ঢাকা, শনিবার ২৭ই এপ্রিল ২০২৪ , বাংলা - 

‘ব্যর্থতা’ ঢাকতেই রেস্টুরেন্টে ঢালাও অভিযান

ষ্টাফ রিপোটার।। ঢাকাপ্রেস২৪.কম

2024-03-22, 12.00 AM
‘ব্যর্থতা’ ঢাকতেই রেস্টুরেন্টে ঢালাও অভিযান

গত ২৯ ফেব্রুয়ারি বেইলি রোডের ‘গ্রিন কোজি কটেজ’ ভবনে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড ঘটে। আগুনে পুড়ে মারা যান সরকারি কর্মকর্তা, সাংবাদিক ও শিশুসহ ৪৬ জন। এ ঘটনার পর থেকে রাজউক, সিটি করপোরেশন এবং ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তর ঢাকাসহ সারাদেশে অভিযান শুরু করে। এরই মধ্যে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে অনেক রেস্টুরেন্ট। জরিমানা করা হয়েছে ৬০ লাখ টাকার বেশি। এ প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত ডিএমপি এক হাজার ১৩২টি রেস্টুরেন্টে অভিযান চালিয়েছে। রাজউক ৩৩টি ভবনে অভিযান চালিয়ে সাড়ে ৪৭ লাখ টাকা জরিমানা করেছে। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন দুটি ভবন ও দুটি রেস্টুরেন্ট সিলগালা করার পাশাপাশি ৭টি প্রতিষ্ঠানকে ৭ লাখ ১০ হাজার টাকা জরিমানা করেছে। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন জরিমানা করেছে ২২টি প্রতিষ্ঠানকে, যরি পরিমাণ ৬ লাখ ১৮ হাজার টাকা।রাজধানীর বিভিন্ন রেস্টুরেন্টে সাঁড়াশি অভিযান নিয়ে সরকারের তিন সংস্থা ও মালিকরা এখন মুখোমুখি অবস্থানে। রাজউক, সিটি করপোরেশন ও ফায়ার সার্ভিস বলছে, রেস্টুরেন্ট মালিকরা নিয়ম না মানায় অগ্নিঝুঁকি বাড়ছে। ঘটছে ভয়াবহ দুর্ঘটনা। এজন্যই অভিযান।

রেস্টুরেন্ট মালিকদের অভিযোগ, নিজেদের ব্যর্থতা ঢাকতেই অন্যায়ভাবে অভিযান শুরু করেছে সব সংস্থা। ভাঙচুর ও গ্রেফতার করছে। এই শিল্প রীতিমতো ধ্বংসের পথে। ঝুঁকিতে পড়েছে প্রায় পাঁচ লাখ লোকের কর্মসংস্থান।জানা যায়, সরকারি কমবেশি ১৩ প্রতিষ্ঠান-দপ্তর থেকে অনুমতি নেওয়ার বাধ্যবাধকতা থাকলেও মাত্র দু-তিনটি ছাড়পত্র হাতে নিয়েই দিব্যি চলছে রেস্টুরেন্ট ব্যবসা। অনেকে একটি ব্যবসায়িক নিবন্ধন নিয়ে পাঁচ-সাতটি শাখা খুলে বসেছে। রেস্টুরেন্ট ব্যবসার জন্য ফায়ার সার্ভিসের অনুমতি ছাড়াও সিটি করপোরেশন, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড, কলকারখানা অধিদপ্তর, পরিবেশ অধিদপ্তর, জেলা প্রশাসকের কার্যালয়, বিস্ফোরক অধিদপ্তর, বিদ্যুৎ বিভাগসহ মোট ১৩টি দপ্তর-সংস্থার অনুমতি নিতে হয়। তবে বেশিরভাগ রেস্টুরেন্ট শুধু জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের অনুমোদন ও সিটি করপোরেশন থেকে ট্রেড লাইসেন্স নিয়ে ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে। ফায়ার সার্ভিসের অনুমোদনের বিষয়টি একটু জটিল বলে অনেকেরই সে অনুমোদন নেই। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) নিয়মিত ভ্যাট আদায় করলেও অনেক রেস্টুরেন্ট সংস্থাটির অনুমোদনের বাইরেই রয়ে গেছে।এনবিআরের অনুমোদন সহজেই পাওয়া যায় বলে জানান ব্যবসায়ীরা। তারা বলেন, এনবিআর রাজস্ব আদায় বাড়ানোর স্বার্থেই তারা সহজে অনুমোদন দেয়। সিটি করপোরেশনের ক্ষেত্রেও তাই।খোঁজ নিয়ে জানা যায়, তারকা হোটেল ছাড়া সারাদেশে রেস্টুরেন্টের প্রকৃত সংখ্যা কত, সঠিক হিসাব কারও কাছে নেই। তবে রেস্টুরেন্ট ব্যবসায়ীদের মতে, এ সংখ্যা প্রায় সাড়ে পাঁচ লাখ। এর মধ্যে রাজধানীতে আছে প্রায় ২৫ হাজার। দু-তিনটি প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে ছাড়পত্র নিয়ে ব্যবসা করছে তিন হাজারের মতো রেস্টুরেন্ট। ঢাকার জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের অনুমোদন আছে মাত্র পাঁচ হাজার ৬০০টি রেস্টুরেন্টের। সিটি করপোরেশনের ট্রেড লাইসেন্স আছে সাত হাজারের মতো রেস্টুরেন্টের।

 

আর ফায়ার সার্ভিসের তথ্যমতে, রাজধানী ঢাকায় প্রায় পাঁচ হাজার রেস্টুরেন্ট ও খাবারের দোকান রয়েছে। এর মধ্যে ৯৬ শতাংশ চলছে অনেকটা ঝুঁকিপূর্ণভাবে।বেইলি রোডের অগ্নিকাণ্ডের পর রেস্টুরেন্ট ব্যবসা চলা ভবনগুলোতে অভিযান ও তথ্য অনুসন্ধান চালাচ্ছে রাজউক। তারাও মাঠ পর্যায়ে গিয়ে পাচ্ছে রেস্টুরেন্ট পরিচালনার ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় ঘাটতির চিত্র।

 

রেস্টুরেন্ট মালিক সমিতির এক নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, একটি রেস্টুরেন্ট যখন কোনো মালিক চালু করেন তখন তার দুই তিন জায়গা থেকেই অনুমোদন নিতেই খুব কঠিন হয়ে যায়। তারপরেও একজন মালিক অনুমোদন ম্যানেজ করে তারা রেস্টুরেন্ট পরিচালনা করেন। কিন্তু আসল নিয়ম অনুযায়ী ১০ থেকে ১৩টি সংস্থা/দপ্তরের কাছ থেকে রেস্টুরেন্ট মালিককে অনুমোদন নিতে হয়। আর সেটা যদি একজন রেস্টুরেন্ট মালিক করতে চান তাহলে তার রেস্টুরেন্টই করা হয়ে উঠবে না। কারণ এগুলো ম্যানেজ করা খুব কঠিন। তাই দু-এক জায়গায় অনুমোদন নিয়েই রেস্টুরেন্ট পরিচালনা করছেন অধিকাংশ মালিক।ড্যাপের সমীক্ষা রিপোর্ট সূত্র বলছে, ঢাকার ভবনগুলোর মধ্যে ৮৮ শতাংশ অবৈধ। বাকি ১২ শতাংশ কোনো না কোনোভাবে ব্যত্যয় করেছে। রাজউক এলাকায় মাত্র সাড়ে পাঁচ হাজার ভবনের অকুপেন্সি সার্টিফিকেট আছে। তাহলে বাকিরা কীভাবে গড়ে উঠলো?

 

এলপিজি গ্যাস সিলিন্ডারের বিষয়ে একটি সূত্রে জানা যায়, দেশে মোট জনসংখ্যার ৫০ লাখ পরিবার এলপিজি সিলিন্ডার ব্যবহার করে। আবাসিক ও বাণিজ্যে প্রাকৃতিক গ্যাসের সংযোগ বন্ধ থাকায় এখন রান্না চলে গ্যাস সিলিন্ডারে। এসব সিলিন্ডার কয়েকটি প্রতিষ্ঠান সারাদেশে ছড়িয়ে দিচ্ছে। রাজধানীর রেস্টুরেন্টগুলো অধিকাংশই এলপিজি গ্যাসনির্ভর।

 

বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা), বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্স এবং পরিবেশবাদী সংগঠন বেলার তথ্য বলছে- গত ৯ বছরে বাংলাদেশে এক লাখ ৯০ হাজার ১৬৭টি অগ্নিকাণ্ড ঘটেছে। এতে এক হাজার ৫১ জন নিহত ও আহত হয়েছেন তিন হাজার ৬০৬ জন।

 

নগর পরিকল্পনাবিদরা বলছেন, ৩০৫ বর্গকিলোমিটার এলাকাজুড়ে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন এলাকা। এ অংশে সরকারি হিসাবে এক কোটির বেশি মানুষের বসবাস। বেসরকারি সংস্থাগুলোর হিসাবে এ সংখ্যা দেড় থেকে দুই কোটি। প্রতি একরে জনঘনত্ব ১০০ থেকে ১২০ জন থাকার কথা থাকলেও বাস্তবে ৫০০ থেকে ৬০০ জন বসবাস করছে। কোথাও এক থেকে দুই হাজার মানুষের বসবাস। পুরান ঢাকার লালবাগ জনঘনত্ব বিবেচনায় বিশ্বে শীর্ষে রয়েছে। আর চকবাজার ও কোতোয়ালি এলাকাও শীর্ষ ৫-এ অবস্থান করছে।রেস্টুরেন্ট মালিক সমিতির মহাসচিব ইমরান হাসান  বলেন, ‘বেইলি রোডের গ্রিন কোজি কটেজে অগ্নিকাণ্ডের দায় কেউ এড়াতে পারে না। পুরো ভবনটাই ছিল অনিয়মে ভরা, ভবনটির অনুমোদন দিয়েছে রাজউক। রেস্টুরেন্ট সেক্টরটি তদারকি করে বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ, জাতীয় ভোক্তা অধিকার ও সংরক্ষণ অধিদপ্তর, সিটি করপোরেশন, কলকারখানা পরিদর্শন অধিদপ্তর। এছাড়া সংযুক্ত আছেন জেলা প্রশাসক-প্রশাসনসহ অনেক অধিদপ্তর ও সংস্থা।’

 

তিনি বলেন, ‘বর্তমানে ৮০০-এর মতো রেস্টুরেন্ট বন্ধ। এর মধ্যে অভিযানে সিলগালা করে দেওয়া হয়েছে ২২০-২৩০টি। অনেকে ভয়ে রেস্টুরেন্ট বন্ধ করে দিচ্ছেন। অভিযানের নামে রেস্টুরেন্ট সেক্টরে নৈরাজ্যকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। অভিযানের নামে সুযোগ নিয়ে সব সংস্থা চাঁদাবাজি শুরু করে দিয়েছে। ভয়ভীতি দেখিয়ে চাঁদাবাজি করছে।’

 

‘আমি বলবো না আমরা ব্যবসায়ী সবাই সহিভাবে ব্যবসা করি। ব্যবসায়ীদের অনেকে অতিলোভি। আমাদের ৯৫ শতাংশ মালিক-শ্রমিক অদক্ষ।’বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) সহ-সভাপতি স্থপতি ইকবাল হাবিব  বলেন, ‘সাভারের রানা প্লাজা ধসের ঘটনার পর বিদেশি পোশাক ক্রেতাদের (বায়ার) চাপে ও সরকারের চেষ্টায় মাত্র আড়াই বছরে সর্বোচ্চ সবুজ শিল্পের দেশে রূপান্তরিত হয়েছে বাংলাদেশ। আগামী তিন থেকে ছয় মাসের মধ্যে নগরে অগ্নিঝুঁকিপূর্ণ ভবনগুলো চিহ্নিত করা এবং সে অনুযায়ী প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি।’

 

‘ফায়ার সার্ভিসসহ বিভিন্ন অংশীদারি প্রতিষ্ঠানের সমন্বয়ে টাস্কফোর্স গঠন করে ঢাকাসহ সারাদেশে ঝুঁকিপূর্ণ ভবন চিহ্নিত করতে হবে। চিহ্নিত ভবনের তালিকা অনলাইনে প্রকাশ করার সঙ্গে সঙ্গে নির্দিষ্ট ভবনের সামনে তা প্রকাশ্যে প্রদর্শনের ব্যবস্থা করতে হবে।’

 

রাজউক ও সিটি করপোরেশন যা বলছে

ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) জনসংযোগ কর্মকর্তা মো. আবু নাছের বলেন, ‘বেইলি রোডে অগ্নিকাণ্ডের পর আমাদের পক্ষ থেকে বিভিন্ন রেস্টুরেন্ট-হোটেলে অভিযান পরিচালিত হয়েছে। এরই মধ্যে অনেকেই সংশোধিত হয়েছে। যারা হয়নি তারা শিগগির হবে বলে আশা করি।’

 

এ ধরনের অভিযান চলমান থাকবে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘ব্যবসায়ীদের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ঈদের আগ পর্যন্ত কোনো অভিযান পরিচালিত হবে না। তবে ঈদের পর যেসব রেস্টুরেন্ট-হোটেলে অনিয়ম ও অভিযোগ রয়েছে তাদের বিরুদ্ধে যৌথভাবে অভিযান পরিচালিত হবে।’

 

রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) চেয়ারম্যান মো. আনিছুর রহমান মিঞা বলেন, ‘আমরা সব সংস্থার সমন্বয়ে ঢাকার অগ্নিঝুঁকিপূর্ণ ভবনের তালিকা তৈরির উদ্যোগ নিয়েছি। এরই মধ্যে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের নিদের্শনা দেওয়া হয়েছে। তালিকা পাওয়ার পর পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়া হবে। আমরা ফায়ার সার্ভিসের সঙ্গে আলোচনা করেছি। ইমারত বিধিমালা নিয়ে কাজ করছি।’

 

তিনি বলেন, ‘বহুতল ভবনের উচ্চতা নির্ধারণে আইন ও বিধিমালার মধ্যে সমন্বয় করা হবে। ভবন অনুমোদন, নকশা ঠিক আছে কি না, রেস্টুরেন্টকে ঠিকমতো সব নিয়ম মেনে অনুমোদন দেওয়া হয়েছে কি না, এগুলো আমরা দেখছি। সেখানে যদি রাজউকের কোনো কর্মকর্তা-কর্মচারীর দায় পাওয়া যায়, তবে আমরা তাদের বিরুদ্ধে অবশ্যই ব্যবস্থা নেবো।’

 

নির্বিচারে রেস্টুরেন্টে অভিযান বন্ধ করতে বললেন হাইকোর্ট

রাজধানীর হোটেল ও রেস্টুরেন্টলোতে আইন অনুযায়ী অভিযান চালানোর নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। একই সঙ্গে অভিযানের নামে হয়রানি ও প্রতিবন্ধকতা তৈরি করা কেন অবৈধ নয়, তা জানতে চেয়ে রুল জারি করা হয়েছে। এ সংক্রান্ত একটি রিট আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে বিচারপতি মোস্তফা জামান ইসলাম ও বিচারপতি মোহাম্মদ আতাবুল্লাহর সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ রুলসহ এ আদেশ দেন। আগামী ১০ দিনের মধ্যে বাণিজ্য সচিব, গৃহায়ন ও গণপূর্ত সচিব, রাজউকসহ সংশ্লিষ্টদের রুলের জবাব দিতে বলেছেন আদালত।

 

গত ১১ মার্চ রাজধানীর হোটেল ও রেস্টুরেন্টগুলোতে হয়রানিমূলক অভিযান বন্ধ চেয়ে হাইকোর্টে রিট আবেদন করে বাংলাদেশ রেস্টুরেন্ট ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন কর্তৃপক্ষ। রিটের পক্ষে শুনানি করেন সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী অ্যাডভোকেট আহসানুল করিম।এ বিষয়ে জানতে চাইলে অ্যাডভোকেট আহসানুল করিম  বলেন, ‘বেইলি রোডের অগ্নিকাণ্ডের পর বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের অবহেলা ঢাকার জন্য বিভিন্ন অভিযান পরিচালনা করছিল। অভিযানে দেখা গেছে বৈধ/অবৈধ সব রেস্টুরেন্ট শাস্তির আওতায় আনা হচ্ছিল। ভালো রেস্টুরেন্টগুলো যেমনভাবে সিলগালা করা হচ্ছিল খারাপগুলোতেও হচ্ছিল। রিট আবেদনের পর কিছু সংস্থা সংযত হয়েছে।’