দেশে শিক্ষার্থীদের ওপর চলমান গ্রেপ্তার, নির্যাতন রুখে দাঁড়াতে অভিভাবকদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে বিক্ষুব্ধ নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা৷ ডিবি হেফাজতে থাকা বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ৬ সমন্বয়ককে মুক্তি দিতে ২৪ ঘণ্টার আল্টিমেটাম ঘোষণা দেয়াসহ ১১ দফা দাবিও জানিয়েছেন তারা। সমন্বয়কারীদের না ছাড়া হলে ডিবি অফিসের সামনে কর্মসূচি পালন করা হবে বলেও নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা জানিয়েছেন৷মঙ্গলবার (৩০ জুলাই) দুপুরে রাজধানী ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির সাগর-রুনী মিলনায়তনে বিক্ষুব্ধ নাগরিক সমাজ আয়োজিত ‘হত্যা, অবৈধ আটক ও নির্যাতনের বিচার চাই’ শীর্ষক সংবাদ সম্মেলনে এসব দাবি ও আহ্বান জানান নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা। সংবাদ সম্মেলনে এএলআরডির নির্বাহী পরিচালক শামসুল হুদা বলেন, বিগত পনের বছর ধরে অনেক অন্যায়-অনাচার মুখ বুজে সহ্য করেছি। এনাফ ইজ এনাফ, এই কথা বলার সময়ও অনেক আগে পার হয়ে গেছে। এখন আমাদের সন্তানদের নির্বিচারে হত্যা করা হচ্ছে আমাদেরই ট্যাক্সের পয়সায় কেনা গুলি দিয়ে। সারা বাংলাদেশের যত অভিভাবক আছেন আজকে তাদের রুখে দাঁড়ানোর দিন। ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর স্ত্রী মানবাধিকার কর্মী শিরীন হক বলেন, গণস্বাস্থ্য হাসপাতালে চিকিৎসাধীন সমন্বয়কদের সরকারের পাঁচটি বাহিনীর লোকজন অপারেশন চালানোর মতো করে হাসপাতালের স্টাফদের জোর করে সরিয়ে নিয়ে যায়। পরে এসে জোর করে রিলিজ অর্ডার নেয়। শিক্ষার্থীদের যারা মারলো, তারা বলছে তারা নাকি নিরাপত্তা দেওয়ার জন্য নিয়েছে। আজকে এই প্রোগ্রামে নাহিদ ইসলামের মা ও স্ত্রীর উপস্থিত থাকার কথা ছিল। কিন্তু ডিবি থেকে তাদেরকে এখানে আসতে মানা করা হয়েছে। এ থেকেই বোঝা যায়, ডিবি অফিসে আসলে কি হচ্ছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক গীতি আরা নাসরীন বলেন, আমি শিক্ষক হিসেবে কীভাবে আমাদের ছাত্রদের মুখোমুখি হব তা আমি জানি না। আমরা ওদের নিরাপত্তা দিতে পারি নাই। একটা সিস্টেম কতটা নষ্ট হলে ২০২৪ সালে এসে একজন শিক্ষার্থীকে ১৯৬৯ সালের একজন শিক্ষকের কথা মনে করতে হয়।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মির্জা তাসলিমা সুলতানা বলেন, আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আরিফ সোহেল। ১৮ তারিখ ও ক্যাম্পাসে মিছিল করছে এরকম অনেক ছবি-ভিডিও আছে। কিন্তু ওকে ঢাকার একটি স্থাপনায় হামলার মামলায় রিমান্ড দেওয়া হয়েছে৷ এ থেকে তো বোঝা যায় সরকার কি করছে। সরকার বাংলাদেশের স্পিরিট এবং সংবিধান, আইন সব নষ্ট করে ফেলেছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক সামিনা লুৎফা বলেন, আমাদের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর আন্দোলনের ইতিহাস পুরাতন। কিন্তু এবার বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের যে প্রতিরোধ তা অনবদ্য। স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা যে সাহস দেখিয়েছে, তা আমাদের সাহস দিয়েছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আসিফ নজরুল বলেন, আজকে দেশের তরুণদের বিরুদ্ধে কিছু গত হওয়া ৭০-৮০ বছরের মন্ত্রীদের লেলিয়ে দেওয়া হয়েছে, যারা এই হত্যাকাণ্ডের জন্য দায়ী। শুধু স্থাপনা ধ্বংসের কথা বলে, কেউ তো এখনো কাউকে কোনো হত্যাকাণ্ডের জন্য গ্রেপ্তার করল না। তার মানে নিশ্চয়ই আপনি (প্রধানমন্ত্রী) খুনি, তাই এর বিচার করছেন না। সাইদের মৃত্যু নাকি ইটের আঘাতে হয়েছে বলছে পুলিশ। মশকরা করেন? আমরা দেখি নাই কি হয়েছে? এসব করে মানুষের ক্ষোভ আরও উসকে দিচ্ছেন আপনারা।
প্রধানমন্ত্রীকে উদ্দেশ্য করে আসিফ নজরুল আরও বলেন, আপনার সৌভাগ্য মানুষ এখনও আপনার পদত্যাগের দাবিতে গণ আন্দোলন শুরু করেনি। কিন্তু মনে হয় না সেই সৌভাগ্য আপনার বেশিদিন থাকবে। আজকে যারা আন্দোলন করছে, বুকে গুলি খাচ্ছে তারাই মুক্তিযোদ্ধা। আর যারা বুকে গুলি করলো এবং তাদের যারা অনুমতি দিল তারাই ২০২৪ সালের রাজাকার।
সংবাদ সম্মেলনে শেষে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, সরকার ভুলে গেছে বাকস্বাধীনতা, মত প্রকাশ, বৈষম্যের বিরুদ্ধে আন্দোলন মানুষের সাংবিধানিক অধিকার। ক্ষমতার ভিত্তি না থাকলে সরকার গণবিরোধী অবস্থানে চলে যায়। এখানেও তাই হয়েছে। রাষ্ট্রকে একটি নজরদারিভিত্তিক রাষ্ট্রে পরিণত করা হয়েছে। আজকে কার কাছে বিচার চাইছি? আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কাছে? বাংলাদেশে এমন কোনো অপরাধ নেই যার সঙ্গে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার লোকবল জড়িত না। এ সময় ডিবি হেফাজতে থাকা আন্দোলনের সমন্বয়কদের মুক্তি দিতে ২৪ ঘণ্টার আল্টিমেটাম ঘোষণা দেন তিনি।
ইফতেখারুজ্জামান বলেন, আমরা ডিবি কর্তৃপক্ষকে ২৪ ঘণ্টা সময় দিচ্ছি। এই ২৪ ঘণ্টার মধ্যে যাদের আটক করে আনা হয়েছে, ধরে নেয়া হয়েছে, সেটা বন্ধ করা ও তাদের যদি নিঃশর্ত মুক্তি দেয়া না হয়, তাহলে বাংলাদেশের নাগরিকদের পক্ষ থেকে আরও কঠোর আন্দোলনে আমরা ঝাপিয়ে পড়বো। আজই ডিবি কার্যালয়ে যাওয়ার কথা ছিল। সেই কর্মসূচি স্থগিত করে সভা থেকে এই আল্টিমেটাম দেওয়া হলো।
অনুষ্ঠানে ডিবি প্রতিনিধি উপস্থিত থাকতে পারেন, এমন ধারণা থেকে ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ডিবি প্রতিনিধি যারা আছেন, আপনারা আপনাদের অফিসকে আমাদের এই বক্তব্য জানাবেন।
সংবাদ সম্মেলনের লিখিত বক্তব্য তুলে ধরেন আইনজীবী ও মানবাধিকারকর্মী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান। তিনি বলেন, একটি শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে এমন বিপুল সংখ্যক হতাহতের নজির গত ১০০ বছরের ইতিহাসে আমাদের দেশে বা উপমহাদেশের অন্য কোথাও নেই। পুলিশের নির্বিচার গুলিতে নিরস্ত্র আন্দোলনকারী, পানি বিতরণকারী কিশোর, পলায়নরত ছাত্র ও ছাদে খেলতে যাওয়া শিশুর মৃত্যুর যে হৃদয়বিদারক বর্ণনা বিভিন্ন গণমাধ্যমে পাওয়া যাচ্ছে তাতে স্পষ্ট যে বলপ্রয়োগ ও সহিংসতার মাত্রা সকল সীমা অতিক্রম করেছে এবং সাংবিধানিক ও আইনি সকল সুরক্ষা লঙ্ঘিত হয়েছে। গুলি করার ক্ষেত্রে পুলিশের আইন ভঙ্গ করা হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, দেশের বেসামরিক নাগরিকদের শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ দমনের জন্য জাতিসংঘের লোগো সম্বলিত সাঁজোয়া যান রাস্তায় নামানো হয়েছিল, সেনাবাহিনী ও সীমান্ত রক্ষাকারী বাহিনীকে নিয়োজিত করা হয়েছিল, কারফিউ জারি করে দেখামাত্র গুলির নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল এবং হেলিকপ্টার থেকে টিয়ার শেল, সাউন্ড গ্রেনেড ও অভিযোগ মতে গুলি ব্যবহার করা হয়েছিল, যা দেশের ইতিহাসে নজিরবিহীন।
এ সময় ডিবি হেফাজতে থাকা সমন্বয়কদের মুক্তি; কারফিউ প্রত্যাহার ও গণগ্রেপ্তার বন্ধ; নিহত সকল মৃত্যুর সঠিক, স্বচ্ছ তদন্ত ও দোষীদের সর্বোচ্চ আইনানুগ শাস্তি; হতাহত ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অস্ত্রের ব্যবহার ও বল প্রয়োগের বিষয়ে জাতিসংঘের উচ্চ পর্যায়ের বিশেষজ্ঞদের তত্ত্বাবধানে তদন্ত; হতাহত নাগরিকদের পূর্ণাঙ্গ তালিকা প্রকাশ; নিহতের পরিবারকে পর্যাপ্ত ক্ষতিপূরণ ও আহতদের সুচিকিৎসা এবং পুনর্বাসন নিশ্চিত করা; সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়া; ইন্টারনেট ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম পূর্ণ মাত্রায় খুলে দেওয়াসহ ১১ দফা দাবি জানান রিজওয়ানা হাসান।