ঢাকা, শনিবার ২৩ই নভেম্বর ২০২৪ , বাংলা - 

ডেল্টা লাইফে বিরাজ করছে ভয়ার্ত পরিবেশ

বিশেষ প্রতিনিধি।।ঢাকাপ্রেস২৪.কম

2021-03-06, 12.00 AM
ডেল্টা লাইফে বিরাজ করছে ভয়ার্ত পরিবেশ

নিয়ন্ত্রক সংস্থা বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ (আইডিআরএ) থেকে ডেল্টা লাইফ ইন্স্যুরেন্সে প্রশাসক নিয়োগের পর অস্বাভাবিক বদলি ও পদোন্নতির ঘটনা ঘটেছে। এ নিয়ে প্রশাসককে উকিল নোটিশ পাঠিয়েছেন কোম্পানিটির সাবেক চেয়ারম্যান ও উদ্যোক্তা পরিচালক মনজুরুর রহমান। সবমিলিয়ে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত এই কোম্পানিটির কর্মীদের মধ্যে এক ধরনের ভয়ার্ত পরিবেশ বিরাজ করছে।গত ৭ ফেব্রুয়ারি এক সংবাদ সম্মেলনে ডেল্টা লাইফের পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয়, আইডিআরএ চেয়ারম্যান ড. এম মোশাররফ হোসেন তাদের কাছে ঘুষ দাবি করেন। সেই সঙ্গে আইডিআরএ চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে বিদ্বেষপূর্ণ আচরণেরও অভিযোগ করে প্রতিষ্ঠানটি।

ডেল্টা লাইফের পক্ষ থেকে বলা হয়, বিভিন্ন বিষয় সমাধানের জন্য আইডিআরএ চেয়ারম্যানের সঙ্গে আলোচনা করতে গেলে তিনি কোম্পানির কাছ প্রথমে ২ কোটি, পরবর্তীতে ১ কোটি ও সর্বশেষ ৫০ লাখ টাকা উৎকোচ দাবি করেন। এ সংক্রান্ত অডিও ক্লিপ ও ট্রান্সক্রিপ দুর্নীতি দমন কমিশনে অভিযোগ আকারে দাখিল করা হয়েছে। পরবর্তীতে এ বিষয়ে হাইকোর্ট অধিকতর তদন্ত করার আদেশ দিয়েছেন।

ডেল্টা লাইফের ওই সংবাদ সম্মেলনের চারদিনের মাথায়, ১১ ফেব্রুয়ারি সেখানে আইডিআরএ’র সাবেক সদস্য সুলতান-উল-আবেদীন মোল্লাকে প্রশাসক হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়। তিনি এক সময় ডেল্টা লাইফেও কর্মরত ছিলেন। তাকে বীমা আইন-২০১০ এর ৯৬ ধারার (১) উপধারা অনুযায়ী প্রশাসক হিসেবে চূড়ান্তভাবে দায়িত্ব গ্রহণের চার মাসের মধ্যে কর্তৃপক্ষের কাছে একটি প্রতিবেদন দাখিল করতে হবে।

সেই সঙ্গে বীমা আইন-২০১০ এর ধারা ৯৫ (৩) এর আলোকে নতুন পলিসি ইস্যু আগের মতো অব্যাহত রাখা এবং কোম্পানির ব্যবসা ও অন্যান্য কার্যক্রম যথারীতি পরিচালনা করতেও বলা হয়। পাশাপাশি শিগগিরই সুপ্রতিষ্ঠিত কোনো দেশি বা বিদেশি অডিট ফার্ম দিয়ে কোম্পানির অডিট সম্পন্ন করতেও নির্দেশ দেয়া হয়। আইডিআরএ’র চিঠি পেয়ে ১১ ফেব্রুয়ারি ডেল্টা লাইফ কার্যালয়ে দায়িত্ব বুঝে নেন সুলতান-উল-আবেদীন মোল্লা।

প্রশাসকের দায়িত্ব নেয়ার পরই সুলতান-উল-আবেদীন মোল্লা কয়েকজন কর্মীকে অস্বাভাবিক পদোন্নতি দেন। সেই সঙ্গে কয়েকজনকে ঢাকার বাইরে বদলি করেন। এসব বদলি ও পদোন্নতি নিয়ে প্রশ্ন তুলে উকিল নোটিশ পাঠিয়েছেন প্রতিষ্ঠানটির সাবেক চেয়ারম্যান মনজুরুর রহমান। সেই সঙ্গে প্রশাসক নিয়োগের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে রিট করা হয়েছে এবং প্রশাসক কর্তৃক কর্মস্থলে বিভিন্ন রকম হয়রানিমূলক কর্মকাণ্ড ও জুলুম-নির্যাতনের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করতে যাচ্ছেন বলে কর্মীদের চিঠি দিয়ে জানিয়েছেন ডেল্টা লাইফের সাবেক এই চেয়ারম্যান।

প্রশাসক সুলতান-উল-আবেদীন মোল্লা

প্রশাসক নিয়োগ, কর্মীদের বদলি-পদোন্নতি, উকিল নোটিশসহ ডেল্টা লাইফের বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে কোম্পানিটির একাধিক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘বর্তমানে ডেল্টা লাইফে এক ভয়ার্ত পরিবেশ বিরাজ করছে। কর্মকর্তারা বিভিন্ন ধরনের মানসিক চাপের মধ্যে রয়েছেন। যেকোনো মুহূর্তে চাকরি হারানো বা বদলি আতঙ্কে ভুগছেন অনেকে।’

এদিকে মনজুরুর রহমানের উকিল নোটিশে বলা হয়েছে, আইডিআরএ চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে দুদকে ঘুষ চাওয়ার যে অভিযোগ করা হয়েছে, তা প্রত্যাহার করে নেয়ার জন্য প্রশাসক চাপ প্রয়োগ করছেন।

কর্মকর্তাদের পদোন্নতির বিষয়ে উকিল নোটিশে বলা হয়েছে, ১১ ফেব্রুয়ারি (প্রশাসক দায়িত্ব নেয়ার দিন) জয়েন্ট এক্সিকিউটিভ ভাইস প্রেসিডেন্ট মনজুর মাওলা ফেনী, নোয়াখালী ও চাঁদপুরে দায়িত্বে ছিলেন। ১৩ ফেব্রুয়ারি তাকে একবারে চার ধাপ পদোন্নতি দিয়ে ডেপুটি ম্যানেজিং ডিরেক্টর এবং চিপ অপারেটিং অফিসার করা হয়েছে। তার শিক্ষাগত যোগ্যতা এবং অভিজ্ঞতা এ পদের জন্য উপযুক্ত নয়।

এছাড়া কুমিল্লা অঞ্চলের জয়েন্ট সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট আলাউদ্দিনকে প্রধান কর্যালয়ের গণ গ্রামীণ বিভাগের প্রধান করা হয়েছে। তিনিও এ পদের যোগ্য নন বলে উকিল নোটিশে উল্লেখ করা হয়েছে।

বদলির বিষয়ে উকিল নোটিশে বলা হয়েছে, জয়েন্ট এক্সিকিউটিভ ভাইস প্রেসিডেন্ট আসাদুজ্জামান মালিককে প্রধান কার্যালয় থেকে খুলনা সার্ভিস সেন্টারে বদলি করা হয়েছে। খুলনা সার্ভিস সেন্টারের দায়িত্ব মালিকের পদ থেকে চার ধাপ নিচে।

এছাড়া জয়েন্ট এক্সিকিউটিভ ভাইস প্রেসিডেন্ট মো. ফরহাদ জলিলকে প্রধান কার্যালয় থেকে বদলি করে ঠাকুরগাঁওয়ে মার্কেটিংয়ে, জয়েন্ট ভাইস প্রেসিডেন্ট এ কে এম সামিনুল ইসলামকে সিলেটে বদলি করা হয়েছে।

এদিকে মনজুরুর রহমানের নামে ডেল্টা লাইফের কর্মকর্তাদের কাছে একটি চিঠিও পাঠানো হয়েছে। ওই চিঠিতে বলা হয়েছে, ১১ ফেব্রুয়ারি ডেল্টা লাইফে আইডিআরএ চেয়ারম্যান একজন প্রশাসক নিয়োগ দিয়েছেন। এই প্রশাসক নিয়োগের বিরুদ্ধে ইতিমধ্যে উচ্চ আদালতে রিট করা হয়েছে, যা বিচারাধীন এবং দ্রুত শুনানির অপেক্ষায় আছে। আমরা আশা করছি শিগগিরই এই শুনানি অনুষ্ঠিত হবে।

এতে আরও বলা হয়েছে, হাইকোর্ট ডিভিশনের একটি দ্বৈত বেঞ্চ ২৩ ফেব্রয়ারি আদেশে প্রশাসককে তার নিয়োগপত্রে উল্লিখিত টার্ম অব রেফারেন্স ছাড়া অন্য কোনো কাজ না করতে নির্দেশ দিয়েছেন। আমরা অবগত হয়েছি যে, প্রশাসক ইতিমধ্যে কিছু অতি উৎসাহী কর্মকর্তাকে নিয়ে তার টার্ম অব রেফারেন্সের বাইরে গিয়ে গণহারে নিয়মবহির্ভূতভাবে নিয়োগ, পদোন্নতি, হয়রানিমূলক বদলি, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের চাকরিচ্যুতির ভয়ভীতি দেখানোসহ পুরো কোম্পানিতে এক ভীতিকর ও আতঙ্কের পরিবেশ সৃষ্টি করেছেন।

প্রশাসকের এসব টার্ম অব রেফারেন্সবহির্ভূত কার্যকলাপের জন্য আমাদের সিনিয়র আইনজীবী কর্তৃক প্রশাসককে ইতিমধ্যেই লিগ্যাল নোটিশ প্রদান করা হয়েছে বলেও চিঠিতে উল্লেখ করা হয়েছে।

এতে আরও বলা হয়েছে, যেসব কর্মকর্তা-কর্মচারী প্রশাসক কর্তৃক অন্যায়ভাবে কর্মস্থলে বিভিন্নরকম হয়রানিমূলক কর্মকাণ্ড ও জুলুম-নির্যাতনের শিকার হয়েছেন বা হচ্ছেন, তারা অনেকেই আমাদের জানিয়েছেন ফলে আমরা আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করতে যাচ্ছি।

এই চিঠি ও উকিল নোটিশের বিষয়ে জানতে চাইলে মনজুরুর রহমান বলেন, ‘প্রশাসক টার্ম অব রেফারেন্স’র বাইরে গিয়ে কাজ করছেন। এ কারণে আমার পক্ষ থেকে আমার আইনজীবী উকিল নোটিশ পাঠিয়েছেন। চিঠি যেহেতু আমার নামে গেছে, সুতরাং এটা আমিই পাঠিয়েছি।’

সার্বিক বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে সুলতান-উল-আবেদীন মোল্লা বলেন, ‘মনজুরুর রহমানের উকিল নোটিশ ও চিঠি আমি পাইনি। তারপরও আমি বলছি টার্ম অব রেফারেন্স’র মধ্যে থেকেই আমি সব কাজ করছি। পদোন্নতি অভ্যন্তরীণ ব্যাপার। আমাকে দৈনন্দিন কাজ চালিয়ে যেতে বলা হয়েছে। আমি কাউকে চাকরিচ্যুত করিনি।’

ডেল্টা লাইফের বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘ডেল্টা লাইফের ভেতরের অবস্থা বলার মতো পরিস্থিতি এখনো তৈরি হয়নি। এ সপ্তাহেই অডিট শুরু হবে। উনাদের থেকে ফাইন্ডিংগুলো আসুক, তারপর বলা যাবে। কর্মীদের সঙ্গে বৈঠকে তারা জানিয়েছেন, দীর্ঘদিন ধরে তারা বিভিন্ন ধরনের সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত।’