রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পরিপ্রেক্ষিতে সারাদেশে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির ব্যাপক অবনতি হয়। হত্যাযজ্ঞে জড়িত থাকায় সবচেয়ে বেশি ক্ষোভ তৈরি হয় পুলিশের বিরুদ্ধে। ৫ আগস্টের পর নিরাপত্তার স্বার্থে সেনানিবাসে আশ্রয় নেন ৫১৫ জন পুলিশ সদস্য-কর্মকর্তা। এর পর এখনো শৃঙ্খলা ফেরেনি পুলিশে। অনেকে দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন, অনেকে রয়েছেন আত্মগোপনে।৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর পুলিশের বিভিন্ন পর্যায়ের ১৮৭ জন সদস্য এখনো কর্মস্থলে যোগ দেননি বলে জানিয়েছে পুলিশ সদর দপ্তর। তবে এর বাইরেও অনেক পুলিশ সদস্য নানা কৌশল বা কারণ দেখিয়ে কর্মস্থলে এখনো অনুপস্থিত। সরকারের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, যারা চাকরিতে ফিরতে পারবেন না তাদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়াসহ এরই মধ্যে দায়ের হওয়া ফৌজদারি মামলার তদন্ত ও বিচারকাজ আইন অনুযায়ী চলবে।সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, পুলিশের যেসব প্রভাবশালী কর্মকর্তাকে এরই মধ্যে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হয়েছে তাদের মধ্যে বেশিরভাগই পলাতক। বিগত সরকারের দোসর হিসেবে চিহ্নিত প্রভাবশালী পুলিশ কর্মকর্তারা এখনো ধরা-ছোঁয়ার বাইরে। যেসব পুলিশ কর্মকর্তা বিক্ষুব্ধ ছাত্র-জনতার ওপর গুলির নির্দেশ দিয়ে হতাহত করেন তাদের গ্রেফতার না হওয়ায় জনমনে রয়েছে ক্ষোভ।
পলাতক হিসেবে শীর্ষে ডিবি হারুন
অনুসন্ধানে দেখা যায়, পুলিশের পলাতক কর্মকর্তাদের তালিকায় শীর্ষে রয়েছেন ডিএমপির সাবেক অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ। তাকে এখনো চাকরিচ্যুত করা হয়নি। পলাতক হিসেবে হারুনকে পুলিশ সদর দপ্তরের তালিকায় এক নম্বরে রাখা হয়েছে।
৫ আগস্টের আগে-পরে সংঘটিত আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর গুলিতে হতাহতের ঘটনায় দায়ের করা মামলায় আসামির তালিকায়ও শীর্ষে হারুন অর রশীদ। এসব মামলার মধ্যে ২০১১ সালে যে ঘটনা কেন্দ্র এই কর্মকর্তা লাইমলাইটে আসেন সেই তৎকালীন বিরোধীদলীয় চিফ হুইপ বিএনপি নেতা জয়নাল আবদিন ফারুককে নির্যাতনের মামলাও আছে।
১৩ বছর পর গত ১৯ আগস্ট জয়নাল আবদিন ফারুক নিজেই বাদী হয়ে ডিএমপির শেরেবাংলা নগর থানায় মামলা করেন। এ পর্যন্ত ৩৮টি মামলায় তার নাম পাওয়া গেছে। সবশেষ এই কর্মকর্তা ডিএমপির ডিবিপ্রধান হিসেবে বেশি সমালোচিত হন। ৫ আগস্টের পর থেকে তাকে আর প্রকাশ্যে দেখা যায়নি।
দেশ ছাড়ার গুঞ্জন যেসব পুলিশ কর্মকর্তাদের
গ্রেফতার এড়াতে পুলিশের কয়েকজন কর্মকর্তার দেশ ছাড়ার গুঞ্জন রয়েছে। আবার কেউ শিক্ষা ছুটি, কেউবা অসুস্থতার কথা বলে কিংবা লিয়েন (অনুমোদন নিয়ে অন্যত্র চাকরি) নিয়ে বিদেশ যাওয়ার চেষ্টা করছেন। অবৈধভাবে সীমান্ত অতিক্রমের চেষ্টা করছেন কেউ কেউ।
১৮ সেপ্টেম্বর স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী এক অনুষ্ঠানে বলেছিলেন, যেসব পুলিশ সদস্য এখনো কাজে যোগ দেননি, লুকিয়ে আছেন, তাদের আর যোগ দিতে দেওয়া হবে না।
শাহজালাল বিমানবন্দর দিয়ে দেশ ছাড়েন সাবেক অতিরিক্ত আইজিপি মীর রেজাউল আলম
একটি সূত্র জানায়, বাধ্যতামূলক অবসরপ্রাপ্ত পুলিশের অতিরিক্ত আইজিপি মীর রেজাউল আলম গত ১৮ সেপ্টেম্বর ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে এমএইচ১০৩ এর একটি ফ্লাইটযোগে সিডনির উদ্দেশ্যে ঢাকা ত্যাগ করেন। তার নামে একাধিক মামলা হয়েছে। দুদকে তার নামে দুর্নীতির অভিযোগও রয়েছে।
দেড় লাখ টাকায় দেশ ছাড়ার গুঞ্জন বিপ্লব কুমার সরকারের
গত ১২ সেপ্টেম্বর গণমাধ্যমে খবর ছড়িয়ে পড়ে লালমনিরহাটের পাটগ্রামের দহগ্রাম ইউনিয়ন সীমান্ত দিয়ে অবৈধভাবে ভারতে চলে গেছেন ডিএমপির যুগ্ম-পুলিশ কমিশনার বিপ্লব কুমার সরকার। প্রতিবেদনে দাবি করা হয়, মঙ্গলবার (১০ সেপ্টেম্বর) রাতে কোনো এক সময় তিনি ভারতে প্রবেশ করেন। পাচারকারীদের এ সংক্রান্ত কয়েকটি কথোপকথনের অডিও রেকর্ড সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে। এ নিয়ে জেলাজুড়ে তুমুল আলোচনা ও গুঞ্জনের সৃষ্টি হয়েছে। সীমান্ত পার করার সময় বিপ্লব কুমারের কাছ থেকে দেড় লাখ টাকা নেওয়া হয় বলেও বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশ করা হয়।
দেশ ছাড়ার চেষ্টাকালে ব্যর্থ হন সাবেক ডিএমপি কমিশনার খন্দকার গোলাম ফারুক
গত ২০ আগস্ট ব্যাংককের উদ্দেশ্যে দেশ ত্যাগের জন্য শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে যান। কিন্তু ডিবিকে তাৎক্ষণিকভাবে বিষয়টি জানানো হলে খন্দকার গোলাম ফারুকের দেশ ত্যাগের বিষয়ে আপত্তি জানানো হয়। পরে অবশ্য তিনি বিমানবন্দর থেকে বাসায় ফিরে যান। খন্দকার গোলাম ফারুকের বিরুদ্ধে ডিএমপির কোতোয়ালি থানায় একটি হত্যাচেষ্টা মামলা রয়েছে।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে সাবেক ডিএমপি কমিশনার খন্দকার গোলাম ফারুক বলেন, ‘আমার চোখের সমস্যা। এর আগে আমি ব্যাংককে গিয়ে অপারেশন করিয়েছি। সেটার ফলোআপ করতেই মূলত ব্যাংকক যেতে চেয়েছিলাম। আমি জানি যে আমার নামে সম্প্রতি ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের পর মামলা হয়েছে। আমি তো পালাচ্ছিলাম না। চিকিৎসার জন্য যাচ্ছিলাম। সঙ্গত কারণে ভাবিনি আমাকে আটকে দেওয়া হবে।’
বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো যেসব পুলিশ কর্মকর্তারা আত্মগোপনে
৫ আগস্টের পর থেকে পুলিশের বিশেষ শাখার (এসবি) সাবেক প্রধান মনিরুল ইসলাম, ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) সাবেক কমিশনার হাবিবুর রহমান, অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) সাবেক প্রধান মোহাম্মদ আলী মিয়া ও কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের (সিটিটিসি) সাবেক অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার মো. আসাদুজ্জামানসহ শীর্ষ পর্যায়ের অন্তত ২৩ কর্মকর্তাকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হয়েছে। অবসরে যাওয়ার আগে তাদের প্রায় সবাই আত্মগোপনে ছিলেন।
পুলিশে এখন পর্যন্ত গ্রেফতার হয়েছেন যারা
গত জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার ওপর নির্বিচারে গুলির ঘটনায় পুলিশের শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে মামলা হচ্ছে। এসব মামলায় পুলিশের সাবেক দুই আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন এবং এ কে এম শহীদুল হক, ডিবির ডিসি মশিউর রহমান, ঢাকা জেলার সাবেক অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. আব্দুল্লাহিল কাফী ও যাত্রাবাড়ী থানার সাবেক ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবুল হাসানসহ বিভিন্ন পর্যায়ের আলোচিত অন্তত সাত সদস্য এরই মধ্যে গ্রেফতার হয়েছেন।
গ্রেফতারের জন্য খোঁজা হচ্ছে যেসব কর্মকর্তাকে
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগ থেকে অনুমতি নেওয়া হয়েছে বেশ কয়েকজনকে কর্মকর্তাকে গ্রেফতারের জন্য। তারা হলেন- ঢাকা জেলার সাবেক পুলিশ সুপার আসাদুজ্জামান ও ঢাকার সাভার সার্কেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার সাহিদুর রহমান।গ্রেফতারের অনুমতি নেওয়া পুলিশ সদস্যের তালিকায় আরও আছেন- ডিএমপির ওয়ারী বিভাগের সাবেক উপ-পুলিশ কমিশনার (ডিসি) মোহাম্মদ ইকবাল হোসেন, ওয়ারী জোনের সাবেক অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার (এডিসি) এস এম শামীম, উত্তরা বিভাগের অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার (এডিসি) মো. তৌহিদুল ইসলাম, ট্রাফিক ওয়ারী বিভাগের সাবেক সহকারী কমিশনার তানজিল আহমেদ ও আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের (এপিবিএন) উত্তরার সহকারী পুলিশ সুপার (চট্টগ্রামের হাটহাজারী মডেল থানার সাবেক ওসি) মো. রফিকুল ইসলাম। রফিকুলকে ২২ সেপ্টেম্বর চাকরি থেকে অবসরে পাঠানো হয়।এসব কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা হয়েছে। এখন পর্যন্ত শুধু ঢাকায় পুলিশের কমপক্ষে ৯৯ সদস্যের বিরুদ্ধে হত্যা, হত্যাচেষ্টা ও অপহরণে জড়িত থাকার অভিযোগে মামলা হয়েছে।
আত্মগোপনে যারা
কর্মস্থলে যোগ না দেওয়া ১৮৭ সদস্যের যে তালিকা পুলিশ সদর দপ্তর দিয়েছে, এর মধ্যে ডিআইজি থেকে সহকারী পুলিশ সুপার পদমর্যাদার কর্মকর্তা আছেন ১৬ জন। পুলিশ পরিদর্শক আছেন ৫ জন, উপপরিদর্শক (এসআই) পদমর্যাদার কর্মকর্তা আছেন ১৪ জন। অন্যদের মধ্যে এএসআই ৯ জন, নায়েক ৭ জন ও কনস্টেবল ১৩৬ জন।
পুলিশ সদর দপ্তর সূত্র বলছে, কাজে যোগ না দেওয়া শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের মধ্যে রয়েছেন ডিএমপির সাবেক অতিরিক্ত কমিশনার মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ, ট্যুরিস্ট পুলিশের অতিরিক্ত ডিআইজি মো. মনিরুজ্জামান (স্বেচ্ছায় চাকরি থেকে অবসরের আবেদন করেছেন), ডিএমপির সাবেক যুগ্ম-পুলিশ কমিশনার বিপ্লব কুমার সরকার, ডিবির সাবেক যুগ্ম কমিশনার খোন্দকার নুরুন্নবী, ডিএমপির সাবেক যুগ্ম কমিশনার এস এম মেহেদী হাসান, রংপুর মহানগর পুলিশের (আরপিএমপি) অতিরিক্ত কমিশনার উত্তম কুমার পাল এবং পুলিশ সদর দপ্তরের অতিরিক্ত ডিআইজি প্রলয় কুমার জোয়ারদার।
পুলিশ সুপার থেকে সহকারী পুলিশ সুপার পদমর্যাদার আত্মগোপনে থাকা অন্য আট কর্মকর্তা হলেন- আরপিএমপির উপ-পুলিশ কমিশনার মো. আবু মারুফ হোসেন, আরপিএমপি ডিবির উপ-পুলিশ কমিশনার মো. শাহ নূর আলম, ডিএমপির সহকারী পুলিশ কমিশনার মফিজুর রহমান ও মো. ইফতেখার মাহমুদ, আরপিএমপির সহকারী পুলিশ কমিশনার মো. আরিফুজ্জামান ও মো. আল ইমরান হোসেন এবং সিরাজগঞ্জের সহকারী পুলিশ সুপার রানা।পরিদর্শক পদে কর্মস্থলে যোগ না দেওয়া কর্মকর্তারা হলেন লালমনিরহাটের হাতীবান্ধা থানার সাবেক ওসি মো. মাহফুজার রহমান, কুমিল্লার সদর দক্ষিণ মডেল থানার পরিদর্শক খাদেমুল বাহার বিন আবেদ, চাঁপাইনবাবগঞ্জের গোমস্তাপুর সার্কেলের পরিদর্শক মো. ইউসুফ হাসান, ডিএমপির সাবেক পরিদর্শক জাকির হোসাইন ও ঢাকা জেলা পুলিশের পরিদর্শক মো. আরাফাত হোসেন।
অনুপস্থিত বা আত্মগোপনে থাকা সদস্যদের বিষয়ে জানতে চাইলে পুলিশ সদর দপ্তরের এআইজি (মিডিয়া অ্যান্ড পিআর) ইনামুল হক সাগর বলেন, ‘কর্মস্থলে অনুপস্থিত ১৮৭ জনের আর যোগ দেওয়ার সুযোগ নেই। পুলিশের চাকরি বিধি অনুযায়ী যারা এখনো কাজে যোগদান করেননি তাদের ধাপ অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়ার কার্যক্রম শুরু হয়েছে।’
এ বিষয়ে পুলিশ সদর দপ্তরের ডিআইজি (অপারেশনস) মো. রেজাউল করিম বলেন, ‘পুলিশে যারা এখনো কাজে যোগদান করেননি তাদের সরকারি আইন ও বিধি অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) নির্বাহী পরিচালক মানবাধিকারকর্মী মো. নূর খান বলেন, ‘যারা নিজেদের সুশৃঙ্খল বাহিনীর সদস্য মনে করতেন এবং ঊর্ধ্বতন এমন অনেকেই পুলিশে বাহিনীতে এখনো কাজে যোগদান করেননি, তারা শৃঙ্খলা লঙ্ঘন করেছেন। সেক্ষেত্রে তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করা উচিত। যাতে ভবিষ্যতে এ ধরনের কাজ কেউ না করে। কারণ যারা যোগ দেননি তারা কাজ বিঘ্নিত করার চেষ্টা করছেন। সে কারণে তাদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা উচিত।’