ঢাকা, রবিবার ৬ই অক্টোবর ২০২৪ , বাংলা - 

বিশ্বব্যাপী প্রশংসায় প্রধান উপদেষ্টা ড.ইউনূস

2024-09-29, 12.00 AM
বিশ্বব্যাপী প্রশংসায় প্রধান উপদেষ্টা ড.ইউনূস

বিশ্বব্যাপী প্রশংসায় ভাসছেন বাংলাদেশের অন্তর্র্বতী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস। গত শুক্রবার রাতে জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে দেওয়া ভাষণের পর তাকে অভিনন্দন ও শুভেচ্ছা জানাচ্ছেন অনেকে। ভাষণে চলমান যুদ্ধাবস্থা থেকে বিশ্বে শান্তি প্রতিষ্ঠা, দারিদ্র্য বিমোচন, বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তন, বাংলাদেশে জুলাইয়ের গণঅভ্যুত্থান, পাচার হওয়া অর্থ ফিরিয়ে আনা, রোহিঙ্গা প্রত্যাবর্তনসহ চলমান আলোচিত নানা ইস্যু তুলে ধরেন তিনি। স্বপ্ন দেখান নতুন এক বাংলাদেশের। আর সেই স্বপ্নপূরণে বিশ্বসম্প্রদায়ের সহযোগিতাও চান তিনি। শুধু তাই নয়, জাতিসংঘ অধিবেশন কেন্দ্র করে বিশ্বের বিভিন্ন প্রভাবশালী দেশ ও সংস্থার প্রধান এবং তাদের প্রতিনিধিদের সঙ্গে ফলপ্রসূ বৈঠককে সবচেয়ে সফলতম বিষয় হিসেবে উল্লেখ করছেন বিশ্লেষকরা, যা এক নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচিত করবে বলে বিশ্বাস তাদের। ড. ইউনূস জাতিসংঘে যখন ভাষণ দিচ্ছিলেন, তখন মুহুর্মুহু করতালিতে অভিনন্দন জানান অধিবেশনে উপস্থিত বিশ্বনেতারা। ভাষণের পর এক ব্রিফিংয়ে জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেসের মুখপাত্র স্টিফেন ডুজারিক সাংবাদিকদের জানান, জাতিসংঘে ড. ইউনূসের দেওয়া ভাষণের প্রশংসা করেছেন জাতিসংঘ মহাসচিব। ডুজারিক আরও বলেন, কোনো দেশ যখন তাদের সবচেয়ে সম্মানিত প্রতিনিধিকে জাতিসংঘে পাঠায়, তা আমাদের অবশ্যই সন্তুষ্ট করে। ইউনূসের ভাষণকে যুগান্তকারী হিসেবে উল্লেখ করেছেন প্রবাসী বাংলাদেশিসহ বিভিন্ন কমিউনিটির নেতারা। তারা বলছেন, বাংলাদেশ রাষ্ট্র সংস্কারে তরুণদের অবদান তুলে ধরার পাশাপাশি বৈশ্বিক নানা সংকট সমাধানের তাগিদ দেওয়ায় এ বক্তব্য সবার কাছে গ্রহণযোগ্য হবে।

জাতিসংঘ অধিবেশনে যোগ দিতে মাত্র চার দিনের এ সফরে গিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন, কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো, বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট অজয় বাঙ্গা, আইএমএফের প্রেসিডেন্ট ক্রিস্টালিনা জর্জিয়েভা, ইতালির প্রধানমন্ত্রী জর্জিয়া মেলোনি, পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফ, মালদ্বীপের প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ মুইজ্জু, নেপালের প্রধানমন্ত্রী কে পি শর্মা ওলি, চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ইসহ মোট ১২টি দেশের রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধানের সঙ্গে বৈঠক করেছেন ড. ইউনূস। অংশ নিয়েছেন সাধারণ পরিষদের অধিবেশনসহ ৪০টি উচ্চপর্যায়ের বৈঠকে।বিশ্লেষকরা জানান, বিশ্ববরেণ্য একজন নোবেলজয়ী হিসেবে ড. ইউনূস জাতিসংঘে নানা ফোরামে দায়িত্ব পালন করেছেন। কিন্তু এবার অন্তর্র্বতী সরকারপ্রধান হিসেবে অন্য এক ইউনূসকে পেয়েছেন বিশ্বনেতারা। সেজন্য তাকে বরণে আগে থেকেই প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন বিভিন্ন দাতা ও উন্নয়ন সংস্থার প্রধানসহ বিশ্বসম্প্রদায়ের শীর্ষ নেতারা। এমনকি অধিবেশনের ফাঁকে তার সঙ্গে শুভেচ্ছা বিনিময় করতে লম্বা লাইনও চোখে পড়ে, যা সবারই নজর কেড়েছে। বিশেষ করে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সঙ্গে ড. ইউনূসের বৈঠকটি সবাইকে অবাক করে দিয়েছে। জাতিসংঘের স্থায়ী মিশনের কূটনীতিকরা বলেছেন, জাতিসংঘ অধিবেশনের ফাঁকে কোনো রাষ্ট্র বা সরকারপ্রধানের সঙ্গে মার্কিন প্রেসিডেন্টের এমন বৈঠক বিরল ঘটনা। বিগত তিন দশকেও এমন বৈঠক আর হয়নি। এ ছাড়া বাংলাদেশের জন্য এটি ছিল অনেকটা স্বপ্নের মতোই, যা সম্ভব হয়েছে একমাত্র নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. ইউনূসের জন্য।

প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলমের দাবি, বাংলাদেশের হয়ে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে যোগ দেওয়া সরকারপ্রধানদের সফরগুলোর মধ্যে সবচেয়ে সফলতম হয়েছে এ সফর। অবশ্য যথেষ্ট দৃঢ় যুক্তির ভিত্তিতেই এ দাবি করেছেন তিনি। কারণ, নানা কারণে প্রধান উপদেষ্টার সফরটি গুরুত্বপূর্ণ ছিল আগে থেকেই। প্রথমত, বাংলাদেশে গণঅভ্যুত্থানের মুখে গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার ভারতে পালিয়ে যাওয়া এবং ছাত্র-জনতার সমন্বয়ে নতুন অন্তর্র্বতীকালীন সরকার গঠনের পর এবারের জাতিসংঘ অধিবেশনে যোগ দিয়েছে বাংলাদেশ। দ্বিতীয়ত, মানবাধিকার ও গণতন্ত্র ইস্যুতে আওয়ামী লীগ সরকারের সময় যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ পশ্চিমা অনেক দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের এক প্রকার টানাপোড়েন চলছিল। মানবাধিকার সংস্থাগুলো বাংলাদেশের পরিস্থিতির কড়া সমালোচনা করে আসছিল।

ফলে এ সম্মেলন বাংলাদেশের জন্য ভাবমূর্তি পুনরুদ্ধার ও পশ্চিমা দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের একটি প্রেক্ষাপট হিসেবে দেখেছেন অনেক বিশ্লেষক। প্রধান উপদেষ্টার সফরকালীন কার্যক্রম পর্যালোচনা করলে বোঝা যায়, এই একটি সফর থেকে যা যা অর্জন বা প্রাপ্তির কথা ছিল, তার প্রায় সবই পূরণ হয়েছে। জাতিসংঘের অধিবেশনের আগে রোহিঙ্গা, পাচারকৃত অর্থ দেশে ফেরত আনাসহ বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে কয়েকটি বৈঠকও করেছেন তিনি। রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে প্রত্যাবাসন কর্মসূচিকে গতিশীল করতে জাতিসংঘের বেশ কয়েকজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা এবং কমনওয়েলথভুক্ত দেশগুলোর মন্ত্রীদের সঙ্গে অন্তত দুটি গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক করেন সরকারপ্রধান। পাচার হওয়া অর্থ দেশে ফেরত আনতে যুক্তরাষ্ট্র এবং যুক্তরাজ্যের মন্ত্রীদের সঙ্গে বৈঠক করেন তিনি। নেপালের সঙ্গে জ্বালানি, বাণিজ্য এবং অর্থনৈতিক সহযোগিতা জোরদার করতে বৈঠক করেছেন দেশটির প্রধানমন্ত্রী কেপি শর্মা ওলির সঙ্গে। মালদ্বীপের প্রেসিডেন্ট এবং পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গেও একই ইস্যুতে বৈঠক করেছেন তিনি।এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বাইডেনের সঙ্গে যে বৈঠকটি তিনি করেছেন, সেটি প্রায় পুরোপুরি বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্র দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যের ওপর হয়েছে। তৈরি পোশাক খাতে বাংলাদেশের ওপর ধার্য করা রপ্তানি শুল্ক কমানো এবং জিএসপি সুবিধা দেওয়ার দাবি জানিয়েছেন ইউনূস। বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মার্কিনবিরোধী নীতির জন্য এতদিন এসব দাবি তোলা সম্ভব হয়নি।

জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে দেওয়া ভাষণে বাংলাদেশের সাম্প্রতিক অভ্যুত্থানের চিত্র তুলে ধরেছেন শান্তিতে নোবেলজয়ী এ অর্থনীতিবিদ। তিনি বলেছেন, ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন এবং ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় অনুপ্রাণিত তরুণ প্রজন্ম তাদের পূর্বসুরিদের অনুসরণ করে বাংলাদেশ থেকে স্বৈরতান্ত্রিক ও দুর্নীতিগ্রস্ত শাসন ব্যবস্থাকে বিদায় জানিয়েছে।

জাতিসংঘের ৭৯তম সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে প্রধান উপদেষ্টার ভাষণের প্রশংসা করে বিশ্লেষকরা বলছেন, বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্ড স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজের (বিস) গবেষণা পরিচালক ড. আবু সালেহ মোহাম্মদ ইউসুফ কালবেলাকে বলেন, প্রধান উপদেষ্টার জাতিসংঘ অধিবেশনে অংশগ্রহণের ওপর এবার বিশেষ নজর ছিল বিশ্বনেতাদের। অন্তর্র্বতীকালীন সরকারপ্রধান ড. ইউনূস বিশ্বে নতুন এক বাংলাদেশের ধারণা তুলে ধরেছেন। বিশ্বকে বাংলাদেশ কীভাবে দেখতে চায় সেটিও জানিয়েছেন তিনি। তিনি রোহিঙ্গা ও জলবায়ুসহ বাংলাদেশের নানা সমস্যার কথা তুলে ধরেছেন। পশ্চিমা দেশগুলোর সঙ্গে অতীতের তিক্ততা ভুলে নতুন এক সম্পর্কের ইঙ্গিত উঠে আসে তার ভাষণসহ নানা বৈঠকে। ফলে নতুন বাংলাদেশের সঙ্গে বিশ্ব নতুনভাবে পরিচিত হবে বলে আমাদের বিশ্বাস। তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশের অনিয়ম, দুর্নীতি, সুশাসনের অভাব ও অর্থনৈতিক অচলাবস্থার অবসানে তার এ ভাষণ এবং বিভিন্ন বৈঠক গুরুত্বপূর্ণ ও ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে।

এই গবেষকের মতে, বিশ্বদরবারে ড. ইউনূসের গ্রহণযোগ্যতার কারণে বাংলাদেশে বিদেশি বিনিয়োগ বাড়ছে। বাংলাদেশকে নিয়ে এখন পুরো বিশ্ব অবহিত। এখন তারা বাংলাদেশকে যার যার জায়গা থেকে সহায়তা করতে চায়।

ছাত্র-জনতার রক্তাক্ত অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার স্বৈরশাসনের পতন ও পলায়নের পর অন্তর্র্বতী সরকারের প্রধান হিসেবে শপথ নেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস। ৮ আগস্ট সরকার গঠনের পর ড. ইউনূসের এটিই প্রথম বিদেশ সফর।ড. ইউনূসের ভাষণে জাতিসংঘের সন্তোষ প্রকাশ:

বাংলাদেশের অন্তর্র্বতীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ৭৯তম অধিবেশনে যে ভাষণ দিয়েছেন, তাতে সন্তোষ প্রকাশ করেছে বৈশ্বিক সংস্থাটি। গত শুক্রবার জাতিসংঘের নিয়মিত ব্রিফিংয়ে ড. ইউনূসের ভাষণের বিষয়ে জানতে চাইলে নিজেদের সন্তুষ্টির কথা ব্যক্ত করেন সংস্থাটির মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেসের মুখপাত্র স্টিফেন ডুজারিক। সংস্থাটির স্থায়ী সংবাদদাতা মুশফিকুল ফজল আনসারী ব্রিফিংয়ে জানতে চান, ড. ইউনূস জাতিসংঘের একজন গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার, পাশাপাশি তিনি এখন বাংলাদেশের অন্তর্র্বতীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা। কিছুক্ষণ আগে জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে তিনি ভাষণ দিয়েছেন। ভাষণে তিনি বাংলাদেশের জটিল পরিস্থিতি, গাজাসহ পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গার চলমান যুদ্ধ এবং গাজা ও ইউক্রেনের মানবিক সংকটের কথা উল্লেখ করেছেন। তার আজকের এই ভাষণকে কীভাবে দেখছেন?

জবাবে স্টিফেন ডুজারিক বলেন, অধিবেশনে দেওয়া প্রতিটি ভাষণ নিয়ে আমাদের মন্তব্য করার সুযোগ নেই। কোনো দেশ যখন তাদের সবচেয়ে সম্মানিত কোনো প্রতিনিধিকে জাতিসংঘে পাঠায়, তা আমাদের অবশ্যই সন্তুষ্ট করে।

স্থানীয় সময় বৃহস্পতিবার জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেসের সঙ্গে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বৈঠক হয়। বৈঠকে শান্তিরক্ষা মিশনে বাংলাদেশের অংশগ্রহণসহ জাতিসংঘ এবং বাংলাদেশের মধ্যকার ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের বিষয়টিকে সাধুবাদ জানান সংস্থাটির মহাসচিব। জাতিসংঘের পাঠানো বিবৃতিতে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের চলমান গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় উত্তরণের চলমান পরিস্থিতি এবং সংস্কার কার্যক্রমে জাতিসংঘ সহযোগিতা করতে প্রস্তুত রয়েছে বলে ফের আশ্বস্ত করেন গুতেরেস।

এদিকে, জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশন ও অন্যান্য ফোরামে যোগদান শেষে গতকাল ঢাকার উদ্দেশে নিউইয়র্ক ছেড়েছেন ড. ইউনূস। গতকাল রাত ৯টায় এ প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত তিনি বিমানে ছিলেন। রাত ২টা ১৫ মিনিটে তার ঢাকা পৌঁছানোর কথা। তার প্রেস সচিব শফিকুল আলম বলেন, প্রধান উপদেষ্টা ও তার সফরসঙ্গীদের বহনকারী কাতার এয়ারওয়েজের একটি বাণিজ্যিক ফ্লাইট শুক্রবার স্থানীয় সময় রাত ৯টা ৩০ মিনিটে নিউইয়র্কের জন এফ কেনেডি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ত্যাগ করে। প্রধান উপদেষ্টা গত ২৩ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে যোগ দিতে নিউইয়র্ক যান।