পবিত্র রমজান মাসেও রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় তীব্র পানি সংকট দেখা দিয়েছে। পানির দাবিতে রাস্তায় মিছিল নিয়ে নেমেছেন নাগরিকেরা। এর মধ্যে তীব্র দাবদাহ নগর জীবন আরও অতিষ্ঠ করে তুলেছে। নাগরিকদের অভিযোগ, রমজানের আগে গ্রাহকদের বাসা-বাড়িতে পানি সরবরাহ স্বাভাবিক ছিল। কিন্তু প্রথম রমজান (১৪ এপ্রিল) থেকে রাজধানীর অনেক এলাকায় পানি সংকট দেখা দিয়েছে। বিষয়টি ঢাকা ওয়াসার সংশ্লিষ্টদের জানানো হলেও কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া হয়নি। এমন অবস্থায় তীব্র গরমে পানি সংকট আরও ভোগান্তির সৃষ্টি করেছে। অবিলম্বে এই সমস্যার সমাধান চান নাগরিকরা।
রমজানে পানির চাহিদা বাড়ছে। তবে নগরের কোথাও পানি সংকট নেই। আমরা ভবিষ্যতে নাগরিকদের স্বচ্ছ পানি সরবরাহ ১০০ ভাগে নিয়ে যেতে চাই। এজন্য ঢাকা শহরকে ১৪৫টি ক্লাস্টারে (ডিস্ট্রিক্ট মিটার এরিয়া বা ডিএমএ) ভাগ করেছি। ইতোমধ্যে ৬৪টি ডিএমএর কাজ শেষ হয়েছে। বাকি ডিএমএগুলোর কাজ ২০২৩ সালের মধ্যে শেষ হবে। এরপর আর পানি সংকট এবং মান নিয়ে সমস্যা থাকবে না
তবে ওয়াসার সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের দাবি, রাজধানীতে পানি সংকট নেই। শিডিউল অনুযায়ী প্রতিটি এলাকায় পানি সরবরাহ করা হচ্ছে। তবে করোনাভাইরাস রোধে ঘোষিত লকডাউন, পবিত্র রমজান এবং দাবদাহের কারণে রাজধানীর অধিকাংশ বাসিন্দা নিজ নিজ বাসায় অবস্থান করছেন। ফলে বাসায় পানি ব্যবহার বাড়ছে, চাহিদাও বাড়ছে। তাই কিছু এলাকায় পানি সংকটের কথা শোনা যাচ্ছে। তারপরও এই সংকট লাঘবে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে।
গত ১৫ এপ্রিল পানির দাবিতে ঢাকা ওয়াসার মডস জোন-৮ এর সামনে বিক্ষোভ মিছিল করেছেন শাহজাদপুর দক্ষিণপাড়ার বাসিন্দারা। স্থানীয় বাসিন্দা মশিউর রহমানের অভিযোগ, গত ফেব্রুয়ারি থেকে ওই এলাকায় পানি সরবরাহ কমতে থাকে। এখন রমজানে এই সংকট তীব্র আকার ধারণ করেছে। পানির অভাবে ঘরের রান্না-বান্নাসহ প্রয়োজনীয় কাজ যথাসময়ে করা যাচ্ছে না। তাই এই সংকট থেকে মুক্তি পেতে তারা ওয়াসার মডস জোন-৮ এর সামনে অবস্থান নিয়েছিলেন। তাদের আন্দোলনের মুখে এখন এই এলাকায় পানির সমস্যা অনেকাংশে সমাধান হয়েছে।
শাহজাদপুর দক্ষিণপাড়া এলাকাটি ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) ১৮ নম্বর ওয়ার্ডের আওতাধীন। এই ওয়ার্ডের কাউন্সিলর জাকির হোসেন বলেন, ‘ওই এলাকার প্রধান সড়কগুলোতে পানির তেমন সংকট ছিল না। তবে গলিগুলোতে এই সমস্যা দীর্ঘদিনের। বিষয়টি নিয়ে স্থানীয়রা আন্দোলনে নামলে ওয়াসার সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলি। এখন সমস্যার কিছুটা সমাধান হয়েছে।’
জুরাইনে ওয়াসার পানি সংকট নিরসনের দাবিতে সব সময় সোচ্চার স্থানীয় বাসিন্দা মিজানুর রহমান (সাদা পাঞ্জাবি), ২০১৮ সালে ওই এলাকার পানি নিয়ে ওয়াসার কার্যালয়ে যান তিনি
জানতে চাইলে ঢাকা ওয়াসার মডস-৮ এর নির্বাহী প্রকৌশলী আব্দুল মজিদ বলেন, ‘আগে শিডিউল অনুযায়ী শাহজাদপুরে রাতে পানি দেয়া হতো। কিন্তু স্থানীয়রা দাবি করছেন দিনের বেলায় দিতে। তাদের দাবি অনুযায়ী এখন দিনের বেলায় পানি দেয়া হচ্ছে। তবে এই এলাকায় পানির কোনো সংকট নেই বলে দাবি করেন তিনি।’
পহেলা রমজান থেকে পশ্চিম শেওড়াপাড়ায়ও পানি সংকট চলছে। স্থানীয় বাসিন্দা আবদুল হান্নান বলেন, ‘আমাদের এলাকার বেশিরভাগ বাড়িতে স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় পানি আসে না। লাইন থেকে মোটর দিয়ে টেনে আনতে হয়ে। গত দুই সপ্তাহ যাবত টানলেও পানি আসে না। লাইনে পানিই থাকে না। মধ্যরাতে এক-দুই ঘণ্টা পাওয়া যায়, তাও সব সময় নয়। এমন পরিস্থিতিতে পানি নিয়ে আমরা চরম কষ্টে আছি। ভাড়াটিয়ারা প্রতিদিন এ নিয়ে অভিযোগ করেন।’
আশকোনার হাজী ক্যাম্প এলাকার চিত্রও একই। ওই এলাকায় বিভিন্ন বাসবাড়িতে দীর্ঘদিন ঘরে পানির সরবরাহ নেই। দুর্ভোগে পড়ে বিধিনিষেধের মধ্যেও অন্য এলাকা থেকে পানি সংগ্রহ করতে হচ্ছে এখানকার বাসিন্দাদের।
জানতে চাইলে স্থানীয় কাউন্সিলর মো. আনিছুর রহমান নাঈম বলেন, ‘মোল্লারটেক, প্রেমবাগান, কাউলার উত্তরপাড়াসহ বিভিন্ন এলাকায় ১৫ থেকে ২০ দিন ধরে পানি সংকট দেখা দিয়েছে। এই এলাকায় পানি সরবরাহের পাম্পটিও নষ্ট। এখন তারা পাম্প বসানোর জন্য ব্যক্তিমালিকানাধীন জমি চাইছে। এটা পাওয়া কঠিন। এলাকায় অনেক খাস জমি রয়েছে। কিন্তু তারা সেখানে পাম্প বসাবে না। এ নিয়ে খুবই যন্ত্রণার মধ্যে আছি।’
গত কয়েক মাস ধরে ঝিগাতলার হাজী আফসার উদ্দিন লেনের ভেতরের দিকে কয়েকটি ভবনে ওয়াসার পানি সরবরাহ নেই। কিন্তু মাস শেষে পানির বিল নেয় ওয়াসা। স্থানীয় বাসিন্দা জয়নাল বলেন, ‘ওয়াসার লাইনে পানি না থাকায় অনেক ভবন মালিক ডিপ কল থেকে মোটরের সাহায্যে পানি তোলেন।’
রাজধানীর জুরাইন এলাকায় দীর্ঘদিন ধরেই পানি সংকট রয়েছে। কয়েকটি এলাকায় সরবরাহ থাকলেও পানিতে ময়লা-আবর্জনা থাকে বলে জানিয়েছেন জুরাইনের ঋষিপাড়া, দারোগাবাড়ি রোড, মশারী পট্টি, কলেজ রোড, কমিশনার রোড, মিষ্টির দোকান গলির স্থানীয় বাসিন্দারা।
কমিশনার রোডের বাসিন্দা কামাল হোসেন বলেন, ‘আমার বাড়িতে পানি সংকট নেই। তবে ওয়াসার লাইন থেকে যে পানি বাসায় সরবারাহ করা হয়, তা অনেকাংশে ব্যবহার উপযোগী নয়। অনেক সময় পানির সংঙ্গে বিভিন্ন ধরনের পোকাও আসে।’পানির দাবিতে গত ১৫ এপ্রিল ঢাকা ওয়াসার মডস জোন-৮ এর সামনে বিক্ষোভ করেন শাহজাদপুর দক্ষিণপাড়ার বাসিন্দারা
জুরাইনে ওয়াসার পানি সংকট নিরসনের দাবিতে সব সময় সোচ্চার থাকেন স্থানীয় বাসিন্দা মিজানুর রহমান। ২০১৮ সালে ওই এলাকার পানি নিয়ে ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) তাকসিম এ খানকে শরবত খাওয়াতে চেয়েছিলেন তিনি। তখন এ নিয়ে ব্যাপক আলোচনার সৃষ্টি হয়েছিল।
জানতে চাইলে মিজানুর রহমান বলেন, ‘ওয়াসা সব সময় দাবি করে, তাদের সরবরাহ করা পানি পান এবং ব্যবহার যোগ্য। কিন্তু বাস্তবতা সম্পূর্ণ ভিন্ন। জুরাইনের অনেক এলাকায় ওয়াসার পানি দিয়ে হাত-মুখও ধোয়া যায় না। এই পানি দিয়ে গোসল করলে শরীর থেকেও দুর্গন্ধ আসে। এই সমস্যা সমাধানে অনেক আন্দোলন করলেও ওয়াসা ব্যবহার বা পান যোগ্য পানি সরবরাহ করছে না।’
তিনি বলেন, ‘জুরাইনের প্রতিটি মসজিদ-মাদরাসায় গভীর নলকূপ বসানো রয়েছে। এলাকার মানুষ এসব ধর্মীয় স্থাপনা থেকে খাবার পানি সংগ্রহ করেন। জুরাইনের আশপাশের এলাকা তথা শ্যামপুর, কদমতলী যাত্রাবাড়ী এলাকায় একই চিত্র।’
যাত্রাবাড়ীর উত্তর মাতুয়াইল এলাকায়ও পানি নিয়ে হাহাকার চলছে। দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে অন্য জায়গা থেকে পানি সংগ্রহ করতে দেখা গেছে বাসিন্দাদের। এলাকাবাসী জানিয়েছেন, দীর্ঘদিন ওয়াসাকে জানিয়েও কাজ হয়নি। একই অবস্থা শনির আখড়া, জিয়া সরণিসহ আশপাশের এলাকায়ও। এসব এলাকায় পানি সহজে আসে না।
পানির এ সংকটের বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) তাকসিম এ খান বলেন, ‘রমজানে পানির চাহিদা বাড়ছে। তবে নগরের কোথাও পানি সংকট নেই। আমরা ভবিষ্যতে নাগরিকদের স্বচ্ছ পানি সরবরাহ ১০০ ভাগে নিয়ে যেতে চাই। এজন্য ঢাকা শহরকে ১৪৫টি ক্লাস্টারে (ডিস্ট্রিক্ট মিটার এরিয়া বা ডিএমএ) ভাগ করেছি। ইতোমধ্যে ৬৪টি ডিএমএর কাজ শেষ হয়েছে। বাকি ডিএমএগুলো কাজ ২০২৩ সালের মধ্যে শেষ হবে। এরপর আর পানি সংকট এবং মান নিয়ে সমস্যা থাকবে না।’