ঢাকা, বৃহস্পতিবার ২১ই নভেম্বর ২০২৪ , বাংলা - 

টিকা নেওয়ার পার্শ্ব প্রতিক্রিয়ার অভিজ্ঞতা

ডেস্ক রিপোর্ট ।।ঢাকাপ্রেস২৪.কম

2021-03-19, 12.00 AM
টিকা নেওয়ার পার্শ্ব প্রতিক্রিয়ার অভিজ্ঞতা

টিকা নেওয়ার পর কেন কিছু মানুষের শরীরে পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়, যাদের দেখা দেয় তাদের রোগ প্রতিরোধী ব্যবস্থা কি বেশি শক্তিশালী? বিবিসির স্বাস্থ্য ও বিজ্ঞান বিষয়ক সংবাদদাতা জেমস গ্যালাহার করোনাভাইরাসের টিকা নেওয়ার পর তার অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরেছেন এবং এসবের ব্যাখ্যা দিয়েছেন..টিকা নেওয়ার পর আমি আনন্দে আত্মহারা হয়ে গেলাম। আমি করোনাভাইরাস মহামারির খবর সংগ্রহ করে সেসব পরিবেশন করেছি, টিকা তৈরির যে প্রতিযোগিতা সেটাও আমি কভার করেছি। চীনের উহান শহরে যখন অল্প কিছু সংখ্যক মানুষ করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছে তখন থেকেই আমি এসব করছি।

তার পর যখন ডাক্তারখানায় গিয়ে শার্টের হাতা গুটিয়ে আমার নিজের টিকা নেওয়ার সময় এলো মনে হলো এটা সত্যিই এক গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত।

কিন্তু আমি এখানে আপনাদের সঙ্গে খোলামেলাভাবে সততার সঙ্গে সবকিছু তুলে ধরবো: এই টিকা আমাকে একেবারেই কাবু করে ফেলল।
বিজ্ঞাপন

পরিষ্কার করে বলি, এই পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়েও আমি আবার টিকা গ্রহণ করব। কোভিডে আক্রান্ত হওয়া, অথবা আরো এক বছরের বিধি-নিষেধের মধ্যে পড়ে যাওয়া, কিম্বা দুর্ঘটনাবশত প্রিয়জনের দেহে ভাইরাসটি ছড়িয়ে দেওয়ার উচ্চ ঝুঁকি নেওয়ার চেয়ে আমি বরং টিকার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া মেনে নিতে রাজি।

অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকা টিকার প্রথম ডোজটি আমি নিয়ে নিয়েছি সকাল সাড়ে ন'টায়। সেদিন সন্ধ্যায় খুব দ্রুত আমার অবস্থার অবনতি হতে থাকে এবং পরের তিনদিন আমি বিছানা থেকে একরকম উঠতেই পারিনি।

সবচেয়ে খারাপ যেটা হলো তা হচ্ছে প্রচণ্ড মাথাব্যথা এবং সেই সঙ্গে বমি। শরীরে ব্যথা হচ্ছিল, ঠাণ্ডা লাগছিল এবং আমার নিজেকে চরম ক্লান্ত মনে হচ্ছিল।

বিছানায় অসুস্থ হয়ে পড়ে থেকে আমি যখন কাতরাচ্ছিলাম তখন তো আমি বলতেই পারি "আমার কেন এই অবস্থা হলো?"

কিন্তু আমি সুস্থ হয়ে উঠতে উঠতে আমি ভাবছিলাম কেন কিছু কিছু মানুষের পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া অন্যদের তুলনায় খুব খারাপ হয়, তার মানে কি এই যে তাদের তুলনায় আমার রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বেশি শক্তিশালী।
ভিডিওর ক্যাপশান,

টিকা নিতে আগ্রহী হলে যেসব বিষয় আপনার জানা থাকা জরুরি
পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া কোত্থেকে আসে, কেন হয়?

কোভিড টিকা শরীরের সাথে একটি কৌশলের আশ্রয় নেয়। টিকা নেওয়ার পর শরীর মনে করে যে সে করোনাভাইরাসের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছে। এই টিকা তখন সংক্রমণের সাথে লড়াই করার জন্য আমাদের শরীরের রোগ প্রতিরোধী স্বাভাবিক ব্যবস্থাকে টোকা মেরে জাগিয়ে তোলে।

প্রথম প্রতিক্রিয়া হয় বাহুতে যেখানে টিকাটি দেওয়া হয়- ফুলে যায় এবং ব্যথা হয়- কারণ তখন রোগ প্রতিরোধী ব্যবস্থা সক্রিয় হয়ে ওঠে।

তখন দেহের বাকি অংশে এর প্রভাব পড়তে পারে এবং দেখা দিতে পারে ফ্লুর মতো উপসর্গ যেমন জ্বর, ঠাণ্ডা লাগা এবং বমি বমি ভাব।

"জ্বালা যন্ত্রণাময় সাড়া দেওয়ার কারণে এরকম হয়," একথা আমাকে বললেন এলেনর রাইলি, যিনি এডিনবরা বিশ্ববিদ্যালয়ে রোগ প্রতিরোধী ব্যবস্থা ও সংক্রামক রোগ বিভাগের শিক্ষক।

এটা কাজ করে রাসায়নিক ফায়ার এলার্মের মতো। টিকা দেওয়ার পর শরীরের ভেতরে কিছু রাসায়নিক প্রবাহিত হতে শুরু করে যা দেহকে সতর্ক করে দেয় বলে যে কোথাও সমস্যা দেখা দিয়েছে।

প্রফেসর রাইলি বলেন: "এটা রোগ প্রতিরোধী ব্যবস্থাকে প্রস্তুত করে তোলে এবং আপনার বাহুর চারপাশে যেসব টিস্যু আছে সেগুলোতে রোগ প্রতিরোধী কিছু সেল প্রেরণ করে। সেখানে আসলে কী হচ্ছে সেটা খুঁজে বের করতেই এসব সেল পাঠানো হয়।"

এসব রাসায়নিকের কারণে আমরা অল্প কিছু সময়ের জন্য অসুস্থ বোধ করতে পারি।
কিছু মানুষের পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া কেন বেশি হয়?

একেকজন মানুষের শরীরে একেক রকমের পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া হয়ে থাকে। ব্যক্তিভেদে এর তারতম্যও খুব বেশি হতে পারে।

কেউ হয়তো কোন কিছুই লক্ষ্য করবে না, কেউ দুর্বল বোধ করবেন, কিন্তু কাজে যেতে পারবেন, আর বাকিদের হয়তো বিছানায় শুয়ে থাকার দরকার হতে পারে।
টিকা নিচ্ছেন অক্সফোর্ড ভ্যাকসিন গ্রুপের প্রফেসর এন্ড্রু পোলার্ড।

ছবির উৎস, এবঃঃু ওসধমবং
ছবির ক্যাপশান,

টিকা নিচ্ছেন অক্সফোর্ড ভ্যাকসিন গ্রুপের প্রফেসর এন্ড্রু পোলার্ড।

"এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ এক উপাদান, এবং এটা হয়তো তোমার জন্য প্রাসঙ্গিক জেমস (আমার বয়স মধ্য তিরিশে)," আমাকে একথা বললেন প্রফেসর এন্ড্রু পোলার্ড, যিনি অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকা টিকার পরীক্ষায় নেতৃত্ব দিয়েছেন।

"আপনার বয়স যত বেশি হবে, পার্শ্ব প্রতিক্রিয়াও হবে তত কম- যাদের বয়স ৭০ এর উপরে তাদের কোন ধরনেরই পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া হবে না।"

তবে একই বয়সের দু'জন মানুষেরও টিকা নেওয়ার ফলে ভিন্ন ভিন্ন প্রতিক্রিয়া হতে পারে।

"আমাদের দেহের রোগ প্রতিরোধী ব্যবস্থায় বিশাল জেনেটিক বৈচিত্র রয়েছে। আর একারণেই একেকজনের শরীরে একেক ধরনের প্রতিক্রিয়া হয়ে থাকে," বলেন প্রফেসর রাইলি।

এই বৈচিত্র্যের অর্থ হচ্ছে কোনো কোনো মানুষের রোগ প্রতিরোধী ব্যবস্থা একটু বেশি সক্রিয় এবং এর ফলে তারা আক্রমণাত্মক উপায়ে সাড়া দেয়।

প্রফেসর রাইলি বলেন, "আপনার মতো কিছু মানুষ, যাদের শরীরে ফ্লুর মতো উপসর্গ দেখা দেয়, তারা পুরো বিষয়টাতে অতিরিক্ত সাড়া দিয়ে থাকে।"

"এবং আপনি হয়তো তাদের মধ্যে একজন যারা ঠাণ্ডা লাগলে কিম্বা ফ্লুতে আক্রান্ত হলে সবসময় বেশ অসুস্থ বোধ করে। আমি আপনাকে এজন্য অভিযুক্ত করতে চাই না যে আপনি এধরনের ম্যান-ফ্লুতে আক্রান্ত, কিন্তু আপনি হয়তো তাদেরই একজন।"

আরো একটি কারণে পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া হওয়ার ঝুঁকি তৈরি হতে পারে। আপনি যদি এর আগে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে থাকেন তাহলে টিকা নেওয়ার পর পর আপনার দেহে প্রচণ্ড শক্তিশালী রোগ প্রতিরোধী ব্যবস্থা গড়ে উঠতে পারে। তখন এধরনের পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়।
ভিডিওর ক্যাপশান,

টিকার ব্যাপারে বিভ্রান্তিকর ধর্মীয় বক্তব্যের বিপদ
পার্শ্ব প্রতিক্রিয়ার অর্থ কী এই যে আমি প্রতিরোধ ক্ষমতা বেশি?

স্বার্থপর-ভাবেই আমি আশা করেছিলাম যেহেতু আমার পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে তাই আমার প্রতিরোধ ক্ষমতাও বেশি।

আগের কিছু টিকার ক্ষেত্রে এরকম কিছু প্রমাণ পাওয়া গিয়েছিল।

"এরকম কিছু উদাহরণ আছে, যেমন ২০০৯ সালের ফ্লু মহামারি, সেসময় দেখা গিয়েছিল যাদের পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া বেশি ছিল তাদের রোগ প্রতিরোধী ব্যবস্থাও তত বেশি শক্তিশালী ছিল," বলেন প্রফেসর পোলার্ড।

কিন্তু কোভিড টিকার ক্ষেত্রে এরকম ঘটেনি। এই টিকা নেওয়ার পর প্রত্যেকেই প্রায় সমান নিরাপত্তা পাচ্ছে।

"এটা দারুণ একটা বিষয়, যদিও বয়স্ক লোকজনের খুব সামান্যই পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়, তাদের রোগ প্রতিরোধী ব্যবস্থাও একই সমান নিরাপত্তা দেয়।"

রোগ প্রতিরোধী ব্যবস্থার যে দুটো দিক সেগুলো একসঙ্গে কাজ করে।

প্রথমটিকে বলা হয় ইনেট রেসপন্স বা সহজাত প্রতিক্রিয়া। এর মধ্যেই রয়েছে রাসায়নিক ফায়ার অ্যালার্ম। এটা মানুষের অন্তর্জাত রোগ প্রতিরোধী ব্যবস্থা।

আরো পড়তে পারেন:

সাতটি দেশে অ্যাস্ট্রাজেনেকা টিকা স্থগিতের পর যে ব্যাখ্যা দিচ্ছে কোম্পানি

বাংলাদেশে অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকাই চলবে

ইউরোপীয় দেশগুলোতে আবারও অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা দেয়া হবে

সময় মতোই পাওয়া যাবে সিরামের টিকা- স্বাস্থ্য অধিদপ্তর

বাকি অর্ধেকটিকে বলা হয় অ্যাডাপটিভ রেসপন্স বা প্রদত্ত প্রতিক্রিয়া। এই প্রক্রিয়ায় রোগ প্রতিরোধী ব্যবস্থা প্রথমে শিক্ষা গ্রহণ করে এবং সংক্রমণের বিরুদ্ধে কীভাবে সে লড়াই করবে সেটা সে মনে রাখে। বি-সেল তৈরি করার মাধ্যমে এই লড়াই পরিচালিত হয়। ভাইরাসটিকে ধ্বংস করার জন্য এই বি-সেল এন্টিবডি উৎপাদন করে।

এই প্রক্রিয়ায় টি-সেলও তৈরি হয় যা আক্রান্ত যেকোনো সেলকে আক্রমণ করে থাকে।

প্রফেসর রইলি বলেন, "মানুষের সহজাত যে প্রতিরোধী ব্যবস্থা তাতে বয়সের সঙ্গে তারতম্য ঘটে, মানুষে মানুষেও এটা একেক রকমের হয়, এবং পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া কতোটুকু ও কেমন হবে সেটাও তার ওপর নির্ভর করে।

"প্রদত্ত প্রতিক্রিয়াকে সক্রিয় করে তোলার জন্য আপনার সামান্য সহজাত প্রতিক্রিয়ার প্রয়োজন হয়। সেখান থেকেই তৈরি হয় বি-সেল ও টি-সেল যা আপনাকে রক্ষা করবে।"
আমার দ্বিতীয় ডোজও কি খারাপ হবে?

যারা প্রথম ডোজটি নিয়েছেন তাদের অনেকের মধ্যেই একটা উদ্বেগ যে দ্বিতীয় ডোজ নেওয়ার পরেও কি পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া তৈরি হবে।

এবিষয়ে আমাকে আশ্বস্ত করা হয়েছে।

"আপনার দ্বিতীয় ডোজে কোন অপকার হবে না, এটি নির্বিষ। প্রথম ডোজটির তুলনায় দ্বিতীয় ডোজটি খুবই মৃদু," বলেন প্রফেসর পোলার্ড, যিনি অক্সফোর্ড টিকার পরীক্ষা চালিয়েছেন।

তবে তিনি সতর্ক করে দিয়েছেন যে কিছু কিছু তথ্যে দেখা যাচ্ছে ফাইজারের টিকার প্রথম ডোজের তুলনায় দ্বিতীয় ডোজের পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া সামান্য বেশি হতে পারে।
অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা ভারতে উৎপাদিত হচ্ছে কোভিশিল্ড নামে

ছবির উৎস, ঝঙচঅ ওগঅএঊঝ/এঊঞঞণ
ছবির ক্যাপশান,

অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা ভারতে উৎপাদিত হচ্ছে কোভিশিল্ড নামে।
পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া নিয়ে কি উদ্বেগের কিছু আছে?

টিকা দেওয়ার পর সামান্য কিছু লোকের শরীরে রক্ত জমাট বেঁধে যাওয়ার খবরে যে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে সেটা সংবাদ মাধ্যমে প্রাধান্য পেয়েছে।

স্বাস্থ্য সমস্যা সংক্রান্ত এধরনের কাকতালীয় ঘটনার ব্যাপারে টিকা দেওয়া শুরু হওয়ার আগেই আমাকে সতর্ক করে দেওয়া হয়েছিল।

ইউরোপের ওষুধ নিয়ন্ত্রণ সংস্থা ইউরোপিয়ান মেডিসিন্স এজেন্সি বলেছেন, "টিকা নেওয়ার ফলে যে রক্ত জমাট বেঁধে যায় তার পক্ষে কোন ইঙ্গিতই পাওয়া যায়নি।"

তবে এই টিকার ফলে পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া হতে পারে, এবং অধ্যাপক পোলার্ড বলেছেন এসবের বিষয়ে খোলামেলা দৃষ্টিভঙ্গি ও সৎ থাকাও জরুরি।

তিনি বলেন: "পরীক্ষার সময় আপনার এটা বলার সুযোগ আছে যে আপনারও জেমস গ্যালাহারের মতো অবস্থা হতে পারে এবং কয়েকদিনের জন্য আপনার খারাপ লাগতে পারে। আপনি তাহলে জানবেন যে আপনার কী হতে পারে। আপনি কিছু প্যারাসিটামল খাবেন এবং সব ঠিক হয়ে যাবে।"

"কিন্তু আপনার যদি এরকম কিছু হয়, এবং সেবিষয়ে আপনি কিছু না জানেন তাহলে তো সেটা আপনার জন্য উদ্বেগের হবেই," বলেন তিনি।