্বাধীনতায় বিশ্বাস করে।
করোনা সাংবাদিকদের নতুন কিছু বাস্তবতার মুখোমুখি করেছে। এই মহামারি থেকে জীবন রক্ষার জন্য বলা হয়েছে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে। এর মধ্যে রয়েছে, করেনটাইন, আইসোলেশন, লকডাউন, সোস্যাল ডিসটেন্স মেনটেইন, মাস্ক ব্যবহার, সাবান দিয়ে হাত ধোয়া, গরম পানি পান করাসহ আরো কিছু নিয়ম-কানুন। কারণ, এখানো পর্যন্ত এই মহামারির কোনো ওষুধ আবিষ্কার হয়নি। সুতরাং ‘জীবন রক্ষার’ জন্য এসব নিয়ম মেনে চলা ছাড়া কোনো বিকল্প নেই।
অপরদিকে এই নিয়মগুলো যথাযথভাবে মেনে চললে সাংবাদিকতা কঠিন হয়ে যায়। কারণ, একজন সাংবাদিক যদি করেনটাইনে থাকে তবে তার পক্ষে তথ্য সংগ্রহ করা সম্ভব নয়। একজন সাংবাদিকের আইসোলেশনে থাকার মানে জেলে থাকার সামিল। লকডাউনের সামনে পড়লে সাংবাদিক কোনো অবস্থাতেই ঘটনাস্থলে যেতে পারেন না। ঘটনাস্থলে না গিয়ে কোনো রিপোর্ট করলে সেটা হয় হোম মেইড। যা কারো কাম্য নয়। সোশ্যাাল ডিসটেন্স প্রকৃত সত্য জানার ক্ষেত্রে বড় বাধা। কারণ, মানুষের সঙ্গে কথা বলতে না পারলে কী জানবে, কীভাবে জানবে। সবাই মাস্ক পড়ে থাকলে ভিকটিমকে চিনবে কীভাবে। অনেক রিপোর্টের ক্ষেত্রে ভিকটিম বা সোর্সকে চিনতে হয়। না চিনলে প্রাপ্ত তথ্যের নির্ভরযোগ্যতায় আস্থা থাকে না। শুধু মাত্র সাবান দিয়ে হাত ধোয়ায় সাংবাদিকের কাজে তেমন কোনো অসুবিধার হওয়ার কথা নয়।
সারাংশে বলা যায়, করোনা মহামারির সময়ে একজন সাংবাদিক যদি নিজের জীবন বাচাঁনোর বিষয়কে প্রাধান্য দেন তবে তার দায়িত্ব পালন কঠিন হয়ে পড়ে। আবার যদি দায়িত্ব পালনকে মুখ্য বিবেচনা করা হয় তবে একজন সাংবাদিকের জীবন হয় মারাত্মক ঝঁকিপূর্ণ। মহামারির সময়ে অন্যকোনো পেশাজীবীর ক্ষেত্রে এ অবস্থা দেখা যায়নি।
ডাক্তার-নার্স,আইন-শৃঙ্খলাবাহিনীর সদস্য, প্রশাসনের লোক কারো ক্ষেত্রে এ ধরণের ঝুঁকি নেই। কারণ, তারা সবাই সরকারি কর্মচারী। তাদের জীবন-জীবিকার গ্যারান্টার রাষ্ট্র। তাদের স্বাস্থ্য সুরক্ষার ব্যবস্থা করে রাষ্ট্র। কিন্তু সাংবাদিকরা থাকে অরক্ষিত। করোনাকালে কোনো গণমাধ্যমের মালিক পক্ষ তার প্রতিষ্ঠানে কর্মরত সাংবাদিক-শ্রমিক-কর্মচারীদের স্বাস্থ্য সুরক্ষার ব্যবস্থা করেনি। দেয়নি জীবিকার নিশ্চয়তা। বরং বাস্তবে হয়েছে উল্টো। সবাই জানে, করোনাকালে বিপুল সংখ্যক সংবাদকর্মী চাকরিচ্যুত হয়েছেন। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে দায়িত্ব পালন করেও বহু সংবাদকর্মী বেতন-ভাতা পাননি। লক ডাউনের মধ্যে নিজ ব্যবস্থাপনায় অফিস আসতে যেতে হয়েছে। পাশাপাশি আর্থিক সংকটের অজুহাতে বহু সংবাদপত্র প্রকাশনা বন্ধ করে দেয়ায় প্রতিষ্ঠানের কর্মীরা পথে বসতে বাধ্য হয়েছেন।
এবার এই করোনা মহামারির সময়ে সংবাদকর্মীদের পরিবার পরিজন নিয়ে জীবন-জীবিকা নির্বাহ করার ক্ষেত্রে নতুন অভিজ্ঞতা হয়েছে। কম-বেশি সকল পর্যায়ের সংবাদকর্মীরা উপলব্ধি করেছেন, এ পেশার মানুষ কতটা অসহায়, নিরাপত্তাহীন।
বিশ্বের গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ও সমাজব্যবস্থায় সাংবাদিকদের কর্মের স্বাধীনতাসহ জীবন-জীবিকার বিষয়কে গুরুত্ব দেয়া হয়। আবার এর উল্টোটাও আছে। বাংলাদেশ রাষ্ট্রেও সংবাদপত্রের তথা সাংবাদিকদের স্বাধীনতা ও জীবন-জীবিকার সুরক্ষায় কতগুলো আইন ও বিধি-বিধান রয়েছে। তথ্য মন্ত্রণাালয়ের কাজই হচ্ছে এগুলো দেখভাল করা। সরকারের যেমন সব কিছু দেখভাল করার দায়িত্ব তেমনি সাংবাদিক ইউনিয়নের কাজ কর্মরত প্রতিষ্ঠানের মালিক পক্ষের কাছ থেকে ন্যায্য পাওনা আদায়ে সোচ্চার থাকা। মালিক পক্ষ ইউনিয়নের দাবি না মানতে চাইলে প্রয়োজনে সরকারের ওপর প্রেসার সৃষ্টি করা যাতে সরকার বাধ্য হয় রাষ্ট্রের প্রচলিত আইন মোতাবেক সংবাদকর্মীদের ন্যায্য পাওনা পরিশোধে মালিকদের বাধ্য করতে।
সংবাদকর্মীদের রুটি-রুজির নিশ্চয়তা প্রদান ও মর্যাদা রক্ষার ক্ষেত্রে আইনি প্রতিনিধি হচ্ছে সাংবাদিক ইউনিয়ন। ইউনিয়ন ক্লাব নয়। ক্লাবে মানুষ যায় টাকা খরচ করে আনন্দ-বিনোদন করতে। ইউনিয়ন সদস্যদের অধিকার সংরক্ষণে দায়বদ্ধ। সাংবাদিক ইউনিয়ন এই আইনি অধিকার পেয়েছিল ১৯৭৪ সালে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সাংবাদিকদের জীবন-জীবিকার খবরাখবর রাখতেন। তিনি জানতেন সাংবাদিকতা পেশার ঝুঁকির বিষয়গুলো। তাই তিনি ১৯৭৪ সালে `The Newspaper Employees (Serviccs & Condition) Act 74' প্রণয়ন করে সাংবাদিকদের অধিকার ও মর্যাদাকে রাষ্ট্রীয় আইনদ্বারা সুরক্ষিত করেন। ওই আইনের আলোকেই গঠন করা হয় ওয়েজবোর্ড। ঘোষণা করা হয় রোয়েদাদ। শুধু তাই নয়, জাতির পিতা সাংবাদিকদের প্রশিক্ষণ, মানোন্নয়ন ও গবেষণার জন্য প্রতিষ্ঠা করেন ‘প্রেস ইন্সটিটিউট বাংলাদেশ’। পাশাপাশি প্রচলিত আইন ও বিধি-বিধানসহ সাংবাদিকতার নীতিমালার আওতায় দায়িত্বশীল সাংবাদিকতার জন্য প্রতিষ্ঠা করেন,‘বাংলাদেশ প্রেস কাউন্সিল’।
সাংবাদিক ইউনিয়নের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে সরকার প্রতি পাঁচ বছর পরপর সংবাদপত্র শিল্পের সাংবাদিক-শ্রমিক-কর্মচারীদের জন্য ওয়েজবোর্ড গঠন করে। ওয়েজবোর্ড শুধুমাত্র একটি বেতন কাঠামো নয়। এটি রাষ্ট্রের আইন। এ আইনে সংবাদকর্মীদের বেতন-ভাতার অধিকারসহ মর্যাদা নিশ্চিত করা হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশের সংবাদপত্র প্রতিষ্ঠানগুলো বর্তমানে এই ওয়েজবোর্ড মানছে না। তারা অন্যান্য শিল্প ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মতো তাদের মর্জি মাফিক গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠান চালাতে আগ্রহী। ফলে সাংবাদিকতা পেশায় ক্রমান্বয়ে নানা রকমের অনাচার, অবিচার ও দুর্বৃত্তায়নের সৃষ্টি হচ্ছে। বিশেষ করে জাতির পিতাকে হত্যার পর সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় সাংবাদিকতাকে পণ্য হিসেবে বেচা-কেনার বাজারে পরিণত করার উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়।
এ কাজে সামরিক শাসকরা সাংবাদিকতার মানদণ্ড ভেঙে চুরমার করে দিয়ে সংবাদপত্র জগতে দালাল শ্রেণীর জন্ম দেয়। ফলে সাধারণ মানুষের কাছে সাংবাদিকদের মর্যাদা ও গ্রহণযোগ্যতা কমতে শুরু করে। তারই ধারাবাহিকতায় সাংবাদিকদের মধ্যে দলাদলি, লবিং গ্রুপিং শুরু হয়। সরকারি সুযোগ-সুবিধার লোভ-লালসা সাংবাদিকদের দলদাস ও এই পেশাকে লেজুড়বৃত্তিতে পরিণত করে। পাশাপাশি পাল্লা দিয়ে সংবাদপত্র শিল্পে শুরু হয় বেসুমার লুটপাট। শত ফুল ফুটতে দেওয়ায় যুক্তিতে দুর্নীতিবাজ, লুটেরাদের হাতে তুলে দেওয়া হয় সংবাদপত্রের মালিকানা। লেখাপড়া নেই, নেই ভাষা জ্ঞান, নিজের নাম লিখতে অক্ষম, ভালো করে কথা পর্যন্ত বলতে পারে না, এমন সব লোক রাতারাতি হয়ে যায় গণমাধ্যমের মালিক, সম্পাদক-প্রকাশক।
দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সাংবাদিকতা বিষয়ে অনার্সসহ উচ্চতর শিক্ষার ব্যবস্থা রয়েছে। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সাংবাদিকতার উচ্চতর ডিগ্রি নিয়েও অনেকে গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানে চাকরি পান না। ফলে পেশা হিসেবে সাংবাদিকতা পূর্ণাঙ্গ হতে পারেনি।
বর্তমানে বাংলাদেশে সাংবাদিকতার ‘সংজ্ঞা’ নির্ধারণ করা রীতিমত গবেষণার বিষয়। অপরদিকে সংবাদপত্রকে বানানো হয়েছে ‘গণমাধ্যম শিল্প’। আমার বিবেচনায় শব্দগত দিক থেকে সংবাদপত্র, সাংবাদিকতা আর গণমাধ্যম বা গণমাধ্যমকর্মীর মধ্যে পার্থক্য আছে। ‘সাংবাদিককতা’ শব্দে পেশাগত মর্যাদার একটা বিষয় আছে। কিন্তু ‘গণমাধ্যমকর্মী’ শব্দে তা নেই। এতে কেমন যেন কর্মচারী কর্মচারী ভাব রয়েছে। বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষ সাংবাদিকদের ‘সাংবাদিক’ হিসেবেই জানেন এবং সম্মান দেন। তা সত্ত্বেও নানা অজুহাত ও যুক্তি দেখিয়ে খুব ঠান্ডা মাথায় সাংবাদিকদের মান-মর্যাদা ধূলোয় মিশিয়ে দেওয়ার জন্য পরিকল্পিতভাবে এ কাজগুলো করা হয়েছে এবং এখনো হচ্ছে।
বর্তমানে সংবাদপত্র বা গণমাধ্যম শিল্পে বহু পক্ষের আবির্ভাব ঘটেছে। মালিক, সম্পাদক, প্রকাশকদের অনেক দল, অনেক গ্রুপ। এসব দল আর গ্রুপের সৃষ্টি হয়েছে স্বার্থের জন্য। কারণ, সংবাদপত্র শিল্প বর্তমানে একটি লাভজনক ব্যবসায়ী খাত। তাই সারাদেশে হাজার হাজার পত্রিকা, রেডিও, টেলিভিশন। তার সাথে এখন যোগ হচ্ছে, অনলাইন নিউজ পোর্টাল আর আইপি টিভি। কিন্তু কেউই সাংবাদিক-শ্রমিক-কর্মচারীদের ঠিকমত বেতন দেয় না। ওয়েজবোর্ড মানে না। ক্ষেত্র বিশেষ সাংবাদিকদের কাছ থেকে নানা রকমের সুবিধা আদায় করে নেয়। সাংবাদিকদের পরিচয়পত্র এখন নগদ টাকায় বেচা-বিক্রি হয়!
২০০৬ সালে বিএনপি-জামাত জোট সরকার সাংবাদিকদের অধিকার ও মর্যাদার রক্ষা কবচ `The Newspaper Employees ( Serviccs & Condition) Act 74’ আইনটি বাতিল করে শ্রম আইনের আওতায় ফেলে সাংবাদিকদের কল-কারখানার শ্রমিকদের কাতারে নামিয়ে দেয়। এতে সাংবাদিকদের মেধা ভিত্তিক শ্রমের মর্যাদা ও মূল্য বিনষ্ট হয়ে যায়। এর বিরুদ্ধে সাংবাদিক ইউনিয়নের লাগাতার আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে আওয়ামী লীগ সরকার প্রধান বঙ্গবন্ধু কন্যা প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা সাংবাদিকদের মর্যাদা পুনঃপ্রতিষ্ঠার মাধ্যমে তাদের জীবিকার নিশ্চয়তার জন্য ৭৪ সালের আইনটিকে সময়োপযোগী করে নতুন একটি আইন প্রণয়ন করা নির্দেশ প্রদান করেন।
কিন্তু সাংবাদিকদের সবকিছুকে একত্রিত করে ‘ওর স্যালাইনের মতো’ এক চিমটি নূন, এক মুঠো গুড়, আধা লিটার পানি মিশিয়ে ‘দে ঘুটা’ পদ্বতিতে সাংবাদিকদের ‘কর্মী’ হিসেবে রূপান্তরিত করে নতুন আইন করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় যার নাম ‘গণমাধ্যমকর্মী আইন’। এর পিছনে গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানগুলোর করপোরেট পুঁজির ভূমিকা রয়েছে। কিন্তু তারা নিজেরা এসব করেনি। করিয়েছে সরকারের আমলা এবং ‘বিশেষভাবে খ্যাতিমান’ সাংবাদিক নেতা ও ব্যক্তিদের মাধ্যমে। প্রধানমন্ত্রীর যত সদিচ্ছাই থাকুক না কেন ‘লাইন টু লাইন’ পাঠ করে, দেখে শুনে কোনো আইন প্রণয়ন করা সম্ভব নয়। ফলে তিনি যা করতে বলেছিলেন, তার বদলে হতে যাচ্ছে ভিন্ন মাত্রায় অন্যকিছু।
এসব বিষয়ে সাম্প্রতিক সময়ে ইউনিয়নের পক্ষ থেকে তথ্য মন্ত্রণালয়ে বৈঠকের পর বৈঠক করে প্রস্তাবিত ‘গণমাধ্যকর্মী আইন’কে সাংবাদিক-শ্রমিক-কর্মচারীদের স্বার্থের অনকূলে রাখার জন্য সব রকমের পদক্ষেপ নেওয়া হলেও গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানের মালিক পক্ষের শক্তিশালী সংগঠন ‘নোয়াব’ ইউনিয়নের প্রস্তাবনার বিপক্ষে গুরুতর আপত্তি উত্থাপন করে ‘গণমাধ্যমকর্মী আইন’ সংসদে পাশ করানোসহ নবম ওয়েজবোর্ড ঘোষণার বিরুদ্ধে মামলা করে।
এদিকে নোয়াবের বিরোধিতা সত্ত্বেও ইউনিয়নের যৌক্তিক দাবির কথা বিবেচনায় নিয়ে প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা সাংবাদিক-শ্রমিক-কর্মচারীচারীদের জন্য নবম ওয়েজবোর্ডের গেজেট প্রকাশের নির্দেশ দিলে নোয়াব ওই গেজেট প্রকাশের বৈধতা নিয়েও হাইকোর্টে রিট করে। তথ্যমন্ত্রণালয় ওই রিটের বিরুদ্ধে আইনি লড়াই শুরু করে। চূড়ান্ত পর্যায়ে শুনানিতে সুপ্রিমকোর্ট বলেছে, ‘সাংবাদিক ছাড়া সংবাদপত্রের মালিকরা অস্তিত্বহীন’। তার মানে হচ্ছে, রাষ্ট্রের আইন মনে করে, সংবাদপত্রের অন্তপ্রাণ হচ্ছেন সাংবাদিক। আর এজন্যই রাষ্ট্র ওয়েজবোর্ড আইন দ্বারা সংবাদকর্মীদের অধিকার ও মর্য়াদা সুনিশ্চিত করেছে। দীর্ঘদিনের সেই অধিকার ও মর্যাদা চিরতরে বিনষ্ট করে সংবাদকর্মীদের আবারো দিনমজুর বানানোর চক্রান্ত শুরু হয়েছে। নোয়াবের ওই মামলা এখনো বিচারাধীন।
এদিকে করোনা মহামারির এই সময়ে দেশে ডাক্তার নার্স, স্বাস্থ্যকর্মী, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী ও সেনা সদস্যদের পাশাপশি সাংবাদিকরা সম্মুখ যোদ্ধা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন এবং এখনো করে যাচ্ছেন। এ কাজে সম্পৃক্ত সকলের সুরক্ষা থাকলেও সাংবাদিকদের নেই। করোনা মহামারির ভয়াবহ এই দুঃসময়ের মধ্যেও ছাঁটাই, বেতন না দেওয়া, কমিয়ে দেওয়া ইত্যাদি নানা নিপীড়নের মধ্যেও সাংবাদিকরা দায়িত্ব পালন থেকে বিরত হননি।
বাংলাদেশে মার্চের ৮ তারিখে করোনা ভাইরাস শনাক্ত হয়। এই খবর সকল মহলে জানাজানি হতে আরো ১০/১৫ দিন লাগে। এরই মধ্যে দেশের গণমাধ্যম মালিকদের রাস্তায় বসে যাওয়ার অবস্থা হয়। এ অজুহাতে তারা শুরু করেন ঢালাওভাবে ছাঁটাই। একের পর এক পত্রিকার প্রকাশনা বন্ধ করে দেওয়া হয়। এ সময় ইউনিয়নের পক্ষ থেকে মালিকদের বার বার অনুরোধ করা হয় তারা যেন ঢালাওভাবে ছাঁটাই বন্ধ করেন। এ দাবিতে ইউনিয়ন নিয়মিত মিটিং মানববন্ধন করতে শুরু করে। ততদিনে শতশত সাংবাদিক-শ্রমিক-কর্মচারীকে চাকরিচ্যূত করে পথে বসতে বাধ্য করা হয়।
এই ছাঁটাই প্রক্রিয়া এখনো চলছে। সাংবাদিকদের এই দুঃসময়ে ইউনিয়নের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা সাংবাদিকদের পাশে দাঁড়ান। তিনি আর্থিক সহায়তার হাত বাড়ালে সাংবাদিকদের মনে সাহসের সঞ্চার হয়। তারই মানবিক সদিচ্ছায় সারাদেশের সাংবাদিকদের মধ্যে বিএফইউজে’র সহযোগিতায় বাংলাদেশ সাংবাদিক কল্যাণ ট্রাস্ট্র করোনার সময়ে মূলধারার সাংবাদিকদের মধ্যে আর্থিক সহায়তার চেক বিতরণ করা হয়। করোনার সময়ে কর্মরত মূলধারার সাংবাদিকরা প্রত্যেকে প্রধানমন্ত্রীর আর্থিক সহায়তার এই প্যাকেজ থেকে ১০ হাজার করে টাকা পাচ্ছেন। বিশ্বব্যাপী করোনা মহামারির এই দুঃসময়ে উপমহাদেশের কোথাও কোনো সরকার সাংবাদিকদের পাশে এভাবে দাঁড়ায়নি। মানবিক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মহানুভবতায় বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের সহযোগিতায় দেশের ৬৪টি জেলায় দল-মত নির্বিশেষে হাজার হাজার সাংবাদিক প্রধানমন্ত্রীর আর্থিক সহায়তা পেয়ে বর্তমানে ‘বাংলাদেশ সাংবাদিক কল্যাণ ট্রাস্ট’কে একটি ভরসার জায়গা হিসেবে দেখছেন।
আগে সাংবাদিক কল্যাণ ট্রাস্টের কার্যক্রম এতটা বিস্তৃতি ছিল না। এবারই প্রথম বিএফইউজে’র সহযোগিতায় সারাদেশের সাংবাদিকরা বাংলাদেশ সাংবাদিক কল্যাণ ট্রাস্ট সম্পর্কে অবহিত হয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সারাদেশের সাংবাদিকদের বিপদে-আপদে সংকটে সহায়তার জন্যই প্রতিষ্ঠা করেছেন বাংলাদেশ সাংবাদিক কল্যাণ ট্রাস্ট। এই ট্রাস্ট থেকে প্রতিবছর সাংবাদিকরা চিকিৎসা সহায়তাসহ বড় ধরণের নানা সংকটে অনুদান পেয়ে থাকেন।
এছাড়াও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সাংবাদিকতা পেশার উৎকর্ষ সাধনের জন্য প্রেস ইন্সটিটিউট বাংলাদেশকে সাংবাদিকতার প্রশিক্ষণ ও উন্নয়নে একটি সত্যিকার গবেষণাধর্মী প্রতিষ্ঠানে পরিণত করেছেন। বিপরীতে কতিপয় গণমাধ্যম মালিক, সম্পাদক, প্রকাশকসহ এক শ্রেণীর সাংবাদিকরা রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ ‘গণমাধ্যমকে’ কেবল নিজেদের বানিজ্যিক স্বার্থ সিদ্ধির জন্য ব্যবহার করছেন। ফলে রাষ্ট্রের ‘চতুর্থ স্তম্ভ’ হিসেবে সাংবাদিকতা উজ্জলতর ভাবমূর্তি নিয়ে দাঁড়ানোর চেয়ে ক্রমশ কালিমা লিপ্ত হয়ে অতীত ঐতিহ্য হারাতে বসেছে।
এ অবস্থা চলতে থাকলে বর্তমান সময়ের মেধাবী কোনো ছেলে-মেয়ে সাংবাদিকতা পেশায় আসবে না। কারণ, তারা দেখছে এ পেশায় জীবন ও জীবিকার কোনো নিশ্চয়তা নেই। বিষয়টি গভীরভাবে ভাবার সময় এসে গেছে। এমতাবস্থায় পেশার মর্যাদা রক্ষার স্বার্থে সাংবাদিক, সম্পাদক, প্রকাশকসহ সংশ্লিষ্ট সকলকে ব্যক্তিগত স্বার্থচিন্তার ঊর্ধ্বে পেশাগত সুরক্ষা ও উন্নয়নের বিষয়কে অধিক গুরুত্ব দিতে হবে। তাতে একদিকে যেমন পেশাদারিত্ব বাড়বে তেমনি সমাজ-রাষ্ট্রে সাংবাদিকতার মর্যাদা বৃদ্ধি পাবে। তা না হলে সবাই ক্ষতিগ্রস্ত হবেন।
ওয়েজ বোর্ড না থাকলে গণমাধ্যমের সম্পাদক থেকে শুরু করে সাধারণ কর্মচারি সকলেই ‘মজুরে’ পরিণত হবেন। দিনমজুর দিনভর কাজ করেন কাস্তে, কোদাল, হাতুরি-শাবল দিয়ে, গণমাধ্যমকর্মীরা কাজ করেন ‘কলম’ আর ক্যামেরা দিয়ে। দিন মজুরের ‘মুজুরি’ আছে, কিন্তু সেই অর্থে মর্যাদা নেই। তেমনি সাংবাদিকরা ‘মুজুরি’ পেলেও মর্যাদা হারাবেন। সাংবাদিকের মর্যাদা না থাকলে এ পেশার অস্তিত্বই থাকে না। শুধু সাংবাদিক ও সম্পাদক নয়, প্রকাশকরাও গুরুত্বহীন হবেন।
বর্তমানে ‘গণমাধ্যম শিল্পে’ মোটা অংকের করপোরেট পুঁজির বিনিয়োগ হচ্ছে। বিনিয়োগকারিরা ব্যবসায়ী। তাদের অনেক ব্যবসা আছে। তারা ব্যবসায়ী হিসেবেই সমাজ-রাষ্ট্রে পরিচিত। ব্যবসার মূল লক্ষ্য ‘মুনাফা’। কোনো কোনো ব্যবসা সেবাধর্মী হলেও ‘মুনাফার’ কারণে ‘সেবার’ বিষয়টি গুরুত্ব পায় না। এক্ষেত্রে গণমাধ্যম ব্যতিক্রম। এখানে ব্যবসা থাকলেও ‘সেবার’ বিষয়টি সর্বক্ষেত্রে প্রাধান্য পায়। সমাজ-রাষ্ট্রসহ বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষ একজন সম্পাদক, প্রকাশক ও সাংবাদিককে মর্যাদার চোখে দেখে। অন্য শিল্পে বিনিয়োগে তিনি বেশি মুনাফা পেলেও ‘গণমাধ্যম শিল্পে’ বিনিয়োগে তার মর্যাদা বাড়ে। সুতরাং গণমাধ্যমকে মুনাফার হাতিয়ার কিংবা ঢাল হিসেবে না দেখে ‘রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ’ হিসেবে বিবেচনা করলে সব পক্ষই লাভবান হবেন।
এখানে লোকসান দিয়ে গণমাধ্যম চালানোর প্রশ্ন নেই। ‘রাষ্ট্র’ গণমাধ্যম শিল্পে বহুমাত্রিক সহায়তা প্রদান করে। বর্তমান প্রযুক্তির যুগে গণমাধ্যমে যত রকমের পরির্বতন ও সংযোজন আসছে তার সব কিছুতেই ‘রাষ্ট্র’ সহায়তার হাত বাড়াচ্ছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে চাহিদার তুলনায় সহায়তা কম হতে পারে। কিন্তু সহায়তা আছে। সময়ে সময়ে তা বৃদ্ধি পায়। বাংলাদেশ সৃষ্টি পর থেকে গণমাধ্যম শিল্পে রাষ্ট্রের সহায়তা কমে যাওয়ার কোনো নজির নেই। কিন্তু গণমাধ্যমকর্মী হিসেবে সাংবাদিক নির্যাতন-নিপীড়নের গল্প দিন দিন বেড়েই চলছে।
নবম ওয়েজ বোর্ডের বিরুদ্ধে নোয়াবের মামলার পরিপ্রেক্ষিতে সুপ্রিম কোর্টের ঐতিহাসিক রায় খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। সুপ্রিম কোর্টের রায়ের অর্ন্তনিহিত নির্দেশনা ঊর্ধ্বে রেখে সম্পাদক, প্রকাশক, সাংবাদিকসহ সংশ্লিষ্ট সকলকে ঐক্যবদ্ধভাবে পেশার সুরক্ষা ও মর্যাদা সমুন্নত রাখায় সচেষ্ট হতে হবে। এখানে কেউ কাউকে ঠকিয়ে বেশিদিন টিকতে পারবে না। এতে পক্ষগুলো পরস্পরের মুখোমুখি হয়ে যে সংগ্রাম, সংঘাত ও সংঘর্ষ করবে তাতে ‘রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভের’ মর্যাদা ভূলুণ্ঠিত হবে। সাংবাদিকরা সমাজ-রাষ্ট্রে ক্রমাগত প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে এক সময় অস্তিত্বহীন হয়ে যাবে। যার আলামত দৃশ্যমান। তাই রাজনৈতিক মতাদর্শগত মতপার্থক্য থাকলেও এই মুহূর্তে প্রয়োজন পেশাগত ঐক্য, ঐক্য এবং ঐক্য। এর কোনো বিকল্প নেই।
মোল্লা জালাল: সিনিয়র সাংবাদিক, সভাপতি, বিএফইউজে।