রাজধানী ঢাকা কিংবা বন্দরনগরী চট্টগ্রামে নয়, মফস্বল শহর সাতক্ষীরায় জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) অফিস সহকারী (পিয়ন) পদে চাকরি করেই বনে গেছেন ‘টাকার কুমির।’ দিনমজুর পরিবারের সন্তানের তকমা মুছে হয়েছেন ধনাঢ্য ব্যবসায়ী। এক সময়ে ভিটেবাড়ি ছাড়া তেমন কোনো সম্পদ না থাকলেও এখন সাতক্ষীরার সবচেয়ে বড় শপিং কমপ্লেক্স, চার তলা বাড়ি, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও বিশাল মাছের ঘেরসহ নামে-বেনামে শতকোটি টাকার সম্পদ গড়ে এলাকার সবাইকে তাক লাগিয়ে দিয়েছেন। আর এসব সম্পদের উৎস নিয়ে যখন কানাঘুষা শুরু করেন স্থানীয়রা, তখনই নিজেকে রক্ষায় স্বেচ্ছায় চাকরিতে ইস্তফা দেন। অতি ধূর্ত এই ব্যক্তির নাম মাহমুদুল ইসলাম। এলাকার লোকজন বলেছেন, অষ্টম শ্রেণি পাশ মাহমুদুল পিয়নের চাকরিতে যোগ দিয়েই যেন ‘আলাদিনের চেরাগ’ হাতে পেয়েছিলেন। সাম্প্রতিক সময়ে সরকারি কর্মকর্তাদের অবৈধ সম্পদ নিয়ে তোলপাড় শুরু হলে বিচলিত মাহমুদুল তার অন্তত ৩০ কোটি টাকার একটি শপিং কমপ্লেক্স বেচে দেওয়ার পাঁয়তারা করছেন। এদিকে তার অবৈধ সম্পদের বিষয়ে দুদকে তিন দফা অভিযোগ জমা পড়লেও অদ্যাবধি নেওয়া হয়নি কোনো ধরনের ব্যবস্থা। অনুসন্ধানে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।
জানতে চাইলে মাহমুদুল ইসলাম বলেন, ‘আমার যেসব সম্পদ আছে সেগুলো আয়কর ফাইলে দেখানো আছে। শতকোটি টাকার সম্পদের তথ্য ঠিক নয়, আমার ৪০ লাখ টাকার মতো সম্পদ আছে।’ বাড়ি, শপিং কমপ্লেক্স, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানসহ সব সম্পদের ফিরিস্তি তুলে ধরে এত সম্পদের দাম কীভাবে মাত্র ৪০ লাখ টাকা তা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘অনেক সম্পদ আমি ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে করেছি। ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে এখনো আমার ঋণের পরিমাণ অন্তত পাঁচ কোটি টাকা।’ ৪০ লাখ টাকার সম্পদ বন্ধক দিয়ে আপনি কীভাবে ৫ কোটি টাকা ঋণ নিলেন-এমন প্রশ্নের কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি তিনি।
দুর্নীতি ঢাকতেই কি আপনি চাকরি থেকে স্বেচ্ছায় অবসর নিয়ে ব্যবসা শুরু করেছেন-এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমার স্ত্রীর নামে আগেই কিছু ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ছিল। আর দুর্নীতি ঢাকতে স্বেচ্ছায় অবসরে যাওয়ার বিষয়টি ঠিক নয়। চাকরি জীবনে আমি জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের প্রধান কার্যালয়, খুলনা, সাতক্ষীরাসহ বিভিন্ন জায়গায় দায়িত্ব পালন করেছি। সাতক্ষীরা থাকাকালে মেয়েদের বিয়ে দেওয়ার কাজে ব্যস্ততার কারণে আমি চাকরি থেকে অবসর নিই।’
জানা গেছে, সাতক্ষীরার তালা উপজেলার নওয়াপাড়া গ্রামের দিনমজুর মৃত শেখ তমেজ উদ্দীনের ৩ ছেলে, ২ মেয়ের মধ্যে মাহমুদুল ইসলাম সবার ছোট। বাবার সঙ্গে এক সময় দিনমজুরির কাজ করতেন। ’৯০-এর দশকে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) অধীনে অফিস সহায়ক (পিয়ন) পদে চাকরিতে যোগ দেন।
প্রথমে তিনি এনবিআর প্রধান কার্যালয়ে ছিলেন। এরপর খুলনা, কুষ্টিয়া হয়ে বদলি হন নিজ জেলা সাতক্ষীরায়। দীর্ঘ এক যুগের বেশি সময় তিনি কর্মরত ছিলেন সাতক্ষীরা শহরের উপকর কমিশনারের (সার্কেল-১৩) কার্যালয়ে (ইনকাম ট্যাক্স অফিস)। সেখানে একজন অতিরিক্ত উপকমিশনারের সঙ্গে সখ্য গড়ে অবৈধ পথে বিপুল অর্থ আয় করেন।
তার ফুলেফেঁপে ওঠার কাহিনি যেন অ্যারাবিয়ান ড্রামা সিরিজ আলিফ লায়লার আলাদিনের আশ্চর্য প্রদীপের চেয়েও অভাবনীয় কিছু। তার সম্পদের অলৌকিক সব কারবার নিয়ে এলাকায় সমালোচনা শুরু হলে চাকরি ২৫ বছর হওয়ামাত্রই তিনি ২০১৭ সালে স্বেচ্ছায় অবসর নেন।
মাহমুদুলের যত সম্পদ : অনুসন্ধানে জানা গেছে, সাতক্ষীরার গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্য কেন্দ্র পাটকেলঘাটার পল্লী বিদ্যুৎ রোডসংলগ্ন এলাকায় নজরকাড়া বহুতল শপিং কমপ্লেক্স নির্মাণ করেছেন মাহমুদুল। ‘বাঁধন শপিং কমপ্লেক্স’ নামের এই ভবনে রয়েছে তার বিভিন্ন ধরনের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান।
১২ শতাংশ জমির ওপর প্রতিষ্ঠিত অত্যাধুনিক শপিংমলটি ২০২১ সালে উদ্বোধন করা হয়। জমি ও মালামালসহ এ খাতে তার বিনিয়োগ অন্তত ৩০ কোটি টাকা।
পাটকেলঘাটা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাশে ৪৭ দাগের ৯ শতাংশ জমিতে তৈরি করেছেন আলিশান চার তলা বাড়ি। বাড়ির পাশ ঘিরে তৈরি করা হয়েছে পাকা পুকুর। ১৭ শতাংশ জায়গায় ওই পাকা পুকুরকে এলাকার লোকজন সুইমিংপুল হিসাবে জানেন। জায়গা কিনে এই বাড়ি করতে তার অন্তত ২০ কোটি টাকা খরচ হয়েছে।
স্ত্রী নাছিমা বেগমের নামে পাটকেলঘাটা বাজারের সবচেয়ে দামি রাজেন্দ্রপুর মৌজার ১৪৯ দাগে ১৭ শতাংশ, ১৫০ দাগে ৮ দশমিক ৫ শতাংশ, ১৪৭ দাগে ৯ শতাংশ ও পাটকেলঘাটা চৌরাস্তা মোড়ে ৮১ দাগে ১ শতাংশ জমি কিনেছেন।
আরও জানা গেছে, কন্যা ঊর্মির নামে পাটকেলঘাটার পাঁচ রাস্তা মোড় এলাকায় গড়ে তুলেছেন ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ‘ঊর্মি এন্টারপ্রাইজ’। রয়েছে মালামাল পরিবহণের বেশ কয়েকটি ট্রাক ও ইটভাটা। অভিযোগ আছে, এই প্রতিষ্ঠানের আড়ালে তিনি চোরাকারবারে জড়িত। এছাড়া ঊর্মির নামে বালিয়াদোহা গ্রামে রয়েছে কয়েক বিঘা জমি।
এলাকার লোকজন জানিয়েছেন, তেঁতুলিয়া ইউনিয়নের নওয়াপাড়া গ্রামে এক সময় মাহমুদুলদের পৈতৃক সম্পত্তি বলতে ভিটাবাড়ি ছাড়া কিছুই ছিল না। তবে পৈতৃক সূত্রে ৮ বিঘা জমি পাওয়ার দাবি করেছেন মাহমুদুল।
কিন্তু বর্তমানে সেখানে তার ২০ বিঘা জমির মাছের ঘের, বিভিন্ন ধরনের মালামাল রাখার একটা গোডাউন ও ৮ বিঘা কৃষি জমির তথ্য পাওয়া গেছে। এর মধ্যে স্থানীয় সিদ্দিক মল্লিকের কাছ থেকে একযোগে ৪ বিঘা জমি নিজের নামে কিনেছেন তিনি।
নিয়মিত মাহমুদুলের পরিবারের গাড়ির মডেল পালটাতে দেখে এলাকাবাসী বিস্ময়ে হতবাক। বিভিন্ন ব্যাংক ও পোস্ট অফিসে মাহমুদুলের নামে-বেনামে সঞ্চয়পত্র, এফডিআরসহ বিপুল অঙ্কের নগদ অর্থ জমা আছে বলে জানা গেছে।
প্রতিবেশীরা জানান, মাহমুদুল ও তার পরিবারের সদস্যরা বিলাসী জীবনযাপন করেন। স্থানীয় সরকার দলের এক নেত্রীর ছেলের সঙ্গে মেয়ে ঊর্মিকে বিয়ে দিয়ে নিজের অবস্থান আরও পোক্ত করেছেন মাহমুদুল। তার প্রভাব এখন এতটাই বেশি যে, দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) লিখিত অভিযোগ জমা দেওয়ার পরও তার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। একাধিকবার দুদকের স্থানীয় কার্যালয়ে তার অবৈধ সম্পদের তথ্য-প্রমাণসহ অভিযোগ জমা পড়েছে।
স্থানীয় এক বাসিন্দা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘তার দুর্নীতি নিয়ে লেখালেখি করায় আমাকে নানাভাবে হয়রানি করা হয়েছে। আমি তার দুর্নীতির খতিয়ান তুলে ধরে সব ডকুমেন্টসহ একাধিকবার দুদকে অভিযোগ জমা দিয়েছি। কিন্তু রহস্যজনক কারণে দুদক কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। চিহ্নিত দুর্নীতিবাজ হিসাবে তিনি এলাকাবাসীর কাছে পরিচিত হলেও যাদের ব্যবস্থা নেওয়ার কথা তারা নীরব।