ঢাকা, বৃহস্পতিবার ২ই মে ২০২৪ , বাংলা - 

পটুয়াখালী হাসপাতালের বরাদ্ধ লুটপাট

জেলা প্রতিনিধি।। ঢাকাপ্রেস২৪.কম

2023-03-06, 12.00 AM
পটুয়াখালী হাসপাতালের বরাদ্ধ লুটপাট

পটুয়াখালী ২৫০ শয্যা জেনারেল হাসপাতালের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিরুদ্ধে অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ দীর্ঘদিনের। সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোয় তাদের বিরুদ্ধে একাধিক অভিযোগ পড়েছে। অনেকের বিরুদ্ধে মামলাও হয়েছে। অথচ অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলো দৃশ্যমান কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। সংশ্লিষ্ট কর্তাব্যক্তির পাশাপাশি প্রভাবশালীদের কাঁধে ভর করে অভিযুক্তরা রেহাই পাচ্ছে। লাগামহীন অর্থ লুটে প্রতিষ্ঠানটিতে কাক্সিক্ষত স্বাস্থ্যসেবা ব্যাহত হচ্ছে।প্রতিষ্ঠানটি দুর্নীতির অভয়ারণ্যে পরিণত হয়েছে। বরাদ্দ অর্থের সিংহভাগ লুটপাট করা হয়েছে। অর্থ লুটপাটের সত্যতা পাওয়া গেলেও তথ্য দিতে লুকোচুরি করছে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ।

 

 

 

সম্প্রতি হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. আব্দুল মতিন অবসরে গেলে ভুক্তভোগীরা মুখ খুলতে শুরু করেছেন। দুর্নীতির নতুন নতুন তথ্য বেরিয়ে আসছে।

 

 

 

সম্প্রতি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে দেওয়া অভিযোগে বলা হয়, ১৫ বছর মেডিকেল সার্জিকেল রিকুইজিট (এমএসআর) খাতে ঠিকাদারি করছেন সত্য রঞ্জন পিপলাই এন্টারপ্রাইজের মালিক মরণ বাবু। টেন্ডার দুর্নীতির মাধ্যমে কাজ পেতে তিনি তত্ত্বাবধায়ক আব্দুল মতিনকে ২০ লাখ টাকা, হিসাবরক্ষক হাসানকে ১৫ লাখ টাকা এবং স্টোর কিপার শাহিনকে ১০ লাখ টাকা দিয়েছেন। মরণ বাবুর মনগড়া শর্তাবলি দরপত্রে সংযুক্ত করতে তারা এ টাকা নেন। এছাড়া সাধারণ ঠিকাদারকে দাবিয়ে রাখতে এবং নানামুখী ঝামেলা এড়াতে ক্ষমতাসীন দলের একটি মহলকে ৩০-৩৫ লাখ টাকা মরণ বাবুকে দিতে হয়। পরবর্তীতে কাজ বাগিয়ে নেওয়ার পর বিল পরিশোধ করতে তত্ত্বাবধায়ককে ৫ শতাংশ, হিসাবরক্ষককে ৩ শতাংশ, স্টোরকিপারকে ২ শতাংশ এবং অফিসের আনুষঙ্গিক খরচ বাবদ আরও ২ শতাংশ ঘুস দেন তিনি। সব মিলিয়ে ৫০ শতাংশ ঘুস দেওয়ার পর বাকি ৫০ শতাংশ অর্থে এমএসআর খাতের ছয়টি গ্রুপের (ওষুধ, গজ ব্যান্ডেজ, কটন, মেডিকেল যন্ত্রপাতি, কেমিকেল রিজেন্ট, আসবাবপত্র, লিলেন) সামগ্রী সরবরাহ হয়। এ ৫০ শতাংশ চিকিৎসা সামগ্রী হাসপাতালে ঢোকার পর কমপক্ষে ১৫ শতাংশ চিকিৎসা সামগ্রী চোরাই পথে বাইরে বিক্রি করে একটি চক্র, যা হাসপাতাল ক্যাম্পাসে ওপেন সিক্রেট।

 

 

 

হাসপাতালের একটি সূত্র জানায়, মেসার্স আহসান ব্রাদার্স, মেসার্স পিপলাই এন্টারপ্রাইজ, মেসার্স বাপ্পী এন্টারপ্রাইজ, মেসার্স মুন্নী এন্টারপ্রাইজ নামে বরিশালের মরণ বাবুর চারটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে তিনি দীর্ঘদিন ধরে পটুয়াখালী সিভিল সার্জন ও পটুয়াখালী ২৫০ শয্যা হাসপাতালের কাজ বাগিয়ে নেন। তার কারণে স্থানীয় ঠিকাদাররা দরপত্রে অংশ নিতে পারছেন না। তারা অংশ নিতে গেলে আবার প্রভাবশালীদের হেনস্থা শিকার হন। এসব ঘটনায় হামলা-মামলা হলেও নিরসন হয়নি।

 

 

 

সম্প্রতি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের মহাপরিচালকের কাছে ঠিকাদার কুদ্দুসুর রহমান লিখিত অভিযোগ করেছেন। অভিযোগপত্রে বলা হয়, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে বিভিন্ন খাতে ১ কোটি ১৫ লাখ ৮৭ হাজার টাকা বরাদ্দে সিংহভাগ লুটপাট করেছেন তত্ত্বাবধায়ক ডা. আব্দুল মতিন ও হিসাবরক্ষক হাসান। ভেষজ খাতে ৮ লাখ টাকা, বীজ ও চারা রোপণে ১ লাখ, হাসপাতালের যন্ত্রপাতি মেরামত খাতে ১৫ লাখ, মেডিকেল যন্ত্রপাতি মেরামত খাতে ৭ লাখ টাকার পুরো টাকাই ভুয়া বিল-ভাউচারে আত্মসাৎ করা হয়েছে।

 

 

 

এছাড়া ওই বছরের কম্পিউটার ক্রয়, কম্পিউটার যন্ত্রাংশ ও সরঞ্জামাদি ও কম্পিউটার মেরামত খাতের ৩১ লাখ টাকার মাত্র ৩ লাখ খরচ করে বাকি টাকা ভুয়া বিল-ভাউচারে আত্মসাৎ করা হয়েছে। একই বছরে প্রতিষেধক খাতের ৫ লাখ টাকার মধ্যে ৭০ শতাংশ এবং আয়ুর্বেদিক খাতের ১০ লাখ টাকার ৫০ শতাংশ ভুয়া বিল-ভাউচারে আত্মসাৎ করা হয়েছে। এসব অর্থ লুটপাটের তথ্যপ্রমাণসহ সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোয় একাধিক অভিযোগপত্র দেওয়া হলেও অজ্ঞাত কারণে তদন্ত পর্যন্ত করা হয়নি। মন্ত্রণালয়ের পাশাপাশি দুর্নীতি দমন কমিশনেও (দুদক) অভিযোগ দেওয়া হয়েছে। দুদকে অভিযোগের পর ডা. আব্দুল মতিন ও হিসাবরক্ষক হাসানুজ্জামান কয়েক দিন দৌড়ঝাঁপ করলে সব ধামাচাপা পড়ে যায়। অভিযোগ ডা. মতিনের এক ঘনিষ্ঠজন আমলা হওয়ায় দুদকে সব আটকে গেছে।

 

 

 

আরেকটি সূত্র জানায়, অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে তথ্যপ্রমাণসহ অভিযোগ স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে দেওয়া হয়েছে। অথচ এখন পর্যন্ত কোনো তদন্ত বা ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। বরং যারা অভিযোগ করেন তাদের কালো তালিকাভুক্ত করাসহ নানাভাবে হয়রানি-হেনস্থা করা হয়।

 

 

 

সব অভিযোগ অস্বীকার করে ঠিকাদার মরণ বাবু বলেন, পিপিআর অনুসারে তিনি কাজ নেই। যারা অভিযোগ করছেন, তারা কাজ পেতে অযোগ্য। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের ডিজির কাছে তারা ভূরি ভূরি অভিযোগ করেছেন. যা মন্ত্রণালয় ছুড়ে ফেলে দেয়। এ ছাড়া কুদ্দুস মামলাবাজ।

 

 

 

অভিযোগ সম্পর্কে জানতে তত্ত্বাবধায়ক ডা. আব্দুল মতিনের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়। তার মোবাইল ফোন বন্ধ থাকায় যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি। এ প্রসঙ্গে ভারপ্রাপ্ত তত্ত্বাবধায়ক ডা. দিলরুবা ইয়াসমিন লিজার মোবাইল ফোনে কল করা হলেও তাকে পাওয়া যায়নি।

 

 

 

অনুসন্ধানে জানা যায়, ২০২০-২১ অর্থবছরে রাজস্ব খাতে বেতন-ভাতা ছাড়া প্রায় ৯ কোটি টাকা এবং ২১-২২ অর্থবছরে প্রায় পৌনে ১০ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয় সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়। এক বছর নানা টালবাহানার পর হাসপাতালটির হিসাবরক্ষক মো. হাসানুজ্জামান ১৯ ফেব্রুয়ারি এ প্রতিনিধির কাছে দায়সারা তথ্য দেন। তিনি দাবি করেন, ২০২০-২১ অর্থবছরে ৩ কোটি এবং ২০২১-২২ অর্থবছরে ৭ কোটি টাকা বরাদ্দ থেকে ২ কোটি কেটে নিয়েছে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ। প্রাপ্ত বরাদ্দ সঠিকভাবে খরচ হয়েছে, কোনো অনিয়ম হয়নি।

 

 

 

অনুসন্ধানে জানা যায়, ২০২১-২২ অর্থবছরে কম্পিউটার কিনতে ৭ লাখ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়। অথচ দুই লাখ টাকায় চারটি কম্পিউটার কিনে বাকি টাকা ভাগাভাগি করা হয়েছে। কম্পিউটার যন্ত্রাংশ ও রক্ষণাবেক্ষণ খাতে ৬ লাখ টাকা দেওয়া হয়। বাস্তবে কোনো যন্ত্রাংশ না কিনে ভুয়া বিল-ভাউচারে ৬ লাখ টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে। একইভাবে ভুয়া বিল-ভাউচারের মাধ্যমে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন খাতের ৮ লাখ টাকা এবং অন্যসব যন্ত্রপাতি খাতে ১০ লাখ টাকা কোটেশনের মাধ্যমে আত্মসাৎ করেছেন উল্লিখিত ব্যক্তিরা। এ ছাড়া ২০২১-২২ অর্থবছরে ভেষজ খাতে সাড়ে ১৩ লাখ টাকা বরাদ্দ রয়েছে। অথচ হাসপাতাল কমপ্লেক্সে কোনো গাছ রোপণ করা হয়নি। একইভাবে ভুয়া বিল-ভাউচারে অনুষ্ঠান ও উৎসব খাতের ৩ লাখ টাকাও আত্মসাৎ করেছেন।

 

 

 

একাধিক সূত্র জানায়, অনুন্নয়ন ও উন্নয়ন খাতে ২০২০-২১ অর্থবছরে এমএসআর খাতে ১১ কোটি ৫৬ লাখ টাকার ৫০ শতাংশ অর্থ লুটপাট হয়েছে। ওই বছরের ভেষজ খাতে ২৬ লাখ টাকা দেওয়া হলেও কোনো গাছ লাগানো হয়নি। ২০২০-২১ অর্থবছরে কম্পিউটার মেরামত খাতে ১৬ লাখ এবং কম্পিউটার যন্ত্রাংশ খাতে ১৩ টাকা ভুয়া বিল-ভাউচার করে ভাগাভাগি করেছেন চক্রটি।

অভিযোগকারীরা বলেন, মাঠ পর্যায়ে অর্থ লুটপাটের শতভাগ প্রমাণ রয়েছে। কিন্তু অজ্ঞাত কারণে তদন্ত হয় না। নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রতিষ্ঠানটির একাধিক সূত্র জানায়, ২০০৫ সালে হাসপাতাল বাউন্ডারিতে গাছ রোপণ করা হয়। এরপর বীজ ও চারা রোপন খাতের সব বরাদ্দ ভুয়া বিল-ভাউচারে আত্মসাৎ করেছেন দায়িত্বপ্রাপ্তরা।