ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার পতনের পর পরিবর্তিত রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে যে কোনো মূল্যে দেশে সম্প্রীতি রক্ষা, লুটপাট, চাঁদাবাজি, দখলদারিত্ব বন্ধসহ শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখতে কঠোর অবস্থান গ্রহণ করে বিএনপি। শুরু থেকেই অপকর্ম-নৈরাজ্যের বিরুদ্ধে অবলম্বন করে ‘জিরো টলারেন্স নীতি’। দল কিংবা দলের নাম ব্যবহার করে অপকর্মের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে এরই মধ্যে সারা দেশে বিএনপি ও অঙ্গসহযোগী সংগঠনের সাড়ে তিন শতাধিক নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে বহিষ্কার, পদ স্থগিত কিংবা এ ধরনের কঠোর সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া অনেককে শোকজ করা হয়েছে। এই তালিকায় গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রীয় নেতারাও রয়েছেন। এর ফলে পরিস্থিতির আশানুরূপ উন্নতি হয়েছে বলে দাবি বিএনপির। তবে হাইকমান্ডের শতভাগ আন্তরিকতা এবং দলের কঠোর অবস্থান সত্ত্বেও কিছু নেতাকর্মীর নেতিবাচক অপকর্ম পুরোপুরি বন্ধ হয়নি। এ কারণে ‘উচ্ছৃঙ্খল’ নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে এবার সাংগঠনিক ব্যবস্থার পাশাপাশি আইনি পদক্ষেপ গ্রহণের সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিএনপির হাইকমান্ড। অপকর্মে জড়িত থাকার দায়ে ইতোমধ্যে এক নেতার বিরুদ্ধে থানায় এজাহারও দায়ের করা হয়েছে। এ ছাড়া যুবদলের পক্ষ থেকে আরেকজনের নামে সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করা হয়েছে। জানা গেছে, দল কিংবা দলের নাম ব্যবহার করে চাঁদাবাজি-দখলদারিসহ নানা অপকর্মে জড়িতদের বিষয়ে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহে বিশেষ সেল গঠন করেছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। তদন্ত সাপেক্ষে সেলের সদস্যদের রিপোর্টের ভিত্তিতে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ গ্রহণ করছেন তিনি। বিএনপির হাইকমান্ডের পক্ষ থেকে ইতোমধ্যে সারা দেশের নেতাদের কাছে এই বার্তা পৌঁছে দেওয়া হয়েছে। শিগগির ‘উচ্ছৃঙ্খল’ নেতাদের বিরুদ্ধে দলের পক্ষ থেকে আইনি পদক্ষেপ নেওয়া হবে বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন।
জানতে চাইলে বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব সৈয়দ এমরান সালেহ প্রিন্স বলেন, ‘পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে কিছু ব্যক্তি বিএনপির নাম ব্যবহার করে অনৈতিক কাজে লিপ্ত রয়েছে বলে অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে। দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানসহ দলীয় নেতৃত্ব এ বিষয়ে সবাইকে বারবার সতর্ক করে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিয়েছেন।’তিনি বলেন, ‘বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান এসব অপকর্মের সঙ্গে জড়িত, দলের ভাবমূর্তি বিনষ্টকারীদের বিরুদ্ধে এখন শুধু সাংগঠনিক শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নয়, তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থাও নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। নেতাকর্মীদের ১৫ বছরের আত্মত্যাগ এবং কমিটমেন্ট কিছু ব্যক্তির অপকর্মের জন্য প্রশ্নবিদ্ধ হতে পারে না। তাদের দায় দল নেবে না।’
প্রিন্স আরও বলেন, ‘যারা এতদিন দলের সঙ্গে থেকে প্রভাব, সুনাম কিংবা পরিচিতি অর্জন করে এখন আবার নানা অপকর্মের সঙ্গে জড়িত হয়ে দলকে বিপদের মধ্যে ফেলবেন, দলের ভাবমূর্তি নষ্ট করবেন—আমরা তাদের এভাবে ছেড়ে দেব না। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানসহ দলের হাইকমান্ড এ বিষয়ে ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি অবলম্বন করছেন।’
গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর থেকেই দেশের বিভিন্ন স্থানে বিএনপি ও এর অঙ্গসংগঠনের অনেক নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে জমি দখল, দোকান ও মার্কেটে চাঁদাবাজি এবং প্রতিপক্ষের ওপর হামলাসহ নানা অপকর্মের অভিযোগ আসছে। কেন্দ্রীয় কয়েকজন শীর্ষ নেতার বিরুদ্ধেও এমন অভিযোগ উঠেছে। দলটির দায়িত্বশীল নেতারা বলছেন, যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠছে, তাদের মধ্যে পদধারী নেতা খুবই কম। বেশিরভাগই হাইব্রিড এবং দলে অনুপ্রবেশকারী। যারা এতদিন দলের দুর্দিনে পাশে ছিল না, পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে তারাই রাতারাতি দলের নাম ভাঙিয়ে অপকর্মে জড়িয়ে বিএনপির ভাবমূর্তি-সুনাম ক্ষুণ্ন করছে। এসব ব্যাপারে সারা দেশে দলের নেতাকর্মী ও সাধারণ মানুষকে সতর্ক থাকার আহ্বান জানানো হয়েছে। একই সঙ্গে কেউ যদি কোথাও দলের নাম ভাঙিয়ে অপকর্ম করে, তাকে ধরে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে তুলে দেওয়া এবং দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতাদের জানাতে বলা হয়েছে।
দলটির নেতারা বলছেন, নৈরাজ্য-অপকর্ম বন্ধে বিএনপির ‘জিরো টলারেন্স’ নীতির আলোকে ইতোমধ্যে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে শোকজসহ সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। সম্প্রতি বিএনপির স্থায়ী কমিটির একজন সদস্য এবং একজন যুগ্ম মহাসচিবকে শোকজ করা হয়েছে। এ ছাড়া বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য রুহুল কুদ্দুস তালুকদার দুলুর পদাবনতি ঘটিয়ে দলের কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য করা হয়েছে। দলের বরিশাল বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক বিলকিস জাহান শিরিন, ফরিদপুর (সাংগঠনিক) বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক শামা ওবায়েদ এবং জাতীয়তাবাদী কৃষক দলের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক শহিদুল ইসলাম বাবুলের পদ স্থগিত করা হয়েছে। চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা বিএনপির কমিটি বিলুপ্ত করা হয়েছে। একই সঙ্গে চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা বিএনপির সাবেক আহ্বায়ক আবু সুফিয়ান, প্রথম যুগ্ম আহ্বায়ক মো. এনামুল হক এনাম ও আহ্বায়ক কমিটির সদস্য এসএম মামুন মিয়ার প্রাথমিক সদস্যসহ সব পর্যায়ের পদ স্থগিত করা হয়েছে। আলোচিত এস আলম গ্রুপের ১৪টি বিলাসবহুল গাড়ি সরিয়ে নিতে সহযোগিতার অভিযোগে কপাল পুড়েছে চট্টগ্রামের এসব নেতার। এদিকে অপকর্মে জড়িত থাকার দায়ে হাইকমান্ডের সিদ্ধান্তে সম্প্রতি ময়মনসিংহে বিএনপির এক নেতার বিরুদ্ধে দলের পক্ষ থেকে আইনি পদক্ষেপ নেওয়া হয়। বিএনপির নাম ব্যবহার করে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে অনৈতিক সুবিধা আদায়ের অভিযোগে ময়মনসিংহ দক্ষিণ জেলা শাখার যুগ্ম আহ্বায়ক ও ভালুকা উপজেলা শাখার আহ্বায়ক ফখরুদ্দিন আহমেদ বাচ্চুকে প্রথমে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়। এরপর গত সোমবার বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের নির্দেশে দলের পক্ষে যুগ্ম মহাসচিব সৈয়দ এমরান সালেহ প্রিন্স ভালুকা থানায় বাচ্চুসহ অজ্ঞাতপরিচয় ১৫ থেকে ২০ জনের বিরুদ্ধে লিখিত এজাহার দায়ের করেন। এজাহারে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য অনুরোধ করা হয়েছে।
যুবদলের সভাপতি আব্দুল মোনায়েম মুন্না ও সাধারণ সম্পাদক নুরুল ইসলাম নয়নসহ তিন নেতার নাম ব্যবহার করে কাওসার শিকদার মনির নামে একজন মতিঝিল এলাকায় এনসিসি ব্যাংকসহ বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠানে চাঁদা দাবি করছে বলে অভিযোগ পায় সংগঠনটি। এরপর যুবদলের পক্ষে গত সোমবার সংগঠনের সাবেক কেন্দ্রীয় সহ-আইনবিষয়ক সম্পাদক মো. জিল্লুর রহমান পল্টন মডেল থাকায় মনিরের বিরুদ্ধে একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন, যার নং ১৫২।
যুবদলের কোনো নেতাকর্মীর কোনো নৈরাজ্য-অপকর্ম বরদাশত করা হবে না বলে কঠোর হুঁশিয়ারি দিয়েছেন সংগঠনের সভাপতি আব্দুল মোনায়েম মুন্না। তিনি বলেন, ‘যারাই দলের নাম ব্যবহার করে অপকর্ম করবে কিংবা নৈরাজ্য-অপকর্মের সঙ্গে জড়িত থাকবে, তিনি যেই হোন না কেন, তার বিরুদ্ধে কঠোর সাংগঠনিক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে; সংগঠন থেকে আজীবনের জন্য বহিষ্কার করা হবে।’জানা গেছে, নানা অপকর্মে জড়িত থাকার অভিযোগে এখন পর্যন্ত যুবদলের পঞ্চাশের অধিক নেতা, স্বেচ্ছাসেবক দলের প্রায় অর্ধশত নেতা এবং ছাত্রদলের ৬০-৬৫ জনের মতো নেতাকে বহিষ্কার করা হয়েছে। এ ছাড়া এই তিন সংগঠনের আরও শতাধিক নেতাকে শোকজ করা হয়েছে।
জানতে চাইলে ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক নাছির উদ্দীন নাছির বলেন, ‘বিদ্যমান পরিস্থিতিতে যে কোনো নৈরাজ্য বন্ধ এবং শান্তি-শৃঙ্খলা বজায়ে জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি অবলম্বন করছে। কারও বিরুদ্ধে সামান্য অভিযোগ পেলেও সঙ্গে সঙ্গেই তা তদন্ত করা হচ্ছে। ২৪ ঘণ্টা এমনকি আরও কম সময়ের মধ্যেও অভিযোগের নিষ্পত্তি করা হচ্ছে। কেউ জড়িত থাকলে তার বিরুদ্ধে কঠোর সাংগঠনিক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে।’বিএনপির কেন্দ্রীয় এক নেতা জানিয়েছেন, বিভিন্ন অপকর্মে জড়িত থাকার দায়ে এখন পর্যন্ত দলের দুই শতাধিক নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে সাংগঠনিক শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। এদিকে অপকর্মে জড়িতদের কাছ থেকে বন্যার্তদের সহায়তায় ত্রাণসামগ্রীও নিচ্ছে না বিএনপি। সম্প্রতি বন্যার্তদের জন্য নয়াপল্টনে দলের কেন্দ্রীয় ত্রাণ তহবিলে জমা দেওয়া বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা পরিষদের ‘বহিষ্কৃত’ সদস্য ও সাবেক এমপি সৈয়দ একে একরামুজ্জামানের ১০ লাখ টাকা ফেরত দেওয়া হয়। অনুরূপ পদক্ষেপ নেওয়া হয় ময়মনসিংহ দক্ষিণ জেলা বিএনপির ‘বহিষ্কৃত’ যুগ্ম আহ্বায়ক ফখরুদ্দিন আহমেদ বাচ্চুর ক্ষেত্রেও। দলের ত্রাণ তহবিলে জমা দেওয়া তার ১০ লাখ টাকাও ফেরত দেয় বিএনপির কেন্দ্রীয় ত্রাণ সংগ্রহ কমিটি।