ঢাকা, বৃহস্পতিবার ৪ই জুলাই ২০২৪ , বাংলা - 

শিক্ষকরাই জানে না ষাণ্মাসিক মূল্যায়ন পদ্ধতি

ষ্টাফ রিপোটার।।ঢাকাপ্রেস২৪.কম

2024-07-01, 12.00 AM
 শিক্ষকরাই জানে না ষাণ্মাসিক মূল্যায়ন পদ্ধতি

নতুন শিক্ষাক্রমে ষষ্ঠ থেকে নবম শ্রেণির ষাণ্মাসিক পরীক্ষার মূল্যায়ন শুরু হচ্ছে ৩ জুলাই। অথচ এখনো শিক্ষার্থীদের দক্ষতা মূল্যায়ন পদ্ধতি চূড়ান্ত করতে পারেনি সরকার। কয়েক দফায় পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে কাঠামো চূড়ান্ত করলেও এখনো তা ঝুলে আছে। ফলে শুরু হতে যাওয়া ষাণ্মাসিক মূল্যায়ন পদ্ধতি নিয়ে ধোঁয়াশায় খোদ শিক্ষকরা। আর কীভাবে মূল্যায়ন করা হবে, তার কিছুই জানেন না শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা। আগের দিন নির্দেশনা পাবেন শিক্ষকরা এ কথা জানিয়েছে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) বলছে, ষাণ্মাসিক মূল্যায়ন প্রতিষ্ঠানভিত্তিক। এখানে চূড়ান্ত মূল্যায়ন পদ্ধতির খুব একটা প্রয়োজন নেই। প্রতিটি বিষয়ে মূল্যায়নের আগের দিন রাতে সেই বিষয় নিয়ে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা পাবেন শিক্ষকরা। বাৎসরিক সামষ্টিক মূল্যায়নে চূড়ান্ত পদ্ধতি শিগগির জানিয়ে দেওয়া হবে।

এনসিটিবির সিদ্ধান্তে ‘নাখোশ’ শিক্ষকরা 

এনসিটিবির এমন সিদ্ধান্তে ‘নাখোশ’ শিক্ষকরা। তারা বলছেন, নতুন শিক্ষাক্রমে ষাণ্মাসিক মূল্যায়নও সমান গুরুত্বপূর্ণ। বছরের শেষে এ মূল্যায়নের কিছু অংশও বাৎসরিক সামষ্টিক মূল্যায়নে যোগ হবে। তাছাড়া মূল্যায়নের আগের রাতে দেওয়া নির্দেশনার ভিত্তিতে পরদিন মূল্যায়ন করা শিক্ষকদের জন্য খুব কঠিন কাজ।

সমালোচনার মুখে আগের সিদ্ধান্ত বাতিল
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ‘জাতীয় শিক্ষাক্রম রূপরেখা-২০২১’ অনুযায়ী- ২০২৩ সালে প্রথম, ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণিতে বাস্তবায়ন করা হয়েছে। চলতি বছর দ্বিতীয়, তৃতীয়, অষ্টম ও নবম শ্রেণিতে চালু হয়েছে নতুন শিক্ষাক্রম। ২০২৫ সালে পঞ্চম ও দশম শ্রেণিতে, ২০২৬ সালে একাদশ এবং ২০২৭ সালে দ্বাদশ শ্রেণিতে এ পদ্ধতি চালু হবে। 
২০২২ সাল থেকে নতুন এ শিক্ষাক্রমের মূল্যায়ন পদ্ধতি নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা শুরু করে এনসিটিবি। প্রচলিত নম্বর ও গ্রেডিং পদ্ধতি বাতিল করে প্রথমে ত্রিভুজ, বৃত্ত, চতুর্ভুজ দিয়ে শিক্ষার্থীর দক্ষতা মূল্যায়ন শুরু হয়। তীব্র সমালোচনার মুখে তা থেকে পিছু হটে সরকার। শিক্ষামন্ত্রীর দায়িত্ব নিয়ে মূল্যায়ন পদ্ধতিতে পরিবর্তন আনার ঘোষণা দেন মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল। গঠন করেন উচ্চপর্যায়ের কমিটিও।

খসড়া মূল্যায়ন পদ্ধতি আটকা মন্ত্রণালয়ে
সেই কমিটির মতামতের ভিত্তিতে বিভিন্ন পর্যায়ে মূল্যায়নের খসড়া চূড়ান্ত করে এনসিটিবি। পরে সেটি অনুমোদনের জন্য শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়। এখন মন্ত্রণালয় মূল্যায়ন পদ্ধতি ‘জাতীয় শিক্ষাক্রম সমন্বয় কমিটির (এনসিসিসি)’ সভায় উপস্থাপন করবে। সেখান থেকে চূড়ান্ত অনুমোদন হলে সেটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পাঠানো হবে। তবে দুই মাস ধরে মূল্যায়ন পদ্ধতির খসড়া মন্ত্রণালয়ে আটকা।
যা বলছেন এনসিটিবি চেয়ারম্যান
জানতে চাইলে এনসিটিবির চেয়ারম্যান অধ্যাপক মো. মশিউজ্জামান (রুটিন দায়িত্ব) বলেন, ‘আমরা মূল্যায়ন পদ্ধতির খসড়া চূড়ান্ত করে মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছি। কবে সভা হবে এবং মূল্যায়ন কাঠামো অনুমোদন দেওয়া হবে, সেটা এখন মন্ত্রণালয়ের এখতিয়ার।’ষষ্ঠ থেকে নবমের ষাণ্মাসিক মূল্যায়নে কোন পদ্ধতি ব্যবহার হবে—এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘যেহেতু মূল্যায়ন পদ্ধতি চূড়ান্ত করে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পাঠানো সম্ভব হয়নি, সেক্ষেত্রে আমরা খসড়ায় যে পদ্ধতি রয়েছে, তা থেকে নির্দেশনা দেবো। প্রতিটি বিষয়ে পরীক্ষার আগে এ নিয়ে নির্দেশনা পাবেন শিক্ষকরা। এটা যেহেতু প্রতিষ্ঠানভিত্তিক এবং অর্ধবার্ষিক মূল্যায়ন, তাই সমস্যা হবে না।’শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের সচিব সোলেমান খান জাগো নিউজকে বলেন, ‘ঈদের ছুটিসহ নানা কারণে এনসিসিসির বৈঠক করা সম্ভব হয়নি। আমরা শিগগির বৈঠক ডাকবো। সেখানে মূল্যায়ন পদ্ধতি চূড়ান্ত হতে পারে।’
ষাণ্মাসিক মূল্যায়ন হতে পারে যেভাবে
মূল্যায়ন পদ্ধতি এখনো চূড়ান্ত না হলেও খসড়া যে কাঠামো তৈরি করা হয়েছে, তা দিয়ে ষাণ্মাসিক মূল্যায়ন করা হতে পারে বলে জানা যায়। এনসিটিবি সূত্র জানায়, ৩ জুলাই থেকে মূল্যায়ন প্রক্রিয়া শুরু হবে, যা চলবে ৩০ জুলাই পর্যন্ত। এক কর্মদিবসে এক বিষয়ের মূল্যায়ন অনুষ্ঠিত হবে। সময়সীমা থাকবে ৫ ঘণ্টা (বিরতিসহ)। মূল্যায়নে লিখিত অংশও থাকবে। ষাণ্মাসিক মূল্যায়নে যুক্ত হবে শিক্ষার্থীর শিখনকালীন পারদর্শিতা, অর্থাৎ সে কতটুকু শিখতে পারলো সেটা।

এদিকে, ষষ্ঠ থেকে নবম শ্রেণির মূল্যায়নের রিপোর্ট কার্ডে উল্লেখ থাকবে বিষয়ভিত্তিক পারদর্শিতার ক্ষেত্র (নির্ধারিত কোন ক্ষেত্রে কতটা দক্ষ), উপস্থিতির হার ও শিক্ষার্থীর আচরণগত মূল্যায়ন দক্ষতা। উল্লেখ থাকবে শিক্ষকের মন্তব্যের পাশাপাশি অভিভাবক ও শিক্ষার্থীর মন্তব্যও।

মূল্যায়নের সাতটি ধাপ
বিষয়ভিত্তিক মূল্যায়নের ক্ষেত্রে সাতটি স্কেল বা ধাপের কথা বলা হয়েছে। এগুলো হচ্ছে— প্রারম্ভিক (ইলিমেন্টারি), বিকাশমান (ডেভেলপিং), অনুসন্ধানী (এক্সপ্লোরিং), সক্রিয় (অ্যাকটিভেটিং), অগ্রগামী (অ্যাডভান্সিং), অর্জনমুখী (অ্যাচিভিং) ও অনন্য (আপগ্রেডিং)। শিক্ষার্থীদের মূল্যায়ন করে কোন শিক্ষার্থী কোন ধাপে আছে, তা নির্ধারণ করতে এ সাতটি স্কেল বা ধাপ রাখা হয়েছে। ‘প্রারম্ভিক’ মানে হলো সবচেয়ে নিচের ধাপ। আর ‘অনন্য’ হলো সবচেয়ে ভালো।প্রতিটি পারদর্শিতার ক্ষেত্রের জন্য আলাদাভাবে শিক্ষার্থীর অবস্থান নির্ধারণ করা হবে। প্রতিটি পারদর্শিতার ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট নির্দেশক (পিআই) শিক্ষার্থীর অর্জিত মাত্রাগুলো সমন্বয় করে ওই পারদর্শিতার ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীর অবস্থান কী, তা বোঝানো হবে। পুরো এ প্রক্রিয়া দেখে শিক্ষার্থীর অবস্থান ঠিক করবেন বিষয়ভিত্তিক শিক্ষক।

ধোঁয়াশায় শিক্ষকরা, বিভ্রান্তিতে শিক্ষার্থী-অভিভাবক
নতুন শিক্ষাক্রমের মূল্যায়ন পদ্ধতি নিয়ে স্পষ্ট ধারণা নেই শিক্ষকদের। তারা শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের বিষয়টি বোঝানো দূরের কথা, নিজেরাই বুঝতে হিমশিম খাচ্ছেন। শিক্ষকরা এনসিটিবি থেকে একেক বার একেক নির্দেশনা পেয়ে তা অভিভাবক ও শিক্ষার্থীদের বুঝিয়ে থাকেন। সেটা কিছুদিনের মধ্যেই আবার পাল্টে যায়। এতে গোটা মূল্যায়ন পদ্ধতি নিয়ে চরম বিভ্রান্তিতে পড়েছেন শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা। বিষয়টি নিয়ে ঢাকা ও ঢাকার বাইরের অন্তত ১০টি সরকারি-বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের সঙ্গে কথা বলেছেন এ প্রতিবেদক। তবে সরকারি স্কুলের শিক্ষকরা নাম প্রকাশ করে গণমাধ্যমে মতামত জানাতে অপারগতা প্রকাশ করেছেন।রাজধানীর মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের সহকারী প্রধান শিক্ষক রোকনুজ্জামান শেখ। তিনি বলেন, ‘যতদূর জেনেছি, ষাণ্মাসিক মূল্যায়ন পদ্ধতি এখনো চূড়ান্ত হয়নি। এনসিটিবি কিছু নির্দেশনা দিয়েছে। প্রতিটি বিষয়ের মূল্যায়নের আগের রাতে চূড়ান্ত দিকনির্দেশনা দেবে। সেটাই এখন শিক্ষকদের ভরসা। তবে এ নিয়ে বিষয়ভিত্তিক শিক্ষকরা কিছুটা দুশ্চিন্তায় আছেন।’

রাজশাহী গভর্নমেন্ট ল্যাবরেটরি হাই স্কুলের ইংরেজি বিষয়ের একজন শিক্ষক নাম প্রকাশ না করে বলেন, ‘পদ্ধতি না জেনে মূল্যায়ন করা মানে হলো—অন্ধকারে ঢিল ছোড়া। চাকরি বাঁচাতে আমরা যে ঢিল ছুড়বো, তাতে শিক্ষার্থীরা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এ দায় এনসিটিবি ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের। তারা বিষয়টি গুরুত্ব না দিয়ে দীর্ঘদিন ঝুলিয়ে রেখেছেন।’এ-তো গেলো শিক্ষকদের কথা। শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা মূল্যায়ন পদ্ধতি নিয়ে আরও অন্ধকারে। রাজধানীর ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের অষ্টম শ্রেণির ছাত্রীর মা রাবেয়া আক্তার। তিনি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর শেষ করেছেন। একটি বেসরকারি স্কুলে দীর্ঘদিন শিক্ষকতাও করেছেন।

রাবেয়া আক্তার বলেন, ‘কীভাবে আমার মেয়ের অর্ধবার্ষিক মূল্যায়ন হবে, তা জানতে কয়েক দফা স্কুলে গিয়ে শিক্ষকদের সঙ্গে আলাপ করেছি। তারা কেউ আমাকে স্পষ্ট ধারণা দিতে পারেননি। আমি নিয়মিত এনসিটিবি, মাউশির ওয়েবসাইটে ঢুকে নির্দেশনা দেখি। সেখানেও কোনো পদ্ধতি নেই। শুধু গণমাধ্যমে কিছু ভাসা ভাসা তথ্য আমরা পেয়েছি। সেখানে তো বিস্তারিত নেই। আবার তা চূড়ান্তও নয় বলে উল্লেখ ছিল। তাহলে অভিভাবক হিসেবে আমি কীভাবে আমার মেয়েকে বাসায় প্রস্তুতি নিতে সাহায্য করবো?’

তিনি বলেন, ‘আমি তো শিক্ষিত মা হয়েও কিছুই করতে পারছি না ওর জন্য। কতটা দায়িত্বজ্ঞানহীন প্রশাসন এটা করতে পারে, একবার ভাবুন? তারা একটি পদ্ধতি করেছেন, তাতে পরীক্ষা বা মূল্যায়ন কেমন হবে, তা ঠিক না করেই সেটা বাস্তবায়ন করছেন। এটা মেনে নেওয়ার মতো নয়।’

জানতে চাইলে মাধ্যমিক উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের (মাউশি) মহাপরিচালক অধ্যাপক নেহাল আহমেদ বলেন, ‘শিক্ষকরা আমাদের সঙ্গে মূল্যায়ন পদ্ধতি পেতে যোগাযোগ করেছেন, এটা সত্য। তবে আমরা এনসিটিবির দেওয়া নির্দেশনা তাদের দেই। এ কাজটা তারা (এনসিটিবি) করেন। আমাদের কাজ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বাস্তবায়ন করা। চূড়ান্ত পদ্ধতিই যদি না পাই, তাহলে সেটা বাস্তবায়ন করবো কীভাবে?’মূল্যায়ন পদ্ধতি চূড়ান্ত করে ষাণ্মাসিক সামষ্টিক মূল্যায়ন নেওয়া হলে ভালো হতো বলে মনে করেন এনসিটিবির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান অধ্যাপক মশিউজ্জামানও। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘যদি আমরা চূড়ান্ত পদ্ধতি আগেই শিক্ষকদের কাছে পৌঁছে দিতে পারতাম, তাহলে তারা প্রশিক্ষিত হয়ে থাকতেন। এবার প্রতিষ্ঠানভিত্তিক মূল্যায়নে তা প্রয়োগ করে দক্ষ হয়ে উঠতেন। এতে বার্ষিক মূল্যায়নের সময় শিক্ষকদের জন্য এটা বুঝে প্রয়োগ করা অনেক সহজ হতো।’