হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরসহ তিন বিমানবন্দরের উন্নয়ন প্রকল্পের ৮১২ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে সাবেক প্রধানমন্ত্রীর সামরিক উপদেষ্টা তারিক আহমেদ সিদ্দিক, বেসামরিক বিমান ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের সাবেক সিনিয়র সচিব মহিবুল হক এবং বাংলাদেশ বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের (বেবিচক) সাবেক চেয়ারম্যান এম মফিদুর রহমানসহ ১৯ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে চারটি মামলা করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।সোমবার (২৭ জানুয়ারি) দুদকের মহাপরিচালক (প্রতিরোধ) মো. আক্তার হোসেন মামলার বিষয়টি নিশ্চিত করেন।প্রথম মামলায় ২৫০ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে মোট ১০ জনকে আসামি করা হয়েছে। আসামিরা হলেন- সাবেক প্রধানমন্ত্রীর সামরিক উপদেষ্টা তারিক আহমেদ সিদ্দিক, সাবেক সিনিয়র সচিব মুহিবুল হক, বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের সাবেক যুগ্ম সচিব জনেন্দ্রনাথ সরকার, বেবিচকের সাবেক চেয়ারম্যান এম মফিদুর রহমান, সাবেক প্রধান প্রকৌশলী মো. আব্দুল মালেক, সুপারিনটেনডেন্ট ইঞ্জিনিয়ার মো. হাবিবুর রহমান, অ্যারনেস ইন্টারন্যাশনালের মালিক লুৎফুল্লাহ মাজেদ, এমডি মাহবুব আনাম, হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমান বন্দর সম্প্রসারণ (থার্ড টার্মিনাল) প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক এ কে এম মাকসুদুল ইসলাম ও সাবেক প্রধান প্রকৌশলী সুধেন্দু বিকাশ গোস্বামী।
মামলার এজাহার সূত্রে জানা যায়, বিমান বন্দর সম্প্রসারণ (থার্ড টার্মিনাল) প্রকল্পের কাজের কার্যাদেশ দেওয়া হয় এভিয়েশন ঢাকা কনসোর্টিয়াম (এডিসি) নামীয় একটি প্রতিষ্ঠানকে। উক্ত কাজের সঙ্গেও সাব কন্ট্রাক্টর হিসেবে অভিযোগ সংশ্লিষ্ট অ্যারনেস ইন্টারন্যাশনাল লিমিটিডেকে সম্পৃক্ত করা হয়। অনুসন্ধানকালে ১৩ হাজার কোটি টাকার প্রাক্কলন প্রকল্পে অর্থের পরিমাণ বৃদ্ধি করে ২১ হাজার কোটি টাকা করা হয়। এ প্রকল্প থেকে ক্রয় সংক্রান্ত বিধি-বিধান লঙ্ঘন করে ১২টি বোর্ডিং ব্রিজের কাজসহ বিভিন্ন কাজে নিজেদের পছন্দের ঠিকাদারকে কার্যাদেশ প্রদান করে বেআইনিভাবে স্থানীয় এজেন্ট অ্যারনেস ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেডকে উক্ত কাজে সম্পৃক্ত করে পরস্পর যোগসাজশে প্রকল্প থেকে প্রায় ২৫০ কোটি টাকা আত্মসাৎ করার অভিযোগ আনা হয়েছে আসামিদের বিরুদ্ধে।দ্বিতীয় মামলায় ২০০ কোটি টাকা আত্মসাতে সাবেক প্রধানমন্ত্রীর সামরিক উপদেষ্টা তারিক আহমেদ সিদ্দিক, সাবেক সিনিয়র সচিব মুহিবুল হক, বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের সাবেক যুগ্ম সচিব জনেন্দ্রনাথ সরকার, বাংলাদেশ বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের (বেবিচক) চেয়ারম্যান এম মফিদুর রহমান, সাবেক প্রধান প্রকৌশলী মো. আব্দুল মালেক, সুপারিনটেনডেন্ট ইঞ্জিনিয়ার মো. হাবিবুর রহমান, সিএনএস মেইনটেন্যান্স বিভাগের পরিচালক আফরোজা নাসরিন সুলতানা, পরিচালক (পরিকল্পনা) এ কে এম মনজুর আহমেদ, অ্যারনেস ইন্টারন্যাশনালের মালিক লুৎফুল্লাহ মাজেদ ও এমডি মাহবুব আনামকে আসামি করা হয়েছে।মোট ১০ জনকে আসামি করে দায়ের করা মামলার এজাহার সূত্রে জানা যায়, হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরের `Installation of RADAR with CNS – ATM (Communication, Navigation and Surveillance - Air Traffic Management' শিরোনামে রাডার নির্মাণকাজে অ্যারনেস ইন্টারন্যাশনালকে সম্পৃক্ত করা হয়। প্রকল্পের কাজে সর্বশেষ হিসাব অনুসারে ব্যয় করা হয়েছে ৭৩০ কোটি টাকা, যা বেবিচকের নিজস্ব তহবিল থেকে ব্যয় করা হয়। যার মধ্যে পছন্দের ঠিকাদারকে কার্যাদেশ প্রদান করে বেআইনিভাবে স্থানীয় এজেন্ট অ্যারনেস ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেডকে ব্যবহার করে ওই প্রকল্প থেকে প্রায় ২০০ কোটি টাকা আত্মসাৎ করেন করেছেন আসামিরা।তৃতীয় মামলায় কক্সবাজার আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের টার্মিনাল ও রানওয়ে নির্মাণকাজে ১৫০ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ আনা হয়েছে। যেখানে আসামি করা হয়েছে ১০ জনকে। তারা হলেন- সাবেক প্রধানমন্ত্রীর সামরিক উপদেষ্টা তারিক আহমেদ সিদ্দিক, সাবেক সিনিয়র সচিব মুহিবুল হক, বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের সাবেক যুগ্ম সচিব জনেন্দ্রনাথ সরকার, বেবিচক চেয়ারম্যান এম মফিদুর রহমান, সাবেক প্রধান প্রকৌশলী মো. আব্দুল মালেক, সুপারিনটেনডেন্ট ইঞ্জিনিয়ার মো. হাবিবুর রহমান, অ্যারনেস ইন্টারন্যাশনালের মালিক লুৎফুল্লাহ মাজেদ, এমডি মাহবুব আনাম, বেসামরিক বিমান ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের সাবেক উপসচিব মো. শফিকুল ইসলাম এবং কক্সবাজার বিমানবন্দর উন্নয়ন (প্রথম পর্যায়-৪র্থ সংশোধিত) প্রকল্পের নির্বাহী প্রকৌশলী ও প্রকল্প পরিচালক মো. ইউনুস ভূইয়া।
এজাহার সূত্রে জানা যায়, কক্সবাজার আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের টার্মিনাল ও রানওয়ে নির্মাণ সংক্রান্ত প্রকল্পের কাজে ১ হাজার ৫০০ কোটি টাকার অনিয়ম ও দুর্নীতি হয়েছে বলে তথ্য পাওয়া যায়। এক্ষেত্রে চায়না সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং কনস্ট্রাকশন কর্পোরেশন (সিসিইসিসি) নামীয় একটি চায়না কোম্পানিকে প্রকল্পের কাজে কার্যাদেশ প্রদানের ক্ষেত্রে তারিক আহমেদ সিদ্দিকসহ অন্যান্যরা প্রত্যক্ষ সহযোগিতা করেন। ওই প্রকল্পের কাজে প্রচলিত ক্রয় প্রক্রিয়ার বিদ্যমান বিধান লঙ্ঘন কর অর্থছাড়করণ সংক্রান্ত বিধান ও অনুমোদন প্রক্রিয়ার ব্যত্যয় ঘটানো হয়েছে। নিজেদের পছন্দের ঠিকাদারকে কার্যাদেশ প্রদান করে বেআইনিভাবে স্থানীয় এজেন্ট অ্যারনেস ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেডের সঙ্গে যোগসাজশে প্রকল্প হতে প্রায় ১৫০ কোটি টাকা লুটপাট হয়েছে।
চতুর্থ মামলায় সিলেট ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের দুই হাজার কোটি টাকার নতুন টার্মিনাল নির্মাণ প্রকল্পের কাজ না করে অগ্রিম বিল হিসেবে ২১২ কোটি টাকা ছাড় করার অভিযোগে ১১ জনের বিরুদ্ধে মামলা করেছে দুদক। মামলায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সামরিক উপদেষ্টা তারিক আহমেদ সিদ্দিকী ও বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের সাবেক সিনিয়র সচিব মো. মুহিবুল হকসহ অন্যান্যদের আসামি করা হয়েছে।
এছাড়া বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের সাবেক যুগ্ম সচিব জনেন্দ্রনাথ সরকার, বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের (বেবিচক) সাবেক চেয়ারম্যান এম মফিদুর রহমান, বেবিচকের সাবেক প্রধান প্রকৌশলী মো. আব্দুল মালেক, সুপারিনটেনডেন্ট ইঞ্জিনিয়ার মো. হাবিবুর রহমান আসামি করা হয়েছে।অন্যদিকে, ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান অ্যারনেস ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাহবুবুল আনাম, পরিচালক লুৎফুল্লাহ মাজেদ, প্রকল্প পরিচালক মইদুর রহমান মো. মওদুদ, বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের সাবেক উপসচিব শাহ জুলফিকার হায়দার (বর্তমানে উপ সচিব, প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়) এবং সাবেক যুগ্মসচিব মো. আনিছুর রহমানকে (বর্তমানে অতিরিক্ত সচিব) আসামি করা হয়েছে।এজাহারে বলা হয়, আসামিদের পরস্পর যোগসাজশে প্রকল্পের কাজে প্রচলিত ক্রয় প্রক্রিয়ার বিদ্যমান বিধান লঙ্ঘন করে প্রকল্পের ব্যয় বৃদ্ধি করা হয়। এছাড়া সংশ্লিষ্ট প্রশাসনিক মন্ত্রণালয়ের আর্থিক ও প্রশাসনিক এখতিয়ার লঙ্ঘন পূর্বক ব্যয় বৃদ্ধি, ব্যয়মঞ্জুরি, পরিদর্শন, অর্থ ছাড়করণ সংক্রান্ত বিধান ও অনুমোদন প্রক্রিয়ার ব্যত্যয় ঘটিয়ে অবৈধ সুবিধা দেওয়া ও নেওয়া হয়েছে। আইন, চুক্তি ও প্রচলিত বিধি-বিধান লঙ্ঘন করে পরস্পর যোগসাজশে অ্যারনেস ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেডকে সম্পৃক্ত করে প্রকল্পের কাজে ২১২ কোটি টাকা অগ্রিম বিল নেওয়া হয়। অগ্রিম বিল নেওয়ার পর অ্যারনেস ইন্টারন্যাশনাল কাজ বন্ধ করে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানটির দায়িত্বশীলরা আত্মগোপনে রয়েছেন বলেও এজাহারে বলা হয়।
আসামিদের বিরুদ্ধে দণ্ডবিধি, ১৮৬০ এর ১২০/১৬১/১৬৩/১৬৪/৪০৯/৪২০/১০৯ ধারা, দুর্নীতি প্রতিরোধ আইন, ১৯৪৭ এর ৫(২) ধারায় অভিযোগ আনা হয়েছে।