কারাবন্দি অবস্থায় হাতে স্মার্ট ফোন। ব্যবহার করছে ইন্টারনেট। ইচ্ছেমতো যোগাযোগ করছে বাইরে। ডাকাতি করা অর্থের ভাগ আসছে যথাসময়ে। এমনকি মধু ও খেজুরসহ বিভিন্ন পণ্য ভেতরে নিয়ে রীতিমতো ব্যবসাও করছে কারাবন্দি শীর্ষ জঙ্গি নেতারা। আর এসব হচ্ছে দেশের সবচেয়ে হাইসিকিউরিটি জেল কাশিমপুরে। কারাবন্দি শীর্ষ জঙ্গিদের এই বেআইনি সুবিধা দিচ্ছেন খোদ একশ্রেণির অসাধু কারারক্ষী।সোমবার (২৯ মার্চ) রাজধানীর পূর্ব তেজতরী বাজার এলাকা থেকে দুই জঙ্গিকে গ্রেফতারের পর চাঞ্চল্যকর এমন তথ্য পেয়েছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের তেজগাঁও জোনাল টিম। আসিফুর রহমান আসিফ (২৬) ও পিয়াস শেখ (২৮) নামে এই দুই জঙ্গিকে গ্রেফতারের পর মঙ্গলবার (৩০ মার্চ) রিমান্ডে আনা হয়। এর আগে সোমবার রাতে ডিবির পরিদর্শক মাহবুবুর রহমান বাদী হয়ে তাদের বিরুদ্ধে তেজগাঁও থানায় সন্ত্রাসবিরোধী আইনে একটি মামলা (নং ৭০) দায়ের করেন।
ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের তেজগাঁও জোনাল টিমের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার শাহাদাত হোসেন সুমা জানান, গ্রেফতার দুই জঙ্গির কাছ থেকে চাঞ্চল্যকর কিছু তথ্য পাওয়া গেছে। এসব তথ্য যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে। এছাড়া আরও তথ্য জানতে তাদের রিমান্ডে এনে জিজ্ঞাসাবাদের প্রস্তুতি চলছে।
মামলার এজাহার সূত্রে জানা গেছে, গোপন সংবাদের ভিত্তিতে সোমবার (২৯ মার্চ) সন্ধ্যায় রাজধানীর পূর্ব তেজতরী বাজার এলাকায় অভিযান চালিয়ে আসিফ ও পিয়াসকে গ্রেফতার করা হয়। তাদের কাছ থেকে দুই রাউন্ড গুলিসহ একটি পিস্তল, কয়েকটি মোবাইল ও ৩৫ হাজার টাকা উদ্ধার করা হয়েছে। মামলার এজাহারে বলা হয়েছে, গ্রেফতার আসিফ ও পিয়াস জেএমবির সক্রিয় সদস্য। কাশিমপুর হাইসিকিউরিটি জেলে বন্দি জেএমবির পৃষ্ঠপোষক ও শীর্ষ নেতা আবু সাঈদ, আব্দুল্লাহ আল তাসনিম, আল-আমিন ও ফয়সালের সঙ্গে নিয়মিত মোবাইলে যোগাযোগ করতো তারা। শীর্ষ এই জঙ্গি নেতাদের নির্দেশে জেএমবির সক্রিয় সদস্য আনোয়ার আলী ওরফে হৃদয়, হাফিজুল শেখ ওরফে সকাল, আবু সালেহ, সোহেলসহ অজ্ঞাতনামা জঙ্গিরা ঢাকাসহ সারা দেশের বিভিন্ন স্থানে ডাকাতি ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে অর্থ সংগ্রহ করে। এই অর্থের একটি অংশ জেলখানায় কর্তব্যরত কতিপয় সদস্যদের মাধ্যমে কারাবন্দি শীর্ষ নেতাদের কাছে পাঠাতো। অবশিষ্ট টাকা হৃদয়, তানজিল বাবু ও সকালের মাধ্যমে দেশের বিভিন্ন স্থানে অবস্থানরত সংগঠনের নেতাকর্মী ও জেলে থাকা বন্দিদের পরিবারের কাছে পাঠাতো।
গ্রেফতার আসিফুর রহমান আসিফ
গোয়েন্দা পুলিশের কর্মকর্তারা জানান, আসিফের কাছে দুটি টাকার বান্ডিল পাওয়া গেছে। ২০ হাজার টাকার একটি বান্ডিলের ওপরে নাহিদ তাসনিম, কাশিমপুর এবং ১৫ হাজার টাকার একটি বান্ডিলের ওপরে আল-আমিন, কাশিমপুর লেখা রয়েছে। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে আসিফ জানিয়েছে, এসব অর্থ ডাকাতি করা। এই টাকা কাশিমপুর জেলখানায় কর্তব্যরত একজন কারারক্ষীর মাধ্যমে ভেতরে নাহিদ তাসনিম ও আল-আমিনের কাছে পাঠানোর কথা ছিল। এর আগেও ডাকাতি করা অর্থ তারা একাধিক কারারক্ষীর মাধ্যমে কারাগারের ভেতরে পাঠিয়েছে।
জানতে চাইলে কাশিমপুর হাইসিকিউরিটি কারাগারের সিনিয়র জেল সুপার গিয়াস উদ্দিন বলেন, ‘এ বিষয়ে আমরা আনুষ্ঠানিকভাবে কিছু জানি না। ফলে এ বিষয়ে কোনও মন্তব্য করা সমীচীন হবে না। আনুষ্ঠানিকভাবে জানতে পারলে বিষয়টি খতিয়ে দেখা হবে।’ কারাগারে জঙ্গিরা কেউ মোবাইল ফোন ব্যবহার করে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘জঙ্গিরা শুধু নয়, সাধারণ কোনও বন্দিরও মোবাইল ফোন ব্যবহার বা বিধিবহির্ভূত কিছু করার সুযোগ নেই।’
গোয়েন্দা কর্মকর্তারা জানান, জিজ্ঞাসাবাদে আসিফ জানিয়েছে, সংগঠনের কারাবন্দি শীর্ষ নেতাদের নির্দেশে ডাকাতি করা অর্থ দিয়ে তারা ‘হালাল অ্যান্ড ফ্রেশ’ নামে একটি খাদ্যপণ্য সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছিল। কারাগার থেকে তাসনিম, সাঈদ, ফয়সাল ও আল-আমিন তাকে বিভিন্ন লোকজনের নম্বর দিতো। সেখানে সে চাহিদা মতো মধু ও খেজুরসহ বিভিন্ন পণ্য দিয়ে আসতো। শীর্ষ নেতাদের নির্দেশ মতো একাধিকবার সে কাশিমপুর কারাগারেও খেজুর ও মধু সরবরাহ করেছে।
দীর্ঘদিন জঙ্গি প্রতিরোধ নিয়ে কাজ করে আসা কাউন্টার টেরোরিজমের একজন কর্মকর্তা জানান, তাদের কাছে আগে থেকেই তথ্য ছিল যে কাশিমপুর কারাগারে তাসনিম, সাঈদরা রীতিমতো বাণিজ্য করে অর্থ সংগ্রহ করছে। কারাবন্দিদের কাছে এবং তাদের পরিবারের কাছে তাসনিম মধু বিক্রি করতো। আসিফের গ্রেফতারের পর আগে থেকে পাওয়া তথ্যের সত্যতা পেয়েছেন তারা।
জঙ্গিবাদ প্রতিরোধে গঠিত বিশেষায়িত ইউনিট কাউন্টার টেরোরিজমের একজন কর্মকর্তা জানান, কাশিমপুর হাইসিকিউরিটি কারাগার থেকে যারা ডাকাতির নির্দেশনা দিয়েছে, তারা শীর্ষ জঙ্গি নেতা। এরমধ্যে আবু সাঈদ ২০০৫ সালে সারা দেশে সিরিজ বোমা হামলা মামলার মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি। সে ২০০৭ সালে ভারতে পালিয়ে গিয়ে নদীয়া, বীরভূম ও বর্ধমান জেলার জেএমবির কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব পালন করে। ২০১৪ সালে বর্ধমানের খাগড়াগড় বিস্ফোরণে তার সম্পৃক্ততা পাওয়ায় কলকাতা পুলিশের ন্যাশনাল ইনভেস্টিগেশন এজেন্সি (এনআইএ) তাকে ধরতে ১০ লাখ রুপি পুরস্কার ঘোষণা করে। ২০১৫ সালে আবু সাঈদ দেশে ফিরে এলে দুই বছরের মাথায় ২০১৭ সালের ২৯ ডিসেম্বর বগুড়া জেলা পুলিশ তাকে গ্রেফতার করে।
ওই কর্মকর্তা জানান, কারাবন্দি আব্দুল্লাহ আল তাসনিম ওরফে নাহিদও পুরনো জেএমবির শীর্ষ পর্যায়ের নেতা। ২০১০ সালে জেএমবির আমির মাওলানা সাইদুর রহমান গ্রেফতার হওয়ার পর ভারপ্রাপ্ত আমিরের দায়িত্ব পালন করে তাসনিম। ২০১৪ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের হাতে তাসনিম গ্রেফতার হয়। আবু সাঈদ ও তাসনিম ছাড়াও বাকি দুই শীর্ষ জঙ্গি নেতার একজন আল-আমিন আনসার আল ইসলামের নেতা ও ফয়সাল হরকাতুল জিহাদ নেতা। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে বিভিন্ন সময়ে গ্রেফতার হওয়ার পর থেকে তারা কারাগারে রয়েছে।
গ্রেফতার পিয়াস শেখ
কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটের কর্মকর্তারা বলছেন, সাধারণ অপরাধীদের মতোই কারাবন্দি শীর্ষ জঙ্গি নেতারা কতিপয় অসাধু কারারক্ষী সদস্যদের ম্যানেজ করে বা অর্থের বিনিময়ে ভেতর থেকে বাইরে যোগাযোগ করে। কাগজে লিখে বার্তা পাঠানোর পাশাপাশি অনেকেই মোবাইল ফোনও ব্যবহার করে। কাশিমপুর ছাড়াও ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারসহ অন্যান্য কারাগারে থাকা জঙ্গিরাও এই সুযোগ নিয়েছে। এমনকি মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হওয়ার আগে কারাগারে থাকা হরকাতুল জিহাদের শীর্ষ নেতা মুফতি আব্দুল হান্নান কারাগারে বসেই মোবাইল ফোন ও ইন্টারনেট ব্যবহার করতো। প্রিজন ভ্যান থেকে তাকে ছিনিয়ে নেওয়ার পরিকল্পনা ও সহযোগীদের সঙ্গে যোগাযোগ করে তা বাস্তবায়ন করার চেষ্টাও করেছিল সে।
নিরাপত্তা বিশ্লেষক অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এম. সাখাওয়াত হোসেন বলেন, ‘এই দেশের রন্ধ্রে রন্ধ্রে দুর্নীতি ঢুকে গেছে। বড় থেকে ছোট সবাই দুর্নীতিগ্রস্ত। আর কারাগারের বিষয়ে আমরা আগেও অনেক দুর্নীতি ও অনিয়মের কথা শুনেছি। কিন্তু হাইসিকিউরিটি জেলে শীর্ষ জঙ্গিরা যদি এমন সুবিধা পায়, তবে তা ভয়ানক আতঙ্কের বিষয়। আমি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হলে তো আইজি প্রিজন্সকে স্যাকড করতাম। এখন হয়তো কয়েকজন সিপাহীকে ধরা হবে। কিন্তু এর দায় তো ঊর্ধ্বতনদের। কীভাবে এটা সম্ভব? কেন আমরা একটা যথাযথ হাইসিকিউরিটি জেল তৈরি করতে পারছি না? যেখানে স্পেশাল ফোর্স থাকবে, কারাবন্দি শীর্ষ জঙ্গিরা আইসোলেশনে থাকবে। এই প্রশ্ন আমি কার কাছে করবো?’
জঙ্গি প্রতিরোধ নিয়ে কাজ করে আসা এই নিরাপত্তা বিশ্লেষক বলেন, ‘রাষ্ট্র তো সাধারণ নাগরিকের ফোন ইন্টারসেপ্ট করে, আর কারাগারে থাকা টেরোরিস্টরা সবকিছু করছে। এটা যে বড় একটা থ্রেট, এটা কি রাষ্ট্র বুঝতে পারছে না? আমি মনে করি, আমাদের কারাগারগুলো ব্যাপক সংস্কার করা উচিত।’সার্বিক বিষয়ে বক্তব্য জানতে একাধিকবার মোবাইল ফোনে কল ও এসএমএস পাঠানো হলেও কারা মহাপরিদর্শক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোমিনুর রহমান মামুনের সঙ্গে এ বিষয়ে কথা বলা সম্ভব হয়নি।