কলকাতায় খুন হওয়া আওয়ামী লীগের সাবেক এমপি আনোয়ারুল আজীম আনার হত্যাকাণ্ডের জট এখন পর্যন্ত খুলতে পারেনি দুই দেশের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী। এ ঘটনায় দুই দেশে ১১ জন গ্রেপ্তার হয়েছে। তবে এমপি আনারের ভারতীয় বন্ধু গোপাল বিশ্বাস ও বাংলাদেশে সোনা চোরাচালানের সঙ্গে সম্পৃক্ত দিলীপ কুমার আগরওয়ালা রয়েছেন ধরাছোঁয়ার বাইরে।সূত্র বলছে, সংসদ সদস্য আনার হত্যা মামলা তদন্তে ডায়মন্ড ওয়ার্ল্ডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) দিলীপ কুমার আগারওয়ালার নাম বেরিয়ে এলেও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের হস্তক্ষেপে তাঁর নাম প্রকাশ্যে আনেননি গোয়েন্দারা।ফলে হত্যার মূল পরিকল্পনাকারী দিলীপ আইনের আওয়ায় আসেননি। জানা যায়, চলতি বছরের ১২ মে চিকিৎসার জন্য কলকাতার বরাহনগর এলাকার মণ্ডলপাড়া লেনে বন্ধু গোপাল বিশ্বাসের বাড়িতে ওঠেন সাবেক সংসদ সদস্য আনার। পরের দিন দুপুরে গোপালের বাড়ি থেকে বেরিয়ে যান আনার। তারপর থেকে রহস্যজনকভাবে নিখোঁজ ছিলেন এমপি আনার। গোপালের আদি নিবাস বাংলাদেশ। গোপাল বিশ্বাস ভারতে স্বর্ণের ব্যবসা করেন। সেই সুবাদে আনারের সঙ্গে দীর্ঘদিনের ঘনিষ্ঠতা তাঁর। বেশ কয়েকবার বাংলাদেশে এসেছেন গোপাল বিশ্বাস।
সে সময় দিলীপ আগরওয়ালার চুয়াডাঙ্গা ও ঢাকার বাসায় উঠেছেন বলে স্থানীয় একাধিক গোয়েন্দা সূত্র দাবি করেছে।অনুসন্ধানে জানা যায়, যশোরের চৌগাছা, ঝিনাইদহের মহেশপুর, চুয়াডাঙ্গার জীবননগর ও দর্শনা সীমান্তে দুই দশকের বেশি সময় ধরে চোরাচালানের একক আধিপত্য ছিল কলকাতায় খুন হওয়া ঝিনাইদহ-৪ আসনের আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজিম আনারের। আনারের হাত ধরে চোরাচালান ব্যবসায় বিনিয়োগ করেন অনেকেই। তার মধ্যে ডায়মন্ড ওয়ার্ল্ডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) দিলীপ কুমার আগারওয়ালা, যশোর-৬ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য শাহীন চাকলাদার ও ঝিনাইদহ জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সাইদুল করিম মিন্টু। হঠাৎ করে ২০২০ সালের দিকে সীমান্তে নিয়মিত তাঁদের সোনার চালান জব্দ করতে থাকে বিজিবি।
অদৃশ্য কারণে সাবেক এমপি আনারের চালানগুলো থেকে যায় ধরাছোঁয়ার বাইরে। তখন সীমান্তের ওই এলাকাগুলো নিজেদের বলয় তৈরি করতে একের পর এক কৌশল বেছে নেয় দিলীপ আগারওয়ালার নেতৃত্বে একটি সিন্ডিকেট। তবে কোনো কৌশলই যখন কাজ করছিল না, তখন আনারের বাল্যবন্ধু ও ব্যাবসায়িক অংশীদার যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী আক্তারুজ্জামান শাহীনকে বাগিয়ে নেন তাঁরা। এরপর সীমান্তে নিজেদের আধিপত্য জানান দিতে ওই এলাকার সংসদ নির্বাচন, উপজেলা, পৌরসভা এমনকি ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে নিজেদের পছন্দের প্রাথীদের দাঁড় করিয়ে বিপুল অর্থ বিনিয়োগ করে তাঁদের পাস করিয়ে আনা হয়।স্থানীয় গোয়েন্দা সূত্র বলছে, ২০১৯ থেকে ২০২৪ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত চৌগাছা, মহেশপুর ও জীবননগর সীমান্তে প্রতিনিয়ত সোনা জব্দ করছিল বিজিবি; যার বেশির ভাগই ছিল দিলীপ সিন্ডিকেটের।
সীমান্তে নিজের একক আধিপত্য গড়ে তুলতে ২০২৪-এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হতে না পেরে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করেন দিলীপ আগরওয়ালা। চুয়াডাঙ্গা সদর আসনের সাবেক সোলায়মান হক জোয়ার্দার ওরফে সেলুন জোয়ার্দারের সঙ্গে আনারের ঘনিষ্ঠতা থাকায় ওই নির্বাচনে সুবিধা করতে পারেননি দিলীপ। নির্বাচনে পরাজিত হয়েই আনারকে হত্যার পরিকল্পনা শুরু করে দিলীপ সিন্ডিকেট। ঢাকার অভিজাত এলাকা উত্তরা, বনানী ও ঝিনাইদহের কোর্টচাঁদপুরের আলোচিত শাহীনের বাংলোবাড়িতে একাধিকবার বৈঠক করেন সিন্ডিকেটের সদস্যরা। তবে টানা তিনবারের এমপি আনারের প্রশাসনের সঙ্গে বিশেষ সখ্য থাকার ফলে ওই সিন্ডিকেট পেরে উঠছিল না। তাই কলকাতায় হত্যার পরিকল্পনা শুরু করে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক জেলা আওয়ামী লীগের পলাতক এক নেতা বলেন, ‘ভারতীয় স্বর্ণ ব্যবসায়ী গোপাল বিশ্বাসের সঙ্গে আমাদের দেশের ব্যবসায়ী দিলীপ আগরওয়ালার ভালো সম্পর্ক ছিল। এমপি আনার হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত যে কজন গ্রেপ্তার হয়েছে, তাঁদের অনেকের সঙ্গে দিলীপের বেশ সখ্য ছিল। ফলে দিলীপকে আটক করে জিজ্ঞাসাবাদ করলে এ হত্যাকাণ্ডের অনেক কিছু বের হয়ে আসবে। এ বিষয়ে জানতে দিলীপ কুমার আগরওয়ালার মোবাইলে ফোন করলে সেটি বন্ধ পাওয়া যায়। তাঁর ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান রাজধানীর ডায়মন্ড ওয়ার্ল্ড ও চুয়াডাঙ্গার বাড়িতে গিয়েও তাঁকে পাওয়া যায়নি।