আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনও সংবিধান নির্ধারিত সময়ে অনুষ্ঠানের ব্যাপারে দৃঢ় অবস্থানে সরকার ও আওয়ামী লীগ। এই নির্বাচনে বিএনপি বা আন্দোলনরত দলগুলো না এলেও ঘোষিত তফসিল অনুযায়ী নির্বাচনের সব প্রস্তুতি অব্যাহত রেখে এগিয়ে যাচ্ছে ক্ষমতাসীন দলটি।উচ্চ আদালত ২০১১ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিলের রায় দেয়। এরপর সংবিধানের ১৫তম সংশোধনীর মাধ্যমে ওই সরকার ব্যবস্থা বাতিল করা হয়। সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচনের সময় নির্বাচিত প্রতিনিধিদের নিয়ে গঠিত সরকারই ক্ষমতায় থাকবে। সে অনুযায়ী ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি আওয়ামী লীগ ও কয়েকটি দলের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের নিয়ে গঠিত সরকারের অধীনে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ওই নির্বাচনেও দলীয় সরকারে অধীনে অংশ নিতে আপত্তি জানায় বিএনপি। ওই সময় বিএনপিসহ কিছু দলের ব্যাপক বিরোধীতার মুখে সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচিত সরকারকে ক্ষমতায় রেখেই নির্বাচনের বিষয়ে অনড় অবস্থান নেয় আওয়ামী লীগ।
শেষ পর্যন্ত বিএনপিসহ আন্দোলনকারী দলগুলো নির্বাচন বর্জন করে ও ভোট ঠেকাতে টানা হরতাল, অবরোধ দিতে থাকে। ওই নির্বাচনে বিএনপি অংশ না নিলেও আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৪ দলের শরিক দলগুলো এবং মহাজোটের অংশ জাতীয় পার্টি অংশ নেয়। তবে দলটির তৎকালীন চেয়ারম্যান হুসাইন মুহাম্মদ এরশাদের ভূমিকা ছিল নাটকীয়। ওই নির্বাচন ঠেকাতে বিএনপির আন্দোলন এক পর্যায়ে সহিংস হয়ে ওঠে এবং প্রায় দুই শ’র মতো মানুষের প্রাণহানি, হাজারের বেশি আহতসহ সারা দেশে ব্যাপক ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ডের ফলে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরি হয়। এই পরিস্থিতিতেই সংবিধান নির্ধারিত সময়ে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়।
এরপর ২০১৮ সালে সংবিধান অনুযায়ী আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনেই একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপিসহ সব রাজনৈতিক দল অংশ নেয়। কিন্তু দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের অনেক আগে থেকেই আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকারের অধীনে এ নির্বাচনে না যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছে বিএনপি।
ইতোমধ্যে নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা হলেও বিএনপির আসার সম্ভাবনা খুবই কম, দলটি আসবে না বলেই ধারণা করা হচ্ছে। আওয়ামী লীগ সরকারের পদত্যাগ এবং নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের এক দফা দাবিতে চলমান আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় অবরোধ, হরতাল দিয়ে যাচ্ছে বিএনপি ও এর সহযোগী দলগুলো। নির্বাচন ঠেকাতে এই আন্দোলন আরও তীব্র হতে পারে বলেও আাভাস পাওয়া যাচ্ছে। তবে আন্দোলন অব্যাহত রাখলেও শেষ মুহূর্তে বিএনপি নির্বাচনে আসতে পারে এমন সম্ভাবনার কথা এখনও বলছেন আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারকরা।
এদিকে বিএনপি না এলেও এবং নির্বাচন বানচালের চেষ্টা অব্যাহত রাখলেও সংবিধান নির্ধারিত সময়েই নির্বাচনের ব্যাপারে কঠোর অবস্থান নিয়েই অগ্রসর হচ্ছে সরকার ও আওয়ামী লীগ। আন্দোলন ও সহিংসতা প্রতিহত করার সব ধরনের প্রস্তুতিও রয়েছে সরকার ও আওয়ামী লীগের। এই অবস্থান নিয়েই তফসিল ঘোষণার পর নির্বাচনের সব প্রস্তুতি এগিয়ে যাচ্ছে। আওয়ামী লীগ ইতোমধ্যেই দলীয় মনোনয়ন কার্যক্রমও শুরু করেছে। দলের আগ্রহী প্রার্থীদের মধ্যে মনোনয়ন ফরম বিক্রি করা হচ্ছে।
এই নির্বাচনেও আওয়ামী লীগ জোটগতভাবে অংশ গ্রহণ করবে এবং এ ঘোষণা অনেক আগেই দিয়ে রেখেছে। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৪ দলের শরিকরাও এ ঘোষণা অনুযায়ী জোটগত নির্বাচনের প্রস্তুতিই নিচ্ছে। এ জোটের বাইরে সংসদের বিরোধী দল জাতীয় পাটিও নির্বাচনের অংশ নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে এবং প্রস্তুতি নিচ্ছে।
রোববার রাষ্ট্রপতির সঙ্গে দেখা করে জাতীয় পাটির প্রধান পৃষ্ঠপোষক ও জাতীয় সংসদের বিরোধী দলের নেতা রওশন এরশাদ জানিয়েছেন, জাতীয় পার্টি নির্বাচনের জন্য প্রস্তুত। তবে জাতীয় পার্টি নিয়ে ২০১৪ সালের মতো একটা পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে বলেও আওয়ামী লীগ ধারণা করছে। দীর্ঘদিন ধরেই দলটির বর্তমান চেয়ারম্যান এবং সাবেক রাষ্ট্রপতি হুসাইন মুহাম্মদ এরশাদের ছোট ভাই জিএম কাদেরের অবস্থান অস্পষ্ট মনে করছে আওয়ামী লীগ। পাশাপাশি সাম্প্রতিক সময়ে দলটির মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নুর অবস্থানও অস্পষ্ট হিসেবেই দেখছেন ক্ষমতাসীনরা। এরা দুজনই এর আগে পাঁচ বছর করে আওয়ামী লীগ সরকারের মন্ত্রী সভায় ছিলেন। আসন্ন নির্বাচনে জিএম কাদেরের ভূমিকা বিগত সময়ে এরশাদের ভূমিকার মতো হতে পারে এ বিষয়টিও আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারকদের জানা বলে দলটির একাধিক সূত্র জানায়।
তবে জাতীয় পার্টির অধিকাংশ নেতাকর্মীই নির্বাচনে অংশ নেবে বলে আওয়ামী লীগ মনে করছে। জাতীয় সংসদের শেষ অধিবেশন চলাকালে গত ১ নভেম্বর জাতীয় পার্টির ১৭ জন এমপি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে দেখা করেন। এ সময় কাদের এবং চুন্নু ছিলেন না। এই ১৭ এমপিদের প্রত্যেকে রওশন এরশাদের নেতৃত্বে নির্বাচনে অংশ নেবেন বলে জাতীয় পার্টির একটি সূত্র জানায়।
এছাড়া বিকল্প ধারা, তৃণমূল বিএনপিসহ নতুন নিবন্ধন পাওয়া দলগুলোর মধ্যে কয়েকটি দল নির্বাচনে আসবে বলে আওয়ামী লীগ নেতারা মনে করছেন। অর্থাৎ এবারের নির্বাচনে ২০১৪ সালের চেয়ে বেশি দলের অংশ গ্রহণ ও বেশি প্রার্থী থাকবে বলে আওয়ামী লীগের ওই নেতারা জানান।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের সভাপতি মণ্ডলের সদস্য কাজী জাফরুল্লাহ বলেন, বিএনপি যেভাবে অবরোধ দিয়ে মানুষের দুর্ভোগ তৈরির চেষ্টা করছে, এসব করে তারা খুব বেশি কিছু করতে পারবে বলে আমার মনে হয় না। তফসিল ঘোষণার পর আমরা নির্বাচনের সব প্রস্তুতি নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছি। বিভিন্ন রাজনৈতিক দল নির্বাচনের জন্য নেমে পড়েছে। এখন বিএনপি অংশ না নিলেও নির্বাচন সংবিধান নির্ধারিত সময়েই অনুষ্ঠিত হবে।
আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলী সদস্য অ্যাডভোকেট কামরুল ইসলাম বলেন, ২০১৪ সালে বিএনপি নির্বাচন ঠেকানোর চেষ্টা করেছিল, পারেনি। ঠিক সময়েই হয়েছে। নির্বাচন বানচালের যেকোনো অপচেষ্টা আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা প্রতিহত করবে। তফসিল হয়ে গেছে, নির্বাচন নির্দিষ্ট সময়েই হবে। এ নির্বাচন প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলকও হবে, শেষ পর্যন্ত বিএনপি আসতেও পারে। তবে তারা না এলে অনেক দলই আসবে, প্রার্থীর অভাব হবে না। ২০১৪ সালের চেয়ে বেশি দল এ নির্বাচনে অংশ নেবে।