শরীয়তপুর-চাঁদপুর সড়কে মেঘনা নদীর ওপর টানেল নির্মাণ পরিকল্পনার কথা জানায় বিগত সরকার। এতে ব্যয় ধরা হয় ৪ হাজার কোটি টাকা। ২০২৩ সালের জুলাইয়ে কাজ শুরু হয়ে তা শেষ হওয়ার কথা ২০২৭ সালে। কিন্তু এ প্রকল্পের অগ্রগতি সমীক্ষার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে। আর সেই সমীক্ষা বাবদ ব্যয় করা হয়েছে প্রায় ১৫ কোটি টাকা। ঢাকা মহানগরীর ইনার রিং রোডের ওপর এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের সম্ভাব্যতা সমীক্ষা ও নির্মাণ প্রকল্প ঘোষণা দেওয়া হয়। এতে ব্যয় ধরা হয়েছে ২৫ হাজার ১২০ কোটি টাকা। ২০২০ সালে শুরু হওয়া এ প্রকল্প শেষ হওয়ার কথা ছিল ২০২৬ সালে। তবে সম্ভাব্যতা যাচাইয়ে টাকা ব্যয় করার পর সব থমকে আছে। কেবল এ দুটি প্রকল্পই নয়, এমন ১২টি ঋণনির্ভর প্রকল্প নিয়েছিল বিগত আওয়ামী লীগ সরকার। যেখানে সর্বমোট ব্যয় হওয়ার কথা ২ লাখ ২৪ হাজার ৩৭৩ কোটি ৫০ লাখ টাকা। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশের বাস্তবতা এবং অর্থনৈতিক সক্ষমতা বিবেচনায় এসব প্রকল্প বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। এগুলো শুধু নেওয়া হয়েছিল রাজনৈতিক বিবেচনায় জনগণকে খুশি করতে। তবে সেসব প্রকল্প এখন আর এগোচ্ছে না; কিন্তু বাস্তবায়ন অযোগ্য এসব প্রকল্পের সমীক্ষা বাবদ ব্যয় করা হয়েছে ৪৩১ কোটি টাকা।
নথিপত্র বলছে, ১২টি প্রকল্পই বৈদেশিক ঋণ অথবা জি-টু-জি এবং পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপ (পিপিপি) ভিত্তিতে বাস্তবায়নের প্রস্তাব করা হয়। এর মধ্যে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত ৬টি প্রকল্পে ১ লাখ ৩০ হাজার ৬৫৮ কোটি ৫০ লাখ টাকা ব্যয় ধরা হয়েছিল। মাঝারি অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত ৬টি প্রকল্পে ৯৩ হাজার ৭১৫ কোটি টাকা প্রাথমিকভাবে ব্যয় নির্ধারণ করা হয়। এসব প্রকল্পের মেয়াদকাল ২০২১ থেকে ২০২৬ সাল পর্যন্ত নির্ধারণ করা হয়। এরই মধ্যে এসব প্রকল্পের সমীক্ষা শেষ করতে ৪০০ কোটির বেশি টাকা ব্যয় করা হয়েছে। অথচ এই কাজের কোনো অগ্রগতি নেই। প্রকল্পের প্রাথমিক নথিপত্র ঘেঁটে দেখা গেছে, প্রতিটি প্রকল্পেরই ব্যাখ্যা হিসেবে দেওয়া হয়েছে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা কিংবা প্রধানমন্ত্রীর প্রতিশ্রুতি। এ ছাড়া দুটি প্রকল্পে উল্লেখ রয়েছে নির্বাচনী প্রতিশ্রুতির কথা।
পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা নিয়ে অন্তর্র্বতী সরকারের পরিকল্পনা উপদেষ্টা ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেন, এ ধরনের বিষয়ে রাজনৈতিক দিকনির্দেশনা থাকে এবং এগুলো রাজনৈতিক সরকার নিজেদের মতো করে পরিকল্পনা ও নির্ধারণ করে। এটি এক ধরনের রাজনৈতিক দলিল। প্রকল্প পরিচালক, প্রভাবশালী রাজনৈতিক ঠিকাদার যৌথভাবে নিজেদের মতো করে প্রকল্প বাস্তবায়ন করত। পাশাপাশি দফায় দফায় সংশোধনের মাধ্যমে প্রকল্পের মেয়াদ ও ব্যয় বাড়ানো হলেও দায়ীদের ধরা যেত না কিংবা তাদের বিরুদ্ধে কোনো ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া যেত না। কারণ তারা রাজনৈতিক দলের ছত্রছায়ায় থাকা লোক।
তিনি বলেন, দেশে এখন উন্নয়নের নতুন ধারা বইছে। প্রকল্প যত কমই হোক, সেটি যেন মানসম্পন্ন হয়। মুখরোচক অনেক প্রকল্পের চেয়ে মানসম্পন্ন প্রকল্প নিয়ে বাস্তবায়নই অন্তর্র্বতী সরকার গুরুত্ব দিচ্ছে।
জানা গেছে, অন্তর্র্বতী সরকারের প্রথম জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় চলতি পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা আপাতত স্থগিত করা হয়েছে। পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার পরিবর্তে সরকার গঠিত অর্থনৈতিক উন্নয়ন-সংক্রান্ত টাস্কফোর্সের প্রতিবেদনের ভিত্তিতে উন্নয়ন কর্মকাণ্ড চলবে। ওই একনেক সভায় বিদেশি ঋণের প্রকল্পকে অগ্রাধিকার দিয়ে বাস্তবায়ন করা এবং দুর্নীতি ও অপচয় রোধ করে প্রকল্পের মানসম্পন্ন বাস্তবায়নের ওপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়। প্রকল্পের ব্যয় কেন বাড়ে, সময় মতো কেন বাস্তবায়ন হয় না—এসব বিষয়ে জবাবদিহি নিশ্চিত করার উপায় বের করার ওপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে সভায়। এ ছাড়া নতুন করে মেগা প্রকল্প না নেওয়ারও সিদ্ধান্ত হয়েছে।
অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা বাস্তবায়নে মধ্যমেয়াদে নেওয়া প্রকল্পের ঋণনির্ভর সর্বোচ্চ অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত ছয়টি প্রকল্পের মধ্যে ঢাকা শহরের তলদেশে ৯০ কিলোমিটার সাবওয়ের ২০ কিলোমিটার লাইন নির্মাণ হওয়ার কথা। এ প্রকল্পে বরাদ্দ ব্যয় নির্ধারণ করা হয়েছে ৬০ হাজার কোটি টাকা। এ ছাড়া বরিশাল-ভোলা সড়কে কালাবদর ও তেঁতুলিয়া নদীর ওপর ১০ দশমিক ৪৯ কিলোমিটার সেতু নির্মাণে ১০ হাজার ৪৯০ কোটি টাকা; রহমতপুর-বাবুগঞ্জ-মুলাদি-হিজলা সড়কে আড়িয়াল খাঁ নদীর ওপর ১ দশমিক ৫৯ কিলোমিটার সেতু নির্মাণে ১১শ কোটি টাকা; বাকেরগঞ্জ-বাউফল সড়কে কারখানা নদীর ওপর ১ দশমিক ৮৮ কিলোমিটার সেতু নির্মাণ, শরীয়তপুর-চাঁদপুর সড়কে মেঘনা নদীর ওপর ৮ কিলোমিটার সেতু/টানেল নির্মাণে ৪০ হাজার কোটি টাকা ব্যয় ধরা হয়। এর বাইরে চাঁদপুর জেলার মতলব উপজেলাধীন মেঘনা-ধনাগদা নদীর ওপর সাদুল্যাপুর ইউনিয়নের বেলতলী পয়েন্টে ভবেরচর-বেলতলী ২ কিলোমিটার সংযোগ সেতু নির্মাণে সম্ভাব্যতা সমীক্ষা পরিচালনা ও নির্মাণে ৪ হাজার ১৭৪ কোটি টাকা বরাদ্দ ব্যয় নির্ধারণ করা হয়েছে।
অন্যদিকে মাঝারি অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত ৬টি প্রকল্পের মধ্যে ভুলতা-আড়াইহাজার-নবীনগর সড়কে মেঘনা নদীর ওপর ২ দশমিক ৭৫ কিলোমিটার সেতু নির্মাণে বরাদ্দ ব্যয় নির্ধারণ করা হয়েছে ৭ হাজার ৯শ কোটি টাকা; ঢাকা-চট্টগ্রাম ২৫০ কিলোমিটার এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণে ৫০ হাজার কোটি টাকা; রাজধানীর জাহাঙ্গীর গেট থেকে বেগম রোকেয়া সরণি পর্যন্ত ১ দশমিক ৬৫ কিলোমিটার ফ্লাইওভার ও আন্ডারপাস নির্মাণে ৪৫০ কোটি টাকা; বঙ্গবন্ধু শিল্পাঞ্চল (মীরসরাই) থেকে চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর পর্যন্ত এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের সম্ভাব্যতা সমীক্ষা ও নির্মাণে ৮ হাজার কোটি টাকা এবং ঢাকা মহানগরীর ইনার রিং রোডের ওপর এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের সম্ভাব্যতা সমীক্ষা ও নির্মাণে ২৫ হাজার ১২০ কোটি টাকা বরাদ্দ ব্যয় নির্ধারণ করা হয়েছে।
প্রকল্পগুলোর মধ্যে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত চাঁদপুরের মতলবের মেঘনা-ধনাগদা নদীর ওপর সাদুল্যাপুর পয়েন্টে ভবেরচর-বেলতলি সেতু নির্মাণ প্রকল্পটি এখনো সচল রয়েছে। এ ছাড়া মাঝারি অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত ভুলতা-আড়াইহাজার-নবীনগর সড়কে মেঘনা নদীর ওপর সেতু নির্মাণ প্রকল্পও সচল। এ দুটি প্রকল্পে প্রকল্প পরিচালক নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল। এরপর আর তেমন অগ্রগতি নেই। প্রকল্প দুটির প্রকল্প পরিচালক (পিডি) ও তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী (মনিটরিং) মো. আবুল হোসেন এ বিষয়ে বলেন, ‘মাস্টারপ্ল্যানে থাকা প্রকল্পগুলোর ফিজিবিলিটি ও প্রি-ফিজিবিলিটি সম্পন্ন হয়েছে। এরই মধ্যে এসব প্রকল্পের সমীক্ষায় প্রায় ৪৩১ কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে।’
অন্য এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘মেঘনা-ধনাগদা নদীর ওপর ভবেরচর-বেলতলী সংযোগ সেতু এবং ভুলতা-আড়াইহাজার-নবীনগর সড়কে মেঘনা নদীর ওপর সেতু নির্মাণের কার্যক্রম প্রক্রিয়াধীন। তবে এখনো টেন্ডার প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়নি।’ তথ্য বলছে, কেবল ঋণনির্ভর উল্লিখিত প্রকল্পই গ্রহণ করা হয়নি, এর বাইরেও অন্তত ১৯টি প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে, যা ২০৩৫ সালের মধ্যে বাস্তবায়নের কথা। এর সব প্রকল্পই ঋণনির্ভর।
এসব বিষয়ে কথা বলতে সেতু কর্তৃপক্ষের প্রধান প্রকৌশলী কাজী মো. ফেরদৌসের দপ্তরে গত ২০ ও ২১ অক্টোবর বেলা ১১টার পর গেলে তাকে পাওয়া যায়নি। এরপর তার মোবাইলে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করে না পাওয়ায় পরবর্তী সময়ে প্রশ্ন লিখে খুদেবার্তা পাঠালেও তিনি কোনো উত্তর দেননি।
যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. এম শামসুল হক বলেন, ‘এসব প্রকল্পের জন্য গত সরকারটিই মূলত এ ধরনের সংস্কৃতি তৈরি করেছিল। তাদের নেতৃত্বে কিছু আমলা ছিল। এদের মধ্যে সড়ক ও জনপথের ছিলেন মুহাম্মাদ নাঈম সিদ্দিকী এবং বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষের ছিলেন খন্দকার আনোয়ারুল কবির। নিজেদের টেকনিক্যাল কোনো জ্ঞান না থাকলেও উনারা যা মনে আসত, তাই করতেন। প্রশাসনিক কাজের কারণে সাবেক প্রধানমন্ত্রীর এত কাছাকাছি উনারা চলে এসেছিলেন যে, উনারা যা চাইতেন তাই হতো। সেই সাহসেই উনারা এত বড় বড় প্রকল্প নিতে উৎসাহিত হতেন। এসব প্রকল্পে যে ফিজিবিলিটি স্টাডি করেছেন, তা ফরমায়েশি।’
তিনি আরও বলেন, ‘প্রথমে এই যে আমলারা বাড়াবাড়ি (ওভার প্লে) করেছেন, তাদের বিচারের আওতায় নিয়ে আসতে হবে। কারণ, ভবিষ্যতে যেন কোনো আমলা টেকনিক্যাল না হয়েও এত বড় টেকনিক্যাল সিদ্ধান্ত নেওয়ার দুঃসাহস না দেখান। এটি একটি অনৈতিক কাজ। দায়িত্বের মধ্যে না পড়লেও শুধু ব্যক্তিস্বার্থে এই আমলারা এমন ধরনের প্রকল্প নিয়ে সরকারকেও বিপদে ফেলেছেন। ভবিষ্যতে আমলারা যেন নৈতিকতার সঙ্গে নিজ দায়িত্ব পালন করেন, সেদিকে বর্তমান সরকারকে দৃষ্টি দিতে হবে।’