ঢাকা: স্বাধীনতার ৫০ বছরে বাংলাদেশে যা কিছু বড় অর্জন তা বিএনপি ক্ষমতায় থাকার সময়ই অর্জিত হয়েছে বলে দাবি করেছেন দলের নেতারা। তারা বলছেন, দেশ স্বাধীন হওয়ার ৫০ বছর পালন করছি আমরা।এর মধ্যে বিএনপির সময়ে যা অর্জিত হয়, আর কোনো সরকার তা করতে পারেনি। তাদের ভাষায়, বর্তমানে দেশে গণতন্ত্র নেই, আইনের শাসন নেই, স্বাধীনতার মূলমন্ত্র আজ ভূলুণ্ঠিত। বর্তমান সরকার মানুষের অধিকার কেড়ে নিয়ে একদলীয় শাসনের দিকে যাচ্ছে। আর সরকার যে সুবর্ণজয়ন্তী পালন করছে, তাতে জনগণের অংশগ্রহণ নেই বলে মনে করে বিএনপি।
জানতে চাইলে দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, যুদ্ধের সময় মানুষের যে আশা-আকাঙ্খা ছিল, দুর্ভাগ্যজনকভাবে তা এখনও পূরণ হয়নি। ৫০ বছর গণতান্ত্রিক অধিকার, বাক স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠার জন্যই আমাদের লড়াই করতে হয়েছে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে আমরা সেই গণতন্ত্র, বাক স্বাধীনতা পাইনি। আজকে সরকার মানুষের অধিকারগুলো কেড়ে নিয়ে, রাষ্ট্রযন্ত্রের মাধ্যমে জোর করে ক্ষমতায় টিকে আছে। তাদের উদ্দেশ্য একটাই, তা হলো-একদলীয় শাসন প্রতিষ্ঠা করা।
৫০ বছরের মধ্যে বিএনপি প্রায় সাড়ে ১৬ বছর ক্ষমতায় ছিল তখনকার মূল্যায়ন কিভাবে করবেন? জবাবে তিনি বলেন, ওই সময় আমরা গণতন্ত্র ফিরিয়ে এনেছি। আমাদের নেতা জিয়াউর রহমান বাকশাল থেকে বহুদলীয় গণতন্ত্র নিয়ে এসেছিলেন। পরবর্তীকালে দেশনেত্রী খালেদা জিয়া সংসদীয় গণতন্ত্র চালু করেছিলেন। বহুদলীয় গণতন্ত্রের সঙ্গে সঙ্গে মুক্ত বাজার অর্থনীতিও চালু করেছিলেন জিয়াউর রহমান। সুতরাং এগুলোই ছিল ৫০ বছরে দেশের সবচেয়ে বড় অর্জন।
খালেদা জিয়ার কারাবন্দিত্বের বিষয়ে মির্জা ফখরুল বলেন, ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর হাতে খালেদা জিয়া গ্রেফতার হয়েছিলেন। আজকে ৫০ বছর পরেও গণতন্ত্রের জন্যে তাকে আবার কারাগারে থাকতে হচ্ছে, বন্দি অবস্থায় থাকতে হচ্ছে। তাহলে পাকিস্তানিদের সাথে এই সরকারের পার্থক্যটা কোথায়? যে সরকারের জনগণের সঙ্গে কোনো সম্পর্ক নেই, সেই সরকার মিথ্যা মামলা দিয়ে খালেদা জিয়াকে কারাবন্দি রেখেছে। তারা জোর করে ক্ষমতা দখল করে আছে। এটাকে পরিবর্তন করার জন্য আমরা চেষ্টা করছি। ইনশাল্লাহ আমরা জয়ী হবো।
স্বাধীনতার ৫০ বছর নিয়ে ভাবনার কথা জানতে চাইলে দলটির জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, মুক্তিযুদ্ধের আকাঙ্ক্ষা ও স্বাধীনতার স্বপ্ন বাংলাদেশে পূর্ণাঙ্গভাবে বাস্তবায়িত হয়নি। আকাঙ্ক্ষার মূল ছিল গণতন্ত্র। আজকে দেশে গণতন্ত্র নেই, আইনের শাসন নেই, সুশাসন নেই। সেজন্য দেশে হত্যা গুম, বিচারবহির্ভূত হত্যা, খুন, রাহাজানি, দুর্নীতি, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজিসহ যত ধরনের অপকর্ম আছে তার একটা মহোৎসব চলছে। জাতি আজকে অধিকারহারা। যে দেশ জনগণের, সেই জনগণের মালিকানা জনগণের কাছে নেই।
তিনি বলেন, গত ৫০ বছরে দেশে যদি পূর্ণাঙ্গ গণতন্ত্র অবিরামভাবে চর্চা হতো, যদি গণতান্ত্রিক সকল বিধিব্যবস্থা পরিচালিত করতে পারতাম, তাহলে অর্থনৈতিক ও সামাজিকভাবে আমাদের দেশ আরও অনেক এগিয়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু জনগণের অংশগ্রহণ, গণতন্ত্রের অনুপস্থিতিতে ৫০ বছরে যে পরিমাণ প্রত্যাশা আমাদের ছিল, সেটা পূরণ হয়নি। কোথায় কোথায় আমাদের ত্রুটি হয়েছে সেগুলোকে মূল্যায়ন করে এই বাংলাদেশকে গণতান্ত্রিকভাবে পরিচালনা করা এবং অর্থনৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক সাম্য প্রতিষ্ঠার যে অঙ্গীকার ছিল, সে অঙ্গীকার বাস্তবায়ন করা এখন ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে আমাদের দায়িত্ব। ৫০ বছর পূর্তিতে এটাই হোক আমাদের প্রতিজ্ঞা।
তিনি বলেন, বাকশালের মাধ্যমে এদেশের গণতন্ত্র হারিয়ে গিয়েছিল। জিয়াউর রহমান এসে বহুদলীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। আবার দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া স্বৈরাচার এরশাদের কাছ থেকে দেশকে মুক্ত করে সংসদীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। অতএব যেখানে আওয়ামী লীগ গণতন্ত্র হত্যা করেছে, আমরা সেটা পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেছি। জিয়াউর রহমান সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি থেকে মুক্তবাজার অর্থনীতির পথ সৃষ্টি করেছেন। তিনি থাকাকালে প্রথম বিদেশে জনশক্তি রপ্তানি শুরু করেছিলেন। সেই জনশক্তি আজকে আমাদের অর্থনীতির মূল স্তম্ভ। জিয়াউর রহমানের সময় এদেশে প্রথম গার্মেন্ট কারখানা প্রতিষ্ঠা হয়। ইয়াং এন্টারপ্রেনারদের ধরে ধরে এনে জামানত ছাড়া ব্যাংকের লোন দিয়ে গার্মেন্ট ব্যবসা শুরু করেন। সেই গার্মেন্ট এখন বাংলাদেশের প্রধান বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনকারী খাত।
বিএনপির বর্ষিয়ান এই নেতা বলেন, জিয়াউর রহমান এদেশে স্বাধীনতা পুরষ্কার প্রচলন করেছেন, একুশে পদক প্রচলন করেছেন। বেগম খালেদা জিয়া মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রণালয় করেছেন, সংসদীয় গণতন্ত্র চালু করেছেন। কোনো প্রশ্ন ছাড়া সংসদ নির্বাচন যাতে সব সময় নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু হয় তার জন্য সংবিধানের মধ্যে তিনি তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রথা সন্নিবেশিত করেছিলেন। আর সেটাকে আওয়ামী লীগ বাতিল করে নির্বাচন ব্যবস্থাকে সম্পূর্ণ ধ্বংস করে দিয়েছে। অবশ্যই গত ৫০বছরে বাংলাদেশে যা কিছু ইতিবাচক হয়েছে বিএনপির সময় হয়েছে। আমি কয়েকটি মাত্র উদাহরণ দিলাম।
স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলেন, স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী নিয়ে আর কি ভাবনা আছে, ঘরে বসে থাকবো। ৫০বছর পরে স্বাধীনতা দিবস পালন করতে পারবো না। তারা সব পারবে, আমরা পারবো না এটা কোনো কথা হয় না। ওনারা (সরকার) দেশ বিদেশের অতিথি নিয়ে লাফালাফি করবেন, জন্মদিন পালন করবেন, আর দেশের মানুষ স্বাধীনতা দিবসে কিছু করতে পারবে না, এটা কোনো কথা হলো?
করোনার কারণে বিএনপির সুবর্ণজয়ন্তীর অনুষ্ঠান স্থগিত করেছে এমন বক্তব্যের জবাবে গয়েশ্বর চন্দ্র বলেন, না করোনার কারণ কি, আমাদেরতো করতেই দেবে না। গানের উদ্ধৃতি দিয়ে তিনি বলেন, সাত সাগর পাড়ি দিয়ে মনে হয় সৈকতেই পড়ে আছি।
তাহলে স্বাধীনতার ৫০ বছরে আমাদের কোনো অর্জন নেই? জবাবে তিনি বলেন, অর্জন যা আছে সেটাতো আছেই। কিন্তু মৌলিক বিষয়েতো আমাদের অধঃপতন হয়েছে। গাড়ি হয়েছে, বাড়ি হয়েছে, ঢাকা শহরে উঁচু ভবন হয়েছে। রাস্তাঘাট হয়েছে। একটা স্বাধীন দেশে এটাইতো একমাত্র অর্জন না। পরিপূর্ণ জাতি হিসেবে যে সম্মান, তাতো নেই। এ জাতি বোবা হয়ে গেছে। এ জাতি কথা বলতে পারে না। যে গণতন্ত্রের জন্য স্বাধীনতার লড়াই করা হয়েছে সে গণতন্ত্র এখন নেই।
তিনি বলেন, মানুষের ভালো কাপড় পরা, বাড়ি-ঘর করা এটা একটা অংশ। এটা যে অগ্রগতির মধ্যে পড়ে না তা আমি বলছি না। কিন্তু এটাই একমাত্র বিষয় না। আপনি একটা সংসারে সব পর্যাপ্ত দিলেও কাউকে ভালবাসা দিচ্ছেন না, কারও মতামত গ্রাহ্য করছেন না। আপনি যা খুশি করছেন, কিন্তু পেট ভরে খাওয়াচ্ছেন। আপনার ওপর নির্ভরশীল লোকগুলো কি খাওয়ার ওপর সন্তুষ্ট? এর বাইরেও তার একটা চাওয়া পাওয়া আছে না? সুতরাং জাতিরতো একটা চাওয়া পাওয়া আছে।
বিএনপির এই নেতা বলেন, আপনি মানুষের টাকা দিয়েইতো উন্নয়ন করছেন। সেই উন্নয়নের নামে দুর্নীতি করবেন, চুরি করবেন, বিদেশে পাচার করবেন, এটাতো মানুষ চায় না। উন্নয়নের জন্য সরকারেরতো আলাদা কোনো খাত নেই। জনগণের কাছ থেকে আদায় করা টাকাইতো রাষ্ট্রীয় তহবিল। সেই রাষ্ট্রীয় তহবিল দিয়ে রাস্তা বানিয়েতো আপনি জনগণকে দয়া করছেন না। এটাতো আপনার দায়িত্ব। উন্নয়ন কাজ একটি চলমান প্রক্রিয়া, যা সরকারের দায়িত্ব। স্বাধীনতার পর ৭২ সালে প্রথম বাজেট ছিল ৭৫০ কোটি টাকার। তখন আমাদের রাজস্ব আয় দিয়ে ওই বাজেট ছিল। এখন আয় বাড়বে, ব্যয় বাড়বে। পাশাপাশি অপচয় বাড়লেতো হবে না। বালতি ছিদ্র করে যদি পানি ঢালেন তাহলে তো বালতিতে পানি থাকবে না। আমাদের বর্তমান উন্নয়ন কাজ হলো সেরকম, গাড়ি চলার আগেই ভেঙে পড়ে। আজকে দেশে কর্মসংস্থান নেই, বিনিয়োগ নেই। উন্নয়ন কাজে ব্যয়ের কারণে ব্যাংক ব্যবসায়ীদের টাকা দিচ্ছে না। ট্যাক্সের বাইরেও জনগণের আমানত ব্যাংকে যা আছে তা নিয়েও সরকার খরচ করছে। তাহলে যারা ব্যবসা বাণিজ্য করে তারা পূঁজি পাবে কোথায়? ব্যবসায়ীরা ব্যাংক থেকে টাকা পেলেইতো কর্মসংস্থান হবে। সেটাও হচ্ছে না।
বিএনপির যুগ্ম-মহাসচিব সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল বলেন, পঞ্চাশ বছর একটা পরিপূর্ণ যৌবনের বয়স। এই বয়সে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের যে প্রাপ্য ছিল, যারা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে বড় অবদান রেখেছেন তাদের সে স্বপ্ন অনেকাংশে পূর্ণ হয়নি। দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নসহ অনেক ক্ষেত্রে অগ্রগতি হয়েছে কিন্তু আয় বৈষম্য বাড়ার কারণে স্বাধীনতার মূল যে মন্ত্রটা ছিল সাম্য মানবিক মর্যাদা, সামাজিক ন্যায় বিচার, সে সাম্যও প্রতিষ্ঠিত হয়নি, মানবিক মর্যাদাতো নাইই। আজকেও (বুধবার ২৪মার্চ) আবর্জনার টাকা ভাগাভাগি নিয়ে প্রকাশ্যে দিনের বেলা শাসক দলের লোকেরা একজন আর একজনকে গুলি করে মেরেছে। তাদের নিজেদের মধ্যে প্রতিদিনই দেশের কোথাও না কোথাও সংঘর্ষ হচ্ছে। এই যে অবস্থাটা তৈরি করেছে এরা এবং ভোটারবিহীন নির্বাচনের মাধ্যমে জোর করে ক্ষমতায় থাকা এটাও স্বাধীনতার মূলমন্ত্রকে ব্যাহত করেছে।
তিনি বলেন, সবচেয়ে বেশি বেড়েছে সামাজিক বৈষম্য। একটা শ্রেণী দিন দিন গরিব হয়ে যাচ্ছে, আর একটা শ্রেণী দিন দিন পর্বতপ্রমাণ ধনী হয়ে যাচ্ছে। মানুষের মধ্যে ক্ষোভ বাড়ছে। রমজান আসছে, দ্রব্যমূল্যের অবস্থা নাগালের বাইরে। জনবীজনে একটা অস্থিরতা। ঢাকা পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে নোংরা জঘন্য একটা শহর, বায়ুদূষণের কারণে। এসব নানা অনাচার অনিয়মের মধ্যে দিয়ে এই সরকারের সুবর্ণজয়ন্তীর নামে যা চলছে এটা একটা বিবর্ণজয়ন্তী বলে মনে করি। কারণ এটাকে যতটা না স্বাধীনতার উৎসব হিসেবে দেখানো হচ্ছে তার চেয়ে বেশি দেখানো হচ্ছে জাতীয় নেতা শেখ মুজিবের জন্মদিনের বিষয়টি। সে ক্ষেত্রে স্বাধীনতার সুবর্ণ না হয়ে বিবর্ণ আর শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মবার্ষিকীটা সুবর্ণ হয়েছে।