সকলকে দুর্যোগের ঝুঁকি বিষয়ে সতর্কতার সাথে কাজ করার আহ্বান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, যতই ঝুঁকি আসুক দেশের উন্নয়ন অব্যাহত রাখতে হবে।প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘এই দেশটা আমাদের, কাজেই যত ঝুঁকি আসুক দেশের উন্নয়ন আমাদেরকে অব্যাহত রাখতে হবে। দেশের মানুষের ভাগ্য পরিবর্তন করতে হবে। দারিদ্রের হাত থেকে মানুষকে মুক্তি দিতে হবে।’বঙ্গবন্ধু কন্যা জাতির পিতার ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ থেকে সেই বিখ্যাত উক্তি ‘আমাদের কেউ দাবায়ে রাখতে পারবানা’র উদ্ধৃতি তুলে ধরে বলেন, ‘যত দুর্যোগই আসুক বাঙালিকে, বাংলাদেশকে কেউ দাবায়ে রাখতে পারবেনা-এটাই হচ্ছে আমাদের কথা।’
শেখ হাসিনা আজ সকালে ঘুর্ণিঝড় প্রস্তুতি কর্মসূচি’র (সিপিপি) ৫০ বছর পদার্পন ও আন্তর্জাতিক দুর্যোগ প্রশমন দিবস ২০২১ উদযাপন অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির ভাষণে একথা বলেন।
তিনি গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে রাজধানীর ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় আয়োজিত মুল অনুষ্ঠানে ভার্চুয়ালি অংশগ্রহণ করেন। অনুষ্ঠানের অপরপ্রান্তে মুক্তিযোদ্ধা মাঠ কক্সবাজার প্রান্তও সংযুক্ত ছিল।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশ সাড়াবিশে^ আজকে দুর্যোগ ঝুঁকি মোকবেলায় একটি আদর্শ দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে। আমাদের এই সম্মান যাতে বজায় থাকে সেজন্য ভবিষ্যতে সে বিষয়েও সকলকে সচেতন থাকতে হবে এবং এই ব্যবস্থা অব্যাহত রাখতে হবে।
তিনি এ সময় ’৯১ সালের ঘুর্ণিঝড়ের পর আওয়ামী লীগের সংসদে এই নিয়ে কথা তোলার প্রেক্ষিতে সে সময়কার প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার উক্তি ‘যত মানুষ মরার কথা ছিল তত মানুষ মারা যায় নাই’ উল্লেখ করে বলেন, এই কথা জীবনে যেন আর শুনতে না হয় সেজন্য সবাইকে সচেতন থাকতে হবে এবং মানুষকে সচেতন করতে হবে।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা এবং ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী ডা.মো এনামুর রহমান এবং ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. মোহসীন অনুষ্ঠানে বক্তৃতা করেন।
অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে চারটি ইউনিটেরও উদ্বোধন করেন। এগুলো হচ্ছে- দ্রুত সাড়াদান ইউনিট, পানি থেকে উদ্ধার ইউনিট, অতি জোয়ার মনিটরিং ও সাড়াদান ইউনিট এবং খেলায় খেলায় দুর্যোগ প্রস্তুতি ইউনিট (স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের নিয়ে জনসচেতনতামূলক)। এছাড়া, ‘দুর্যোগ সহনশীল বাংলাদেশ বিনির্মাণে শেখ হাসিনা’ শীর্ষক দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিষয়ক একটি গ্রন্থের মোড়ক উন্মোচন করেন তিনি এবং দুর্যোগ প্রশমন বিষয়ক আওয়ামী লীগ সরকারের প্রচেষ্টা সম্পর্কিত ভিডিও চিত্র ‘দুর্যোগ প্রশমনের ৫০ বছর বঙ্গবন্ধু থেকে শেখ হাসিনা’ শীর্ষক ভিডিও চিত্র ও অনুষ্ঠানে পরিবেশিত হয়।
সিপিপি’র ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষ্যে ৩ জন সংগঠক এবং ৬ জন স্বেচ্ছাসেবক নারী-পুরুষকে প্রধানমন্ত্রীর পক্ষে ডা.এনামুর রহমান অনুষ্ঠানে আজীবন সম্মাননা প্রদান করেন।
প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব ড. আহমদ কায়কাউস গণভবন প্রান্ত থেকে অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন।
মন্ত্রিপরিষদ সদস্যবৃন্দ, সংসদ সদস্যগণ, তিনবাহিনী প্রধানগণসহ সরকারের উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তাবৃন্দ, বিদেশি কূটনিতিক ও মিশন প্রধান, উন্নয়ন সহযোগী সংস্থার প্রতিনিধিবৃন্দ এবং আমন্ত্রিত অতিথিবৃন্দ অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন।
সিপিপি’র স্বেচ্ছাসেবকদের দলে নারী স্বেচ্ছাসেবক অন্তর্ভূক্ত করায় এই কর্মসূচি অতীতের থেকে আরো বেশি কার্যকর হচ্ছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, যে কোন প্রাকৃতিক দূর্যোগের ঝুঁকি থেকে যাতে আমরা মুক্ত হতে পারি সেই ব্যবস্থা আমরা সবসময় নেব।
জাতির পিতার পদাংক অণুসরণ করে মানুষকে দুর্যোগ নিরাপত্তা প্রদানসহ মানুষের মৌলিক চাহিদাগুলো পূরণেও তাঁর সরকার উদ্যোগ নিয়েছে উল্লেখ করে সরকার প্রধান বলেন, আগামীতে বাংলাদেশ উন্নত-সমৃদ্ধ দেশ হিসেবে যে এগিয়ে যাবে সেদিকে বিশেষভাবে দৃষ্টি রেখেই আমরা বিভিন্ন পরিকল্পনা প্রণয়ন করে দিয়ে গেলাম।
তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ সবসময় জনগণের পাশে আছে। দুর্যোগে আর কেউ না থাকুক আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা সবসময় পাশে রয়েছে।
তিনি এই সময় করেনাকালিন জীবনের ঝুঁকি নিয়ে আওয়ামী লীগ এবং তাঁর সহযোগি সংগঠনের নেতা-কর্মীদের মানুষের পাশে দাঁড়ানোর কথা স্মরণ করে বলেন, মৃতের দাফন-কাফন থেকে শুরু করে তাঁদের ঘরে খাবার পৌঁছে দেয়ার কাজটা আমরা সরকারের পক্ষ থেকে যেমন করেছি তেমনি দলের পক্ষ থেকেও করেছি । তবে, আর কাউকেই এভাবে এগিয়ে আসতে আমি দেখি নাই।
জাতির পিতা ১৯৭৩ সালের ১ জুলাই দুর্যোগ ঝুঁঁকিহ্রাসে ‘ঘূর্ণিঝড় প্রস্তুতি কর্মসূচি (সিপিপি)’ গ্রহণ করেন, যা আজ বিশ্বব্যাপী সমাদৃত উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বঙ্গবন্ধু ঘূর্ণিঝড় থেকে জনগণের জানমাল রক্ষায় সেই সময় ১৭২টি উঁচু মাটির কিল্লা তৈরি করেন যা পরবর্তীকালে জনগণ ‘মুজিব কিল্লা’ নামকরণ করেন।
তিনি বলেন, আমরা পূর্বের মুজিব কিল্লাসমূহ সংস্কারসহ নতুন করে আরও ৩৭৮টি মুজিব কিল্লা নির্মাণ করছি।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, তাঁর সরকার জাতীয় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কাউন্সিল গঠন এবং দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা আইন প্রণয়ন করেছে এবং এই আইনের আওতায় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তর গঠন করেছে যা দুর্যোগ মোকাবিলা, ঝুঁকি হ্রাসকরণ ও ব্যবস্থাপনায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে। পাশাপাশি, সরকার ২০২১-২০২৫ সাল মেয়াদের জন্য জাতীয় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা পরিকল্পনা প্রণয়ন করেছে।
তিনি বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনজনিত অভ্যন্তরীণ বাস্তুহারা মানুষের দুর্দশার বিষয়গুলো আমলে নিয়ে সরকার ২০১৫ সালে একটি কৌশলপত্র প্রণয়ন করে এবং জাতীয় রিজিলিয়েন্স পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে, যা সেন্দাই ফ্রেমওয়ার্ক ও এসডিজি’র সাথে সঙ্গতিপূর্ণ।
এই ব-দ্বীপ অঞ্চলের সার্বিক উন্নয়নে শতবর্ষ মেয়াদি ডেল্টা পরিকল্পনা বাস্তবায়নের অংশ হিসেবে ৮০টি প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজ তাঁর সরকার শুরু করেছে উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, বন্যা আমাদের আসবেই কাজেই বন্যা নিয়ন্ত্রণ করার বা বন্যার সঙ্গে বসবাস করার অভ্যাস আমাদেরকে করতে হবে। বন্যায় মানুষ যাতে ক্ষতিগ্রস্থ না হয়, সম্পদ যাতে ক্ষতিগ্রস্থ না হয়, সেভাবেই আমাদের উন্নয়ন প্রকল্প নিতে হবে এবং প্রতিটি এলাকায় আমাদের জলাধার থাকতে হবে।
তিনি বলেন, আমরা ২০২২ সালের মধ্যে ৫১০ কিলোমিটার নদী ড্রেজিংয়ের পরিকল্পনা নিয়েছি এবং গ্রীষ্মকালে সেচের পানি সংরক্ষণের জন্য জলাধার নির্মাণ, ৪ হাজার ৮৮৩ কিলোমিটার খাল খনন, বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ নির্মাণ, সংস্কারসহ নানাবিধ প্রকল্প গ্রহণ করেছি।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, দুর্যোগ ঝুঁঁকিহ্রাসে আমাদের সময়ে সারাদেশে ২৩০টি বন্যা আশ্রয়কেন্দ্র ও ৩২০টি ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণ করা হয়েছে। আরও ২২০টি ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্র ও ৪২৩টি বন্যা আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণ করা হচ্ছে। ৬৪ জেলায় ৬৬টি জেলা ত্রাণ গুদাম কাম দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা তথ্য কেন্দ্র স্থাপন কার্যক্রম চলমান রয়েছে।
তিনি বলেন, ভূমিকম্প ও নগর এলাকায় রাসায়নিক দুর্যোগসহ অগ্নিœকা- ঝুঁকিহ্রাস ও সাড়াদান কার্যক্রমে নতুন করে আমরা আরও ২ হাজার ২৭৫ কোটি টাকার প্রকল্প গ্রহণ করেছি। এর আগে দুর্যোগ ঝুঁকিহ্রাসে ফায়ার সার্ভিস, সশস্ত্র বাহিনী বিভাগ ও সহযোগী সংস্থার সক্ষমতা বাড়াতে যথাক্রমে ৬৯ কোটি এবং ২৩৪ কোটি টাকার সরঞ্জাম ক্রয় করেছি।
ফায়ার সার্ভিস এবং সিভিল ডিফেন্সকে আরো শক্তিশালীকরণে তাঁর সরকারের উদ্যোগ তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এখন যেসব বহুতল ভবন হচ্ছে পর্যাপ্ত অগ্নিনির্বাপন ব্যবস্থা যেন সেসব ভবনে মজুদ থাকে। বহুতল ভবন নির্মাণের সময় যেমন তা নিশ্চিত করতে হবে, তেমনি আবার কোন ধরনের দুর্ঘটনা ঘটলে সেখান থেকে মানুষকে উদ্ধারের সরঞ্জামাদি ও ফায়ার সার্র্ভিসের জন্য প্রয়োজনীয় সরঞ্জামাদি সরকার সংগ্রহ করছে।
তিনি দুর্যোগ ঝুঁকি প্রশমনে ব্যক্তিগত স্থাপনা তৈরীর সময়ও সকলকে সতর্ক থাকার আহবান জানিয়ে বলেন, আপনি ঘর-বাড়ি, অফিস, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান যাই করেন না কেন সেটা করার সময় আপনাকে অগ্নিকান্ড, ঝড়,বন্যা বা প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্থ হওয়ার ঝুঁকির কথা মাথায় রাখতে হবে এবং বিল্ডিং কোড মেনেই ভবন তৈরী করতে হবে।
বন্যায় অসহায় মানুষ ও গৃহপালিত পশুপাখি নিরাপদ জায়গায় স্থানান্তরের জন্য নৌবাহিনীর সহায়তায় ৬০টি মাল্টিপারপাস রেসকিউ বোট তৈরি ও হস্তান্তর প্রক্রিয়া চলমান আছে বলেও জানান তিনি।
তাঁর সরকারের উদ্যোগে ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণের ফলে মানুষের হাতে হাতে মোবাইল ফোন পৌঁছে গেছে এবং কমিউনিটি রেডিও ও মিডিয়ার মাধ্যমে দুর্যোগ সম্পর্কে মানুষকে আগাম পূর্বাভাষ প্রদানও অব্যাহত রয়েছে। সরকার প্রতিটি উপজেলায় একটি করে ফায়ার সার্ভিস স্টেশন নির্মাণ করে দিচ্ছে।
তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় না আসলে এসব আর কেউ করতো বলে মনে হয়না। কারণ অন্যদের মানুষের সম্পর্কে কোন দায়বদ্ধতা নেই। আর আওয়ামী লীগের রাজনীতিই হচ্ছে মানুষের জন্য। তিনি প্রাকৃতিক দুর্যোগের পাশাপাশি মনুষ্য সৃষ্ট দুর্যোগ মোকাবেলা করেও তাঁর সরকারের এগিয়ে যাওয়ার কথা বলতে গিয়ে ২০১৩, ১৪ এবং ১৫ সালে বিএনপি’র আগুন দিয়ে পুড়িয়ে মানুষ হত্যার কথাও স্মরণ করিয়ে দেন।
শেখ হাসিনা বলেন, আমরা ২০২০ সালের সেপ্টেম্বরে ঢাকায় গ্লোবাল এডাপটেশন সেন্টারের কার্যালয় স্থাপন করেছি। এবার জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ৭৬তম অধিবেশনে অংশগ্রহণ করে বাংলাদেশের ‘মুজিব জলবায়ু সমৃদ্ধি পরিকল্পনা-দশক ২০৩০’ এর কার্যক্রম সম্পর্কে বিশ্ব নেতৃবৃন্দকে অবহিত করেছি এবং এটা প্রত্যেকর কাছে খুব সমাদৃত হয়েছে। পাশাপাশি, আমি বিভিন্ন ফোরামে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ক্ষয়ক্ষতি ও পুনর্বাসনের বিষয়ে ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলো যেন সহায়তা পায় তা জোড়ালো ভাবে তুলে ধরেছি।
উল্লেখ্য, জাতিসংঘের দুর্যোগ প্রশমন কার্যালয় (ইউএনডিআরআর) এ বছরের প্রতিপাদ্য নির্বাচন করেছে- ‘দুর্যোগ ঝুঁকি হ্রাসে, কাজ করি একসাথে’। আর আন্তর্জাতিক দুর্যোগ প্রশমন দিবসে এ বছর জাতীয়ভাবে প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করা হয়েছে ‘মুজিববর্ষের প্রতিশ্রুতি, জোরদার করি দুর্যোগ প্রস্তুতি।’