দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে আলোচিত-সমালোচিত একটি দল জাতীয় পার্টি। স্বাধীন বাংলাদেশে দুই মেয়াদে সরকারও গঠনের ইতিহাস আছে দলটির। কারাগারে বন্দি থেকেও যেমন চমক দেখিয়েছিলেন দলের চেয়ারম্যান প্রয়াত হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। তেমনি ক্ষণে ক্ষণে মত বদলানোর কারণেও হয়েছিলেন সমালোচিত। সরকারি দলের সঙ্গে সমঝোতা করে নির্বাচনে অংশগ্রহণ, আবার ওই সংসদের বিরোধী দলের ভূমিকায় থাকা এবং সেই অবস্থায় সরকারের মন্ত্রিসভায় স্থান করে নিয়েছেন জাতীয় পার্টি। ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ রাষ্ট্রপতি আব্দুস সাত্তারকে হটিয়ে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করেছিলেন লেফটেন্যান্ট জেনারেল হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ। দেশে জারি করেন সামরিক শাসন। সামরিক শাসকের হাত ধরে ১৯৮৬ সালের ১ জানুয়ারি প্রতিষ্ঠা পায় জাতীয় পার্টি। দলটির চেয়ারম্যান হন এরশাদ। ওই বছরের ৭ মে অনুষ্ঠিত তৃতীয় জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ১৫৩টি আসনে জয় পেয়ে সরকার গঠন করে জাতীয় পার্টি। এর দুই বছরের মধ্যে ১৯৮৮ সালের ৩ মার্চ অনুষ্ঠিত চতুর্থ জাতীয় সংসদ নির্বাচন আওয়ামী লীগ, বিএনপিসহ প্রায় সব রাজনৈতিক দল বর্জন করলে জাপা ২৫১টি আসনে জয়লাভ করে। ওই সংসদের মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই নব্বইয়ের গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে পতন ঘটে এরশাদ শাসনের। এরপর আর ক্ষমতায় যাওয়া হয়নি জাতীয় পার্টির। তবে ক্ষমতা হারালেও বেশিরভাগ সময় ক্ষমতাসীন দলের মধ্যে নিজেকে বিলিয়ে দিয়ে সুবিধা ভোগ করেছে দলটি।গত তিন মেয়াদে আওয়ামী লীগের সঙ্গে সমঝোতা করে নির্বাচনে অংশগ্রহণ এবং সংসদে বিরোধীদলের ভূমিকাও পালন করে দলটি। এ কারণে গৃহপালিত বিরোধীদলের তকমাও জোটে কপালে। জাতীয় পার্টির দুর্গখ্যাত রংপুর অঞ্চলেও প্রভাব কমতে থাকে এক সময়ের একক আধিপত্য বিস্তারকারী দলটির।
৫ আগস্ট শেখ হাসিনার পতনের পর সেনাসদর ও বঙ্গভবনে ডাক পেয়েছিল দলটি। কিন্তু অতীত ভূমিকার কারণে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের দুই সমন্বয়ক সারজিস আলম এবং হাসনাত আবদুল্লাহ জাপাকে সংলাপে ডাকার প্রকাশ্যে বিরোধিতা করেন।
ফলে বিগত চার নির্বাচনে আওয়ামী লীগের সঙ্গে জোট বা সমঝোতা করে অংশ নেওয়া জাতীয় পার্টি শেষ পর্যন্ত প্রধান উপদেষ্টার সংলাপে ডাক পায়নি।ক্ষমতার পট পরিবর্তনের পর ‘আওয়ামী লীগের দোসর’কালিমা নিয়ে তীরহারা এখন জাতীয় পার্টির লাঙ্গল।রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, সরকার ঘনিষ্ঠ হয়ে টিকে থাকার চেষ্টা দলটিকে জনবিচ্ছিন্ন করে তুলেছে। গত তিনটি বিতর্কিত সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নৌকায় চড়ে রাজনীতির বৈতরণী পার হওয়ার চেষ্টা করেছে জাপা।সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ক্ষমতাসীনদের মধ্যে দলকে বিলিয়ে দেওয়া, তৃণমূল নেতাকর্মীদের প্রাধান্য না দেওয়া, সাধারণ মানুষের দাবির পক্ষে শক্ত অবস্থান তুলে ধরতে না পারাসহ নানা কারণে দলের জনপ্রিয়তা ও সমর্থক কমতে শুরু করেছে। বেশিরভাগ উপজেলায় অস্তিত্ব সংকটে পড়েছে। ক্রমশ দলটি এতটাই দুর্বল হয়েছে যে, এককভাবে নির্বাচন করার সামর্থ্যও এখন হারিয়েছে। ৩০০ আসনে শক্তিশালী প্রার্থীও দিতে পারে না দলটি।লালমনিরহাটের কালীগঞ্জ উপজেলার একটি বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অধ্যক্ষ তাহমিদুল আলম জাগো নিউজকে বলেন, নব্বইয়ের গণঅভ্যুত্থানের পরও রংপুর অঞ্চলে এরশাদের জাতীয় পার্টির জনপ্রিয়তা ছিল তুঙ্গে। কারাগারে বন্দি থেকেও এরশাদ পাঁচটি আসনে নির্বাচন করে পাঁচটিতেই জয়লাভ করেছেন। এককভাবে নির্বাচনে অংশ নিয়ে এ অঞ্চলের ৩৩টি আসনের মধ্যে অধিকাংশই ছিল জাপার দখলে।তিনি আরও বলেন, ২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের সঙ্গে জোট গঠন করার পর ধস নামতে থাকে। ক্ষমতার কাছাকাছি থেকে নিজেরা সুবিধা নিয়েছে ঠিকই কিন্তু সাধারণ মানুষ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। এককভাবে নির্বাচন করার সামর্থ্য হারিয়েছে। আওয়ামী লীগের নৌকায় চড়ে তীরহারা এখন জাপা।
বিগত জোটগত নির্বাচনের ফলাফলে দেখা যায়, দেশের ইতিহাসে ১৯৯১ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি প্রথমবারের মতো তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত হয় পঞ্চম সংসদ নির্বাচন। এই নির্বাচনে এককভাবে অংশ নিয়ে জাতীয় পার্টি পায় ৩৫টি আসন। এর মধ্যে রংপুর বিভাগে ছিল ১৭টি।১৯৯৬ সালেও এককভাবে নির্বাচনে অংশ নিয়ে জাতীয় পার্টি পায় ৩২টি আসন। এরমধ্যে রংপুর বিভাগে ছিল ২১টি। সেবার আওয়ামী লীগকে সরকার গঠনে সমর্থন জানায় জাতীয় পার্টি। তিন বছর পর আওয়ামী লীগ জোট থেকে বেরিয়ে অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী, জাতীয় পার্টি এবং ইসলামী ঐক্য জোট মিলিত হয়ে চারদলীয় ঐক্য জোট গঠন করে। কিন্তু কিছু দিন পরই জাতীয় পার্টির একটি অংশ এরশাদের নেতৃত্বে জোট থেকে বের হয়ে যায়।২০০১ সালের নির্বাচনে ইসলামী ঐক্যফ্রন্টের সঙ্গে জোট করে জাতীয় পার্টি পায় মাত্র ১৪টি আসন। যার সবগুলোই ছিল রংপুর বিভাগে। ২০০১ সালে সরকার গঠন করে বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোট। পরে ২০০৬ সালে জাতীয় পার্টি যোগ দেয় আওয়ামী লীগের মহাজোটে। এই মহাজোটে গিয়েই ধস নামতে শুরু করে জাতীয় পার্টির। আওয়ামী লীগ ঘরানায় আবর্তিত হতে থাকে এরশাদের জাপা, বাড়তে থাকে দুর্গের দুর্দশা।
২০০৮ সালের নির্বাচনে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন জোট থেকে ২৯টি আসন ছাড় পায় এরশাদের জাপা। কিন্তু যে আসনেই জোট ছাড়া নির্বাচন করেছে সেখানেই ধরাশায়ী হয়েছেন দলটির প্রার্থীরা। মহাজোট গঠনে পায় মোট ২৩টি আসন। এরমধ্যে রংপুর বিভাগে ছিল ১২টি। ২০০৯ সালে গঠিত হাসিনা সরকারের মন্ত্রী ছিলেন জিএম কাদের।২০১৪ সালের দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে বিদ্রোহী হয়েছিলেন জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান এইচ এম এরশাদ।
বিএনপির মতো এরশাদও দশম নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দিয়েছিলেন। কিন্তু তার স্ত্রী রওশন এরশাদ সে সময় দলের অর্ধেক নেতাকে নিয়ে ভোট করার পক্ষে অবস্থান নেন।ভোট বর্জন করেও রাজনীতির মারপ্যাঁচে রংপুর-৩ আসন থেকে এমপি নির্বাচিত হন সাবেক রাষ্ট্রপতি এরশাদ। অনেক নাটকীয়তার পর তিনি শপথও নেন, সেই সঙ্গে পান প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূতের পদ। সেই বিতর্কিত একতরফা নির্বাচনে বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় ২৩টিসহ মোট ৩৪ আসন নিয়ে প্রধান বিরোধী দল হয় জাতীয় পার্টি। এরমধ্যে রংপুর বিভাগে পায় ৭টি আসন। সেই সংসদে জাপার তিন এমপি মন্ত্রীও হন।
সব দলের অংশগ্রহণে ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত নির্বাচনে জাপাকে ২৭টি আসন ছাড় দেয় আওয়ামী লীগ। রাতের ভোটখ্যাত সেই নির্বাচনে ২২ আসন পেয়ে ফের প্রধান বিরোধী দল হয় জাপা। এরমধ্যে রংপুর বিভাগে ছিল ৭টি।
২০১৯ সালের জুলাইয়ে এরশাদের মৃত্যর পর দলের নেতৃত্বে আসেন ছোট ভাই জি এম কাদের। এসময় সাধারণ মানুষ ধারণা করেছিলেন, জিএম কাদের হয়তো প্রয়াত এরশাদের পথে হাঁটবেন না। ২০২৪ সালের নির্বাচন বিএনপি-জামায়াতসহ অধিকাংশ দল বর্জন করলেও জাতীয় পার্টি আওয়ামী লীগের সঙ্গে সমঝোতায় গিয়ে ওই নির্বাচনে অংশ নেয়। এমনকি শেখ হাসিনার ছবি সম্বলিত পোস্টারও সাঁটান জাতীয় পার্টির কয়েকজন শীর্ষ নেতা। সর্বনাশের কফিনে শেষ পেরেকটা ঠুকে যায় ২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারির ডামি নির্বাচনখ্যাত ওই ভোটে।আওয়ামী লীগের কাছ থেকে ২৬টি আসনে ছাড় পায়। ১১ আসন পেয়ে টানা তৃতীয় মেয়াদে বিরোধীদল হয় জি এম কাদেরের জাপা। এরমধ্যে রংপুর বিভাগে ছিল মাত্র তিনটি।
প্রাপ্ত ভোট বিশ্লেষণ করে দেখা যায, ১৯৯১ সালের নির্বাচনে মোট যত ভোট পড়েছিল তার ১১ দশমিক ৯২ শতাংশ পেয়েছিল জাতীয় পার্টি। এরপর ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে ১০ দশমিক ৬৭ শতাংশ, ২০০১ সালের ইসলামী জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের ব্যানারে নির্বাচনে অংশ নিয়ে পেয়েছে ৭ দশমিক ২৫ শতাংশ। ২০০৮ সালের নির্বাচনে পেয়েছে ৭ দশমিক ৪ শতাংশ। ২০১৪ সালে বিএনপি-জামায়াতবিহীন নির্বাচনে ১১ দশমিক ৩১ শতাংশ, ২০১৮ সালে সব দলের অংশগ্রহণে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে ৫ দশমিক ২২ এবং ২০২৪ সালের নির্বাচনে পেয়েছে ৩ দশমিক ৪১ শতাংশ ভোট।নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক জাতীয় পার্টির এক নেতা বলেন, আওয়ামী লীগের সঙ্গে জোট বা সমঝোতা না করে এককভাবে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করলেও মনে হয় এতটা বিব্রতকর পরিস্থিতি হতো না। আওয়ামী লীগের সঙ্গে সমঝোতা করে উপকারের চেয়ে অপকারই বেশি হয়েছে। সাধারণ মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্যতা হারিয়েছে জাতীয় পার্টি।
সমাজ পরিবর্তন ও উন্নয়ন ফোরামের কেন্দ্রীয় সভাপতি সাব্বির আরিফ মোস্তফা জাগো নিউজকে বলেন, জাতীয় পার্টির কফিনে শেষ পেরেক ঠুকে দেওয়া হয়েছে গত ৭ জানুয়ারির নির্বাচনে। ওই নির্বাচনে যখন দেশের প্রধান রাজনৈতিক দলসহ সাধারণ মানুষ বিমুখ হয়েছিল তখন জাতীয় পার্টি অংশ নিয়ে সরকারকে বৈধতা দেওয়ার চেষ্টা করেছে। বরং নির্বাচনে অংশ না নিলেই তাদের জনপ্রিয়তা আরও বাড়তো বলে মনে করি।
তিনি আরও বলেন, সংসদ নির্বাচনের বাইরে বিগত জেলা, উপজেলা, পৌর ও ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনেও জাতীয় পার্টি কোনো প্রভাব ফেলতে পারেনি। এমনকি ভোটের সূচকও ধীরে ধীরে তলানিতে ঠেকেছে। জাতীয় পার্টির এক সময়ের শক্ত অবস্থানগুলোতে জায়গা করে নিয়েছে আওয়ামী লীগ। সেইসঙ্গে এগিয়েছে দীর্ঘদিন ক্ষমতার বাইরে থাকা বিএনপি-জামায়াতও।
জাতীয় পার্টিকে ঘুরে দাঁড়াতে হলে তৃণমূল থেকে কাজ শুরু করতে হবে বলে মনে করেন সচেতন নাগরিক কমিটির (সনাক) রংপুরের সাবেক সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা সদরুল আলম দুলু।তিনি বলেন, লেজুড়বৃত্তিক রাজনীতি বাদ দিয়ে ইউনিয়ন পর্যায়ে নেতাকর্মীদের সংগঠিত করে দলের ভেতরে ও বাইরে গণতান্ত্রিক চর্চা করতে হবে। যেটা এত তাড়াতাড়ি সম্ভব নয়, এজন্য দীর্ঘ সময়ের দরকার।