ঢাকা, বুধবার ১৮ই সেপ্টেম্বর ২০২৪ , বাংলা - 

সাবেকপিএস হারুন এর শতকোটির সম্পদ

ষ্টাফ রিপোটার।।ঢাকাপ্রেস২৪.কম

2024-09-10, 12.00 AM
সাবেকপিএস হারুন এর শতকোটির সম্পদ

আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে অনিয়ম, দুর্নীতি আর লুটপাটে জড়িত আমলাদের আমলনামা একে একে বেরিয়ে আসছে। যারা ক্ষমতার প্রভাব খাটিয়ে গড়ে তুলেছেন সম্পদের পাহাড়। তাদেরই একজন হলেন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের সাবেক অতিরিক্ত সচিব হারুন অর রশিদ বিশ্বাস। পরে হন সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের একান্ত সচিব (পিএস)। এরই মধ্যে তিনি পেয়ে যান ‘আলাদিনের চেরাগ’। প্রভাব খাটিয়ে চাকরি দেন ২৫ আত্মীয়কে। নিয়োগ-বাণিজ্য, জমি দখল, লুটপাট, প্রকল্পের নামে আত্মসাৎ করে গড়েছেন শতকোটি টাকার সম্পদ। নিজ উপজেলা ও রাজধানীতে কিনেছেন জমি ও ফ্ল্যাট। তার প্রভাবে ভাই হয়েছেন ইউপি চেয়ারম্যান। তিনিও কামিয়েছেন কোটি কোটি টাকা। বরিশালের মুলাদী উপজেলার কাজীরচর ইউনিয়নের চরকমিশনার গ্রামের কৃষক আব্দুল আওয়াল বিশ্বাস ও শামসুন্নাহার দম্পতির ছেলে হারুন বিশ্বাস। সরকারের গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয় ও পদে থেকে তিনি নিজ উপজেলা এবং রাজধানীতে গড়েছেন অঢেল সম্পদ। এমনকি তিনি টানা দুবার আওয়ামী লীগের টিকিটে ভোটারবিহীন নির্বাচনে বড় ভাই মন্টু বিশ্বাসকে ইউপি চেয়ারম্যান বানিয়েছেন। তার ভাই মন্টু বিশ্বাসের নির্বাচনে বিরোধিতা করায় ইউসুফ ইঞ্জিনিয়ার নামে একজনকে জেলহাজতে নিয়ে নির্যাতন করেন হারুনরা।

কাজীরচর ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য শামিম জানান, ছোট ভাইয়ের প্রভাবে ভিন্ন রাজনৈতিক মতের মানুষদের ওপর জুলুম-নির্যাতন, দখল-লুটপাট চালিয়ে নামে-বেনামে সম্পদ গড়েছেন ইউপি চেয়ারম্যান মন্টু বিশ্বাস। সরকারি বরাদ্দের সঠিক বণ্টন এবং উন্নয়ন না করে করেছেন লুটপাট। সরকারি খাল দখল করে ১৫ একর জমির ওপর বানিয়েছেন মাছের ঘের। ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের মুখে ৫ আগস্ট প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করে শেখ হাসিনার দেশত্যাগের পর হারুন বিশ্বাস ও তার ভাই মন্টু বিশ্বাসকে নিয়ে মুখ খুলতে শুরু করেছেন গ্রামের মানুষ।স্থানীয়রা জানিয়েছেন, হারুন বিশ্বাস এলজিআরডি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে থাকা অবস্থায় নানা অনিয়ম এবং নিয়োগ-বাণিজ্যে মেতে ওঠেন। দুর্নীতির মাধ্যমে একই মন্ত্রণালয়ে চাকরি দিয়েছেন ভাগ্নে আরিফুর রহমানকে। বর্তমানে তিনি ভোলা পৌরসভার সচিব পদে কর্মরত। অভিযোগ রয়েছে, ভুয়া সনদে চাকরি নিয়েছেন আরিফুর। এমনকি তার নিয়োগপত্রে স্বাক্ষর রয়েছে হারুন বিশ্বাসের। হারুন তার ভাগ্নে-ভাগ্নি ও জামাইদের চাকরি দিয়েছেন সরকারের বিভিন্ন দপ্তরে। ভাগ্নে শাহাদাৎ হোসেন পলাশকে চাকরি দিয়েছেন বিআরডিবিতে। তিনি বর্তমানে গোপালগঞ্জে সংস্থাটির কর্মকর্তা হিসেবে কর্মরত। ভাগ্নে তৌফিকুর রহমানকে চাকরি দিয়েছেন পুলিশের এসআই পদে। ভাগ্নে মেহেদি হাসান চাকরি পেয়েছেন ঢাকায় সমবায় কর্মকর্তা পদে। ভাগ্নে মুস্তাফিজুর রহমানকেও চাকরি দিয়েছেন পুলিশে। বর্তমানে কুয়াকাটায় ডিবি পুলিশে কর্মরত তিনি। ভাগ্নে শহিদুল ইসলাম মিরাজকে চাকরি দিয়েছেন মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরে। যিনি বর্তমানে ঝালকাঠিতে কর্মরত। ভাগ্নে আরিফুর রহমানকে ঢাকা এলজিইডি, মাসুম ওরফে আগুন গৌরনদী পৌরসভা, ভাগ্নি জামাই মঞ্জিল ওরফে রাতুলকে ঢাকা পাসপোর্ট অফিস (বর্তমানে মালয়েশিয়ায় নিয়োজিত), ভাগ্নি জামাই আরিফুর রহমানকে ভোলা পৌরসভার সচিব পদে চাকরি দিয়েছেন। এ ছাড়া নামে-বেনামে কথিত আত্মীয়-স্বজনদের চাকরি দিয়েছেন হারুন অর রশিদ বিশ্বাস।

জানা গেছে, হারুন বিশ্বাস তার মায়ের নামে শামসুন্নাহার ওয়েলফেয়ার ট্রাস্ট তৈরি করেন। সেই ট্রাস্টের প্রধান পৃষ্ঠপোষক তিনি নিজে। নিজের ক্ষমতায় বাড়ির সামনে সরকারি টাকায় বেগম শামসুন্নাহার ওয়েলফেয়ার সোসাইটি ভবন নির্মাণ করেন তিনি। সরকারি টাকায় নির্মিত সেই ভবনটি এখন নিজেদের বসতবাড়ি হিসেবে ব্যবহার করছেন হারুনের বড় ভাই মন্টু বিশ্বাস। এ ছাড়া ভবন নির্মাণের টাকায় ভাগ বসানোর অভিযোগ রয়েছে ট্রাস্টের সভাপতি মন্টু বিশ্বাস এবং তার কথিত ভাতিজা ও সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক কবির হোসেনের বিরুদ্ধে। ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, ট্রাস্টের নামে একটি স্কুল নির্মাণ করা হয়েছে। স্কুল নির্মাণ করতে দখল করা হয়েছে স্থানীয় শাহ আলম হাওলাদার ও রশিদ মৃধার জমি। দখলে বাধা দিতে গিয়ে নির্যাতন এবং পুলিশি হয়রানির শিকার হন তারা।অভিযোগ রয়েছে, ‘বঙ্গবন্ধু মডেল গ্রাম’ প্রকল্পের নামেও লুটপাট করেছেন হারুন ও মন্টু বিশ্বাস। জমি ক্রয় করে মডেল গ্রামের নামে ‘মডেল ভবন’ নির্মাণের কথা থাকলে তা করা হয়নি। বরং সরকারি খাল দখল করে মডেল ভবন নির্মাণ করে আত্মসাৎ করেছেন জমি ক্রয়ের জন্য বরাদ্দের টাকা। কাজীরচর ইউনিয়নের চরকমিশনার কলমখাঁর মোড় এলাকায় গণকবরস্থানের নামে দখল করেছেন বহু মানুষের ফসলি জমি। সেইসঙ্গে সরকারি খাসজমিতে বালু ভরাট করে আত্মসাৎ করেছেন কোটি টাকা। এমনকি গণকবরের নামে মানুষের জমি দখল করা হলেও সেখানে করা হয়েছে ‘বঙ্গবন্ধু মডেল গ্রাম’-এর ‘মডেল ভবন’।

এদিকে, হারুন বিশ্বাসের কথিত ভাতিজা কবির হোসেন একসময়ে সর্বহারা পার্টির সদস্য ছিলেন। হারুন বিশ্বাসের ভাই মন্টু বিশ্বাসের দুর্নীতি এবং লুটপাটের সহযোগী হয়ে কাজ করছেন তিনি। এমনকি ‘বঙ্গবন্ধু মডেল গ্রাম’ কমিটিতে সাধারণ জনগণকে অন্তর্ভুক্ত না করে নিজেদের অনুগত লোকদের সদস্য করা হয়েছে। সভাপতি করা হয়েছে মন্টু বিশ্বাস এবং সম্পাদক করা হয়েছে কবির হোসেনকে। অভিযোগ রয়েছে, ‘বঙ্গবন্ধু মডেল গ্রামে’র নামে লোন বরাদ্দের নামে অসহায় গ্রামবাসীর কাছ থেকে টাকা আত্মসাৎ করেন সংস্থার সভাপতি এবং সম্পাদক। এ ছাড়া মানুষের লোনের টাকা আত্মসাৎ করে তা লাগিয়েছেন মাছের ঘের, গরুর খামারসহ ব্যক্তিগত কাজে। এমনকি ক্ষমতার অপব্যবহার করে নিজের মামা দেলোয়ার হোসেন রাঢ়িকে মুলাদী উপজেলার পার্শ্ববর্তী বাবুগঞ্জ উপজেলার চাঁদপাশা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান বানিয়েছেন। তিনি আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী হিসেবে চেয়ারম্যান পদে নির্বাচন করেন।

প্যাদারহাট বাজারের কাছে ৬ নম্বর ওয়ার্ডে জলিল সিকদারের জমি দখলের অভিযোগ রয়েছে মন্টু বিশ্বাসের বিরুদ্ধে। নিজের সন্ত্রাসী বাহিনী দিয়ে সেই জমিতে থাকা জলিলের ঘর রাতে ভেঙে দিয়ে মন্টু বিশ্বাস সেখানে দ্বিতীয় স্ত্রীকে নির্মাণ করে দিয়েছেন বহুতল ভবন।

সূত্র জানায়, আওয়ামী লীগের আমলে অঢেল সম্পদ গড়েছেন হারুন বিশ্বাস। ঢাকা ও বরিশালে গ্রামের বাড়িতে নিজের এবং স্বজনদের নামে রয়েছে এসব সম্পদ। এর মধ্যে ঢাকার কল্যাণপুরে হারুন বিশ্বাসের রয়েছে ৪টি ফ্ল্যাট ও ঢাকার সাগুপ্তায় ২০ কাঠা জমি। হারুন বিশ্বাস ও মন্টু বিশ্বাস প্যাদারহাট ওয়াহেদিয়া মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের জমি এবং নিয়োগ-বাণিজ্য করে প্রায় ৩ কোটি টাকা আত্মসাৎ করেন। মন্টু বিশ্বাস দক্ষিণ কাজীরচর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে নিয়োগ-বাণিজ্য করে ১ কোটি টাকা হাতিয়ে নেন। তিনি চেয়ারম্যান নির্বাচিত হওয়ার পরে মুলাদী থানার ৭ নম্বর কাজীরচর ইউনিয়নে প্রায় ২০০ বিঘা জমি ক্রয় করেন। মন্টু বিশ্বাসের মাছের ঘের ও গরুর খামার আছে। প্যাদারহাট বাজারে অন্যের জমি দখল করে তিনটি বহুতল ভবন নির্মাণ করেছেন। পার্শ্ববর্তী ইউনিয়নে হায়েতসার মৌজায় রতন ডাকাতের ছেলেদের জিম্মি করে প্রশাসনের ভয় দেখিয়ে ঘরবাড়িসহ প্রায় ২২ বিঘা সম্পত্তি তার নিজের নামে দলিল করে নেন। ওখানে আরও প্রায় ৩০ বিঘা জমি জোরপূর্বক দখল করে রাখেন মন্টু বিশ্বাস।

চরকমিশনারের নুরু মাতুব্বরের বাড়ির পাসে ৪ বিঘা জমি তিনি ক্রয় করেন। পার্শ্ববর্তী উপজেলা বাবুগঞ্জের কৃষ্টরুদ্র মৌজায় বাড়িসহ প্রায় ৩ একর জমি প্রশাসনের ভয় দেখিয়ে দখল করেন মন্টু বিশ্বাস। বরিশাল বিএম কলেজ এলাকায় কোটি টাকার জমি ক্রয় করেছেন হারুন ও মন্টু বিশ্বাস।

এসব অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগের বিষয়ে মন্তব্যের জন্য সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর পিএস হারুন বিশ্বাসের মোবাইল ফোনে কল করেও পাওয়া যায়নি। তবে ইউপি চেয়ারম্যান মন্টু বিশ্বাস অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। তিনি বলেন, যত সম্পত্তি তারা গড়েছেন তার সবকিছুই নিজেদের ব্যবসা-বাণিজ্যের টাকায় করেছেন। তবে তাদের দৃশ্যমান যত সম্পদ রয়েছে সেগুলো আওয়ামী লীগ সরকারের ১৬ বছরেই করেছেন বলে স্বীকার করেন মন্টু বিশ্বাস।