ঢাকা, রবিবার, ১২ অক্টোবর ২০২৫,
সময়: ০৪:০০:৫৪ AM

তারেক রহমানের সাক্ষাৎকার : পরিছন্ন নেতৃত্বের প্রতিচ্ছবি

জয়নুল আবদিন ফারুক,সাবেক বিরোধী দলীয় চিফ হুইপ
11-10-2025 11:43:20 AM
তারেক রহমানের সাক্ষাৎকার : পরিছন্ন নেতৃত্বের প্রতিচ্ছবি

দীর্ঘ প্রায় ১৭ বছরের স্বেচ্ছা-নির্বাসন শেষে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান সম্প্রতি বিবিসি বাংলাকে দেওয়া দুই পর্বের এক দীর্ঘ সাক্ষাৎকারে যে বক্তব্য রেখেছেন, তা শুধু তাঁর বক্তব্য নয়— এটি হয়ে উঠেছে বাংলাদেশের রাজনীতিতে এক নতুন বার্তা, এক নতুন পথচলার সংকেত।

বিএনপির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ও সাবেক বিরোধী দলীয় চিফ হুইপ জয়নুল আবদিন ফারুক এই সাক্ষাৎকারকে দেখছেন একটি রাষ্ট্রনায়কোচিত আবির্ভাব হিসেবে। তাঁর বিশ্লেষণে উঠে এসেছে, কীভাবে নীরবতার শক্তিকে ব্যবহার করে তারেক রহমান বর্তমান সময়ের রাজনীতিতে ভিন্ন মাত্রা যোগ করেছেন— যেখানে নেই ব্যক্তিগত আক্রমণ, নেই প্রতিহিংসার ভাষা, বরং রয়েছে শালীনতা, পরিণতিবোধ এবং একটি গণতান্ত্রিক ভবিষ্যতের জন্য সুস্পষ্ট রূপরেখা।

সাক্ষাৎকারের ছয়টি গুরুত্বপূর্ণ দিক
১. গণতন্ত্রকে নৈতিক ভিত্তি হিসেবে উপস্থাপন
তারেক রহমান গণতন্ত্রকে শুধুমাত্র একটি রাজনৈতিক কৌশল বা স্লোগান হিসেবে দেখেন না। বরং তিনি একে জাতির নৈতিক ভিত্তি হিসেবে বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেন, প্রকৃত গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য শুধু একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনই যথেষ্ট নয়, এর পাশাপাশি প্রয়োজন রাজনৈতিক সংস্কার, জবাবদিহিতা ও জনগণের ক্ষমতায়ন।

২. স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের স্পষ্ট ঘোষণা
তারেক রহমান বলেছেন, তিনি দ্রুতই দেশে ফিরতে চান এবং জনগণের প্রত্যাশিত নির্বাচনে অংশ নিতে প্রস্তুত। তিনি স্মরণ করিয়ে দেন, ২০০৭ সালের সেনাসমর্থিত সরকারের সময় তাকে শারীরিক নির্যাতন ও মিথ্যা মামলার শিকার হতে হয়েছিল, যার ফলে চিকিৎসার প্রয়োজনে তাঁকে বিদেশে যেতে হয়। এখন তাঁর প্রত্যাবর্তনের ঘোষণা বাংলাদেশের রাজনীতিতে নতুন অধ্যায়ের সূচনা করতে পারে বলে মনে করছেন অনেকেই।

৩. প্রতিপক্ষ নয়, বিচার ব্যবস্থার ওপর আস্থা
তিনি সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে “উদ্দেশ্যপ্রণোদিত” বলে আখ্যা দিলেও, কোনো আক্রমণাত্মক শব্দ ব্যবহার করেননি। বর্তমান ক্ষমতাসীন দলের ক্ষেত্রেও তিনি প্রতিশোধ নয়, বরং আইনি প্রক্রিয়ার ওপর আস্থার কথা বলেন। তারেক রহমান স্পষ্ট করেন, বিএনপি ক্ষমতায় এলেও বিচারিক প্রক্রিয়ার বাইরে কোনো কাজ করবে না।

৪. ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক: ‘সবার আগে বাংলাদেশ’ নীতিতে অটল
প্রতিবেশী ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের বিষয়ে তারেক রহমান পুনর্ব্যক্ত করেন বিএনপির অবস্থান— ‘সবার আগে বাংলাদেশ’। তিনি বলেন, “অবশ্যই আমি আমার পানির হিস্যা চাই। অবশ্যই আমি দেখতে চাই না যে আরেক ফেলানী ঝুলে আছে কাঁটাতারে। এটা আমরা মেনে নেব না।” এর মধ্য দিয়ে তিনি বাংলাদেশি স্বার্থে আপসহীন অবস্থানের বার্তা দিয়েছেন।

৫. রাজনীতিতে পরিবারকরণ নয়, জনসমর্থনের ভিত্তি
বিএনপির নেতৃত্বে পরিবারের প্রভাব নিয়ে প্রশ্নের জবাবে তারেক রহমান বলেন, “রাজনীতি পরিবারকরণ হয় না, এটি সমর্থনের ভিত্তিতে হয়।” তিনি তাঁর নিজের সংগ্রাম, শারীরিক নির্যাতন ও অপপ্রচারের শিকার হওয়ার বাস্তবতা তুলে ধরে বলেন, রাজনৈতিক নেতৃত্ব আসে আত্মত্যাগ ও জনআস্থা থেকে।

৬. তরুণদের জন্য আহ্বান, শিক্ষার ওপর জোর
তারেক রহমান নতুন বাংলাদেশ গড়তে তরুণ প্রজন্মকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান। একইসঙ্গে শিক্ষকদের মর্যাদা ও আর্থিক নিরাপত্তার ওপর গুরুত্বারোপ করেন। তিনি বলেন, একটি জাতিকে গড়তে হলে শিক্ষা এবং শিক্ষকের ভূমিকা অগ্রগণ্য— যা তাঁর ভবিষ্যৎ ভাবনায় শিক্ষাকে কেন্দ্রীয় স্থানে রাখার প্রমাণ।

নতুন রাজনৈতিক শিষ্টাচার: তারেক রহমানের কণ্ঠে সংযম ও মানবিকতা
বর্তমান রাজনীতিতে যেখানে ব্যক্তিগত আক্রমণ, অপবাদ এবং ঘৃণার চর্চা নৈমিত্তিক, সেখানে তারেক রহমানের কণ্ঠে ছিল পরিণত মনোভাব, সংযত শব্দচয়ন এবং মানবিক বোধ। এই ব্যতিক্রমী ভঙ্গি তাঁকে অন্য অনেক নেতার চেয়ে আলাদা করে তোলে।

রাষ্ট্রনায়কোচিত আবির্ভাবের ইঙ্গিত
জয়নুল আবদিন ফারুক বলেন, “এত অত্যাচার-নির্যাতনের শিকার হওয়ার পরও তারেক রহমান প্রতিশোধ নয়, গণতন্ত্র ও জাতীয় স্বার্থের কথা বলছেন— এটাই একজন সত্যিকারের রাষ্ট্রনায়কের পরিচয়।” তিনি আরও যোগ করেন, “এই পরিণত নেতৃত্বই একদিন বাংলাদেশকে উদার গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করবে।”

শেষ কথা
সাক্ষাৎকারটি শুধু বিএনপি নয়, দেশের রাজনীতিতেও এক নতুন দিনের সম্ভাবনা তৈরি করেছে। প্রত্যাবর্তনের ঘোষণার পাশাপাশি তারেক রহমান যে বার্তা দিয়েছেন— তা হচ্ছে, গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা, জাতীয় স্বার্থে আপসহীনতা, এবং তরুণ নেতৃত্বের উত্থানের আহ্বান। এখন দেখার বিষয়, দেশের রাজনৈতিক বাস্তবতায় এই বার্তা কতটা প্রতিফলিত হয়।

লেখক: জয়নুল আবদিন ফারুক
পরিচিতি: বিএনপির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ও সাবেক বিরোধী দলীয় চিফ হুইপ।