মেঘনা পেট্রোলিয়াম লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মীর ছাইফুল্লাহ-আল-খালেদের অবসরে যাওয়ার সময় নির্ধারিত ছিল ২০১৯ সালের ২৩ জানুয়ারি। ওই সময় মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে বিপিসি তাকে ২ বছরের জন্য চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেয়। গত ২৩ জানুয়ারি এই মেয়াদ শেষ হওয়ার কথা ছিল। সর্বশেষ এই মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই গত ১১ জানুয়ারি মেঘনা পেট্রোলিয়ামের বোর্ডের সভায় তাকে পুনরায় আরও এক বছরের জন্য চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের সিদ্ধান্ত নেয় পরিচালনা পর্ষদ। কিন্ত আইন মোতাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক নিয়োগের ক্ষমতা পরিচালনা পর্ষদের নেই। এ সংক্রান্ত আইন ও বিধি-বিধানে
এমডি নিয়োগের ক্ষমতা দেয়া হয়েছে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশন (বিপিসি)কে। মেঘনা পেট্রোলিয়াম লিমিটেডের মেমোরেন্ডাম এন্ড আর্টিকেলস অব এসোসিয়েশনেও বিয়ষটি স্পষ্ট করে বলা আছে।
অথচ মেঘনা পেট্রোলিয়ামের এমডি ছাইফুল্লাহ খালেদের সর্বশেষ এই চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ অনুমোদনে বিপিসি-কে পুরোপুরি পাশ কাটিয়ে যাওয়া হয়েছে। এমনকি এ সংক্রান্ত ফাইল প্রধানমন্ত্রীর কাছেও পাঠানো হয়নি। মেঘনা পেট্রোলিয়াম লিমিটেড এর পরিচালনা পর্যদের এমন অবৈধ কর্মকাণ্ডে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছে প্রতিষ্ঠানটির নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা বিপিসি। এ সংক্রান্ত এক চিঠিতে বিপিসি চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ অনুমোদনের ওই অবৈধ সিদ্ধান্ত বাতিল এবং বিধি-বিধান অনুসরণের নির্দেশনা দিয়েছে মেঘনা পেট্রোলিয়ামকে।
মেঘনা পেট্রোলিয়াম লিমিটেডের মেমোরেন্ডাম এন্ড আর্টিকেলস অব এসোসিয়েশনের ১৩১(ক) ধারায় বলা আছে ‘দ্যা ম্যানেজিং ডিরেক্টর অব দ্যা কোম্পানি শেল বি এপয়েন্টেড বাই দ্যা কর্পোরেশন’। তাছাড়া বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশন আইন, ২০১৬-এর ১১(ঢ)তে ‘বিপিসি’র অধীনস্থ প্রতিষ্ঠানসমূহের প্রধান নির্বাহী নিয়োগের ক্ষেত্রে কর্পোরেশনকে ক্ষমতা প্রদান করা হয়েছে।
কিন্তু মেঘনা পেট্রোলিয়ামের পরিচালনা পর্ষদ, এমনকি মন্ত্রণালয়ও এই আইন-কানুনের তোয়াক্কা করেনি। এমডির নতুন চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের প্রক্রিয়া চূড়ান্ত করা হয়েছে বিপিসিকে একেবারেই অন্ধকারে রেখে। পদাধিকারবলে মেঘনা পেট্রোলিয়াম লিমিটেডের চেয়ারম্যান পদে রয়েছেন জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের সিনিয়র সচিব মো. আনিছুর রহমান। তিনি মেঘনা পেট্রোলিয়ামের পরিচালনা পর্ষদে এমডির চুক্তিভিত্তিক নিয়েগের সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করে সেটি অনুমোদনের জন্য মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়ে দেন। এতে একদিকে আইন-কানুনের প্রতি অবজ্ঞা করা হয়েছে। অন্যদিকে সরকারের প্রশাসনিক কর্মকাণ্ডের চেইন অব কমান্ডও চরমভাবে লঙ্ঘিত হয়েছে। তাছাড়া প্রত্যেক চুক্তিভিত্তিক নিয়োগে প্রধানমন্ত্রী-রাষ্ট্রপতির অনুমোদন অপরিহার্য হলেও সেটি লঙ্ঘন করা হয়েছে। বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে আছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা স্বয়ং। তাঁকেও এই চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের ব্যাপারে সম্পূর্ণ অন্ধকারে রেখেছেন মন্ত্রণালয়ের কর্তাব্যক্তিরা।
মেঘনা পেট্রোলিয়ামের এমডি পদে মীর ছাইফুল্লাহ-আল-খালেদের নতুন চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ সংক্রান্ত পরিচালনা পর্ষদের গত ১১ জানুয়ারির ওই অবৈধ সিদ্ধান্ত বিপিসিকে পাশ কাটিয়ে জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ে পাঠানোর পর মন্ত্রণালয় এটি প্রধানমন্ত্রীর কাছে না পাঠিয়ে সরাসরি নিজেরা অনুমোদন করে। সেই অনুমোদনের চিঠি পাঠানোর হয় বিপিসিকে। গত ১৪ জানুয়ারি জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের প্রশাসন-২ অধিশাখার উপসচিব মোছাম্মাৎ ফারহানা রহমান স্বাক্ষরিত উক্ত চিঠির বিষয়বস্তু হিসেবে বলা হয়, ‘মেঘনা পেট্রোলিয়াম লিমিটেড এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক পদে জনাব মীর ছাইফুল্লাহ-আল-খালেদ-কে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের প্রস্তাব অনুমোদন।’ চিঠিতে বলা হয়, “উপর্যুক্ত বিষয়ের পরিপ্রেক্ষিতে জানানো যাচ্ছে যে, মেঘনা পেট্রোলিয়াম লিমিটেড এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক জনাব মীর ছাইফুল্লাহ-আল-খালেদ এর পূর্বের ধারাবাহিকতায় ২৫-০১-২০২১ তারিখ অথবা যোগদানের তারিখ থেকে পরবর্তী ০১ (এক) বৎসরের জন্য চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের প্রস্তাব অনুমোদিত হয়েছে।
২। তাঁর নিয়মিত চাকরি থেকে অবসর গ্রহণের অব্যবহিত পূর্বের সর্বশেষ আহরিত শেষ বেতনকে ভিত্তি ধরে চুক্তিভিত্তিক কর্মকর্তাদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য বিধি-বিধান অনুসরণে বেতন-ভাতাদি নির্ধারিত হবে।
এমতাবস্থায়, এ বিষয়ে পরবর্তী প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য নির্দেশক্রমে অনুরোধ করা হলো।”
আইন ও বিধি-বিধান অমান্য করে বিপিসি’কে না জানিয়ে মেঘনা পেট্রোলিয়ামের পরিচালনা পর্ষদ কর্তৃক নিজেদের এমডি নিয়োগ দেয়ার এমন সিদ্ধান্তে মেঘনার ওপর চটেছে বিপিসি। চিঠি দিয়ে সিদ্ধান্ত বাতিলের অনুরোধ করেছে। সিদ্ধান্ত বাতিলের পর তা বিপিসিকে পুনরায় অবহিত করার ব্যাপারেও নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। পাশাপাশি পরিচালনা পর্ষদ কর্তৃক এ ধরণের এখতিয়ার বহির্ভূত সিদ্ধান্ত ভবিষ্যতে খারাপ নজির হিসেবে আইনি জটিলতা সৃষ্টি করতে পারে বলে সতর্ক করা হয়েছে। গত ২৪ জানুয়ারি বিপিসি সচিব মো. লাল হোসেন স্বাক্ষরিত এক পত্রে মেঘনা পেট্রোলিয়াম লিমিটেডের কোম্পানি সচিবকে এ চিঠি দেওয়া হয়।
বিপিসি সচিব স্বাক্ষরিত ওই পত্রে বিগত ১১ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত মেঘনা পেট্রোলিয়াম লিমিটেডের পরিচালনা পর্ষদের ৬১৯তম সভার বিবিধ-০১/২০২১নং সিদ্ধান্ত বাতিলের অনুরোধ করা হয়। চিঠিতে পরিচালনা পর্ষদ সভার এ সংক্রান্ত সিদ্ধান্তের অংশটি উদ্ধৃত করা হয়। পরিচালনা পর্ষদের সিদ্ধান্তে বলা হয়েছিল, “মেঘনা পেট্রোলিয়াম লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মীর ছাইফুল্লাহ আল খালেদকে তার চাকরি থেকে অবসর গ্রহণের পূর্বে সর্বশেষ আহরিত শেষ বেতনকে ভিত্তি ধরে চাকরি (বেতন ভাতাদি) আদেশ ২০১৪ অনুযায়ী চুক্তিভিত্তিক কর্মকর্তাদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য বিধান অনুসরণে বেতন ভাতাদি নির্ধারণ পূর্বক কোম্পানি প্রদত্ত অন্যান্য প্রচলিত সুবিধাদিসহ মেঘনা পেট্রোলিয়াম লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক পদে ২৫ জানুয়ারি তারিখ অথবা যোগদানের তারিখ থেকে পরবর্তী এক বছরের জন্য চুক্তি ভিত্তিক নিয়োগের প্রস্তাব পর্ষদ কর্তৃক অনুমোদিত হলো। সিদ্ধান্ত কোম্পানি সচিব সরাসরি জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগে পরবর্তী কার্যক্রমের জন্য প্রেরণ করবেন”।
বিপিসির পত্রে ব্যবস্থাপনা পরিচালক নিয়োগের ক্ষেত্রে মেঘনা পেট্রোলিয়াম লিমিটেডের মেমোরেন্ডাম এন্ড আর্টিকেলস অব এসোসিয়েশনের ১৩১(ক) ধারা ‘দ্যা ম্যানেজিং ডিরেক্টর অব দ্যা কোম্পানি শেল বি এপয়েন্টেড বাই দ্যা কর্পোরেশন’ উল্লেখ করা হয়। তাছাড়া বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশন আইন, ২০১৬-এর ১১(ঢ)তে ‘বিপিসি’র অধীনস্থ প্রতিষ্ঠানসমূহের প্রধান নির্বাহী নিয়োগের ক্ষেত্রে কর্পোরেশনকে ক্ষমতা প্রদান করা হয়েছে’ বলেও উল্লেখ করা হয়। পত্রের শেষাংশে বলা হয়, মেঘনা পেট্রোলিয়াম লিমিটেড এর পরিচালনা পর্ষদের ৬১৯তম সভার বিবিধ-০১/২০২১নং সিদ্ধান্ত এমপিএলের মেমোরেন্ডাম এন্ড আর্টিকেলস্? অব এসোসিয়েশন এবং বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশন আইন, ২০১৬ এর লঙ্ঘন এবং পরিচালনা পর্ষদ কর্তৃক এ ধরণের এখতিয়ার বহির্ভূত সিদ্ধান্ত ভবিষ্যতে খারাপ নজির হিসেবে আইনি জটিলতা সৃষ্টি করতে পারে। বিধায় উক্ত সিদ্ধান্ত বাতিলের ব্যবস্থা গ্রহণ করার বিষয়টি বিপিসিকে পুনরায় অবহিত করার নির্দেশনা দেওয়া হয়।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, আইন লঙ্ঘনজনিত গুরুতর কর্মকাণ্ড ছাড়াও বিপিসি কর্মকর্তারা এটিকে চেইন অব কমাণ্ডের চরম লঙ্ঘন হিসেবে দেখছেন। মেঘনা পেট্রোলিয়ামের বর্তমান ব্যবস্থাপনা পরিচালক মীর ছাইফুল্লাহ আল খালেদকে ২০১৬ সালের জুন মাসে ব্যবস্থাপনা পরিচালক পদে পদায়ন করা হয়। ২০১৯ সালের ২৩ জানুয়ারি তার অবসরে যাওয়ার সময় নির্ধারিত ছিল। মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে বিপিসি ওই সময় তাকে দুই বছরের জন্য চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দিলেও এবার মীর ছাইফুল্লাহ আল খালেদের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের প্রক্রিয়ায় বিপিসিকে পুরোপুরি পাশ কাটিয়ে যাওয়া হয়েছে। মেঘনা পেট্রোলিয়াম লিমিটেড যদিও বিপিসির অধীন প্রতিষ্ঠান কিন্তু ওই প্রতিষ্ঠানের এমডির সর্বশেষ চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ অনুমোদনে বিপিসিকে পাশ কাটিয়ে যাওয়া হলো। এতে বিপিসি নিশ্চয়ই মেঘনা পেট্রোলিয়ামের কর্মকাণ্ডের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারাবে। যা সরকারি কর্মকাণ্ডের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর।
মেঘনা পেট্রোলিয়ামের পর্ষদ সভায় গৃহীত সিদ্ধান্ত বাতিলের জন্য চিঠি দেওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে বিপিসির সচিব (সরকারের উপসচিব) মো. লাল হোসেন কোন মন্তব্য করতে রাজি হননি। তিনি বলেন, এখন সরকারি কর্মকর্তাদের সার্ভিস রুলস আছে। আমি গণমাধ্যমে কোন কথা বলতে পারি না।’ নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন কর্মকর্তা সাপ্তাহিক শীর্ষকাগজকে বলেন, মেঘনা পেট্রোলিয়ামের কোম্পানি সচিব রেজা মো. রিয়াজকে চিঠিটি দেওয়া হয়েছে। তিনি (কোম্পানি সচিব) বিপিসির চিঠির বিষয়টি পর্ষদ সভায় উপস্থাপন করবেন এবং নির্দেশনা অনুযায়ী ওই সিদ্ধান্ত বাতিল করার পদক্ষেপ নেবেন। এরপর বিষয়টি বিপিসিকে পুনরায় অবহিত করার জন্যও নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। শীর্ষকাগজের সৌজন্যে