বছর পাঁচেক আগেও ছিল টিনের ঘর। ভাঙাচোরা আর জং ধরা। খুলে পড়ছিল টিন। সেই জায়গায় বর্তমানে উঠেছে আধুনিক সুবিধাসম্পন্ন দালান। প্রাচীর ঘেরা বাগানবাড়ি। গ্রাম ও আশপাশে একশ বিঘা জমি তার। আরও কত কী! হঠাৎ সম্পদশালী হয়ে ওঠা এই ব্যক্তির নাম অসীম গাইন। বাড়ি মাদারীপুরের রাজৈরের কদমবাড়ী ইউনিয়নের ফুলবাড়ী গ্রামে। রয়েছে লোক দেখানো ক্যাবল ও ইন্টারনেটসহ একাধিক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। সব ছাপিয়ে গত দুই বছরে প্রশ্নফাঁস তার কাছে যেন হয়ে উঠেছে আলাদীনের চেরাগ। ফাঁস করা প্রশ্নের সমাধান হোয়াটসঅ্যাপ করলেই লাখ লাখ টাকা। গ্রামের বাড়িতে ২০ শতাংশ জমিতে কয়েক কোটি টাকা খরচ করে করেছেন বাগানবাড়ি। পাঁচ-ছয় বছর ধরে হুন্ডি ও মানবপাচারের সঙ্গেও জড়িত বলে জানান গ্রামবাসী। অনুসন্ধানে জানা যায়, পাঁচ বছর আগে অসীম গাইনের গ্রামের বাড়ি ছিল টিনের। বর্তমানে সেখানে করেছেন আলিশান ভবন। তার বাবা ছিলেন হতদরিদ্র একজন কৃষক। নিজ এলাকাসহ বিভিন্ন এলাকায় নিজের ও পরিবারের নামে কিনেছেন প্রায় একশ বিঘা জমি।
যা বলছেন প্রতিবেশী ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধি
অসীম গাইনের প্রতিবেশী অরুপ কুমার মন্ডল বলেন, ‘অসীমের বাবা ছিলেন একজন কৃষক। তাদের আগে ছিল টিনের ঘর। ডিশের ব্যবসা করলেও পাঁচ-ছয় বছর ধরে অসীম মানবপাচারে জড়িত। টাকা নিয়ে তিনি এলাকার অনেককেই বিভিন্ন দেশে পাঠিয়েছেন। এছাড়া দুই বছর ধরে সরকারি চকরি দেওয়ার জন্য বিভিন্ন প্রশ্নপত্রের উত্তর দিয়ে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। টাকা-পয়সার মালিক হয়ে তিনি যুবলীগের রাজনীতিতে নাম লেখান। এলাকার ডন হিসেবে পরিচিত অসীম।’কদমবাড়ী ইউনিয়ন পরিষদের ১ নম্বর ওয়ার্ডের মেম্বার বীরেন্দ্রনাথ বৈরাগী জাগো নিউজকে বলেন, ‘প্রশ্নফাঁসের ঘটনায় ডিবি পুলিশ অসীমকে খুঁজছে এটা শুনেছি। তার বাবা কৃষিকাজ করতো। তাদের আগে টিনের ঘর ছিল। আর্থিক অবস্থা খুব বেশি ভালো ছিল না। তবে গত কয়েক বছরে হঠাৎ করে তার আর্থিক অবস্থা ভালো হতে শুরু করে।’
কদমবাড়ী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান বিধান বিশ্বাস বলেন, ‘অসীম গাইনের বড় কোনো ব্যবসা-বাণিজ্য নেই। এলাকায় শুধু ছোটখাটো ডিশের ব্যবসা আছে তার। বিভিন্ন লোকজনের সরকারি চাকরি ও বিদেশে লোক পাঠিয়ে এলাকায় পরিচিচি লাভ করে সে। গত বছর বিপুল সংখ্যক লোককে সে চাকরি দিয়েছে বলে শুনেছি। এলাকায় তার কাছে গেলে সরকারি চাকরি পাওয়া যায় বলেও কথিত আছে।’
প্রশ্নফাঁস করে আলোচনায় অসীম
সম্প্রতি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক নিয়োগের তৃতীয় ধাপের পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়। এ ঘটনায় সামনে আসে অসীম গাইনের নাম। প্রশ্নফাঁস চক্রে জড়িতের অভিযোগে এরই মধ্যে গ্রেফতার হয়েছেন অসীমের ভাতিজা জ্যোতির্ময় গাইন (২৬)। জ্যোতির্ময় প্রশ্নফাঁস চক্রের প্রধান সমন্বয়কারী ও প্রশ্নপত্র সমাধানকারী। ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের জালে জ্যোতির্ময় গাইন গ্রেফতার হলেও এখনো ধরা-ছোঁয়ার বাইরে অসীম গাইন।ডিবির কর্মকর্তারা বলেন, শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষায় প্রশ্নফাঁসের ঘটনার মূলহোতা অসীম। এ ঘটনায় জড়িত পাঁচজনকে গ্রেফতার করার পর অসীম আত্মগোপনে চলে যান। তাকে গ্রেফতারে দেশব্যাপী অভিযান চলমান।গোয়েন্দা-সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইমের তদন্তে উঠে এসেছে, অসীম গাইন প্রায় দুইশ পরীক্ষার্থীর কাছে প্রশ্নের উত্তর বিক্রির চুক্তি করেছিলেন। চাকরি নিশ্চিত করা পর্যন্ত ১২ থেকে ১৫ লাখ টাকায় এ চুক্তি হয়। প্রথম দফায় দুই থেকে পাঁচ লাখ টাকা, বাকি টাকার জন্য চেক নিতেন তিনি।তদন্ত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, গত ২৯ মার্চ অনুষ্ঠিত সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক নিয়োগের তৃতীয় ধাপের লিখিত পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। এ পরীক্ষায় ঢাকা ও চট্টগ্রাম বিভাগের (তিন পার্বত্য জেলা বাদে) ২১ জেলার ৩ লাখ ৪৯ হাজার ২৯৩ পরীক্ষার্থী অংশ নেন। পরীক্ষা চলাকালে প্রশ্নের উত্তর ও ডিভাইসসহ মাদারীপুরে সাতজন ও রাজবাড়ী থেকে একজন শিক্ষার্থীকে আটক করা হয়।এ ঘটনায় দুই জেলায় আলাদাভাবে মামলা হয়। রাজবাড়ীতে আটক হওয়া পরীক্ষার্থী আদালতে নিজের দায় স্বীকার করে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দেন।
ডিবি জানায়, ২৯ মার্চ পরীক্ষার দিনই প্রশ্ন ফাঁস হয়। এরপরও সেই প্রশ্নে পরীক্ষা নেওয়া হয় এবং ২১ এপ্রিল ফল প্রকাশ করা হয়। এর মধ্যে প্রশ্নপত্র ফাঁস চক্রের পাঁচজনকে গোয়েন্দা নজরদারিতে রাখে ডিবি। গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে পুরো ঘটনা নিয়ে ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা-সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম বিভাগ তদন্ত শুরু করে।
তদন্তের এক পর্যায়ে ডিভাইস ব্যবহার করে প্রশ্নপত্র ফাঁসের সংঘবদ্ধ প্রতারক চক্রের পাঁচ সদস্যকে গ্রেফতার করে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম (দক্ষিণ) বিভাগ। গ্রেফতাররা হলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই শিক্ষার্থী জ্যোতির্ময় গাইন (২৬) ও সুজন চন্দ্র রায় (২৭)। জগন্নাথ হলে জ্যোতির্ময়ের ২২৪ নম্বর রুমে বসেই প্রশ্নের সমাধান করা হয়। আর সুজন চন্দ্র রায় প্রশ্নপত্রের সমাধানকারী।
এছাড়া আরও তিনজনকে গ্রেফতার করে ডিবি। তারা সেদিনের পরীক্ষায় প্রশ্নের উত্তরপত্র পেয়ে পরীক্ষা দেন এবং উত্তীর্ণ হন। তারা হলেন পংকজ গাইন (৩০), মনিশ গাইন ও লাভলী মন্ডল (৩০)।
জগন্নাথ হলে প্রশ্নপত্রের সমাধান
তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগ তৃতীয় ধাপের পরীক্ষায় ফাঁস হওয়া প্রশ্নপত্র দ্রুত সমাধান করতে একদল মেধাবী ছাত্রের সমন্বয়ে টিম গঠন করা হয়। ২৯ মার্চ সকাল ১০টায় পরীক্ষা শুরুর আগেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলের জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা ভবনের জ্যোতির্ময় গাইনের ২২৪ নম্বর কক্ষে হাজির হতো সবাই। তার নেতৃত্বে সেখানে সুজন চন্দ্র রায়, রনি বিশ্বাসসহ একদল মেধাবী শিক্ষার্থী প্রশ্নপত্র সমাধান করতেন। তারা দ্রুত সমাধান করে তা অসীম গাইনের মোবাইল ফোনের মাধ্যমে কেন্দ্রে থাকা নির্ধারিত পরীক্ষার্থীদের কাছে পাঠিয়ে দিতেন।চক্রটি আগেই পরীক্ষার্থীদের কাছ থেকে নগদ, ব্যাংক চেক ও সাদা চেক নিয়ে রাখতো। যাদের কাছ থেকেই এই টাকা বা চেক নিয়েছে, মূলত তাদের কাছেই সমাধান করা প্রশ্নপত্র পাঠানো হতো। আগেই চুক্তিতে থাকা শিক্ষার্থীদের ইলেক্ট্রনিক ডিভাইস সরবরাহ করতো চক্রের সদস্যরা।
জড়িত বুয়েট শিক্ষার্থীও
গোয়েন্দা জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেফতার জ্যোতির্ময় জানান, প্রশ্নপত্র সমাধানে তার সঙ্গে সুজন, বেনু ও রনি বিশ্বাস ছাড়াও বুয়েটের আরও কয়েকজন শিক্ষার্থী ছিলেন। তাদের নাম তিনি জানেন না। তার চাচা অসীম তাদের কাছে পাঠিয়েছিলেন।
বুয়েটের যেসব শিক্ষার্থী এর সঙ্গে জড়িত তাদের চিহ্নিত করার চেষ্টা চালাচ্ছে ডিবি।মাদারীপুর জেলায়ই পাঁচ কেন্দ্রে প্রশ্নফাঁস
টাকার বিনিময়ে চক্রের পরীক্ষার্থী সদস্যরা পরীক্ষা শুরুর সঙ্গে সঙ্গে প্রশ্নপত্রের ছবি তুলে বাইরে চক্রের সমাধানকারী গ্রুপের কাছে পাঠিয়ে দেন। এরপর তা দ্রুত সমাধান করে টাকা নেওয়া বা চুক্তি করা শিক্ষার্থীদের কাছে ডিভাইসের মাধ্যমে কেন্দ্রে পৌঁছে দেওয়া হয়। মূলত মাদারীপুরের পাঁচটি পরীক্ষা কেন্দ্রে ফাঁস হওয়া প্রশ্নের সমাধান নিয়ে পরীক্ষা দেন শিক্ষার্থীরা। ২৯ মার্চ কেন্দ্রে দায়িত্বরত শিক্ষকরা আট পরীক্ষার্থীকে আটক করেন। পরে দায়িত্বরত ম্যাজিস্ট্রেটের উপস্থিতিতে ফাঁস হওয়া প্রশ্নপত্রের সমাধান ও ডিভাইস জব্দ করা হয়।
এ ঘটনায় মাদারীপুর সদর থানায় জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসের উচ্চমান সহকারী রেজাউল করিম বাদী হয়ে মামলা করেন।
মামলার এজাহারে বলা হয়, মাদারীপুরে ১৮টি পরীক্ষা কেন্দ্রে নিয়োগ পরীক্ষার সময় কয়েকটি কেন্দ্রে কিছু পরীক্ষার্থী লিখিত পরীক্ষায় ইলেক্ট্রনিক ডিভাইসের মেসেজ অপশনে উত্তর দেখে পরীক্ষায় অংশ নেন। তাদের মধ্যে মাদারীপুর সদরে কুলপদ্বী উচ্চ বিদ্যালয় কেন্দ্র থেকে নোমান আহম্মেদ (২৬), মাদারীপুর সরকারি কলেজ পরীক্ষা কেন্দ্র থেকে সঞ্জয় রায় (৩২), সদরের আলহাজ আমিন উদ্দিন হাইস্কুল কেন্দ্র থেকে সাথী আক্তার (৩০), তৃষ্ণা বালা (২৯), শামসুন্নাহার ভূঁইয়া বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় থেকে মুক্তি বাড়ৈ (২৬), সদরের জুলিও কুরী উচ্চ বিদ্যালয় কেন্দ্র থেকে দুর্গা হাওলাদার (৩২), নিপা বৈদ্য (২৭) ও শিখা কির্তনীয়াকে (৩২) আটক করা হয়।যা বলছেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা
সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম (দক্ষিণ) বিভাগের অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার (এডিসি) মো. সোলায়মান মিয়া বলেন, ‘অসীম গাইন প্রশ্নপত্র ফাঁস করতেন। এরপর সেটি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে তার ভাতিজা ঢাবি শিক্ষার্থী জ্যোতির্ময় গাইনের কাছে পাঠাতেন। জ্যোতির্ময় তার বন্ধুদের নিয়ে জগন্নাথ হলে বসে প্রশ্নের সমাধান করে তা অসীমের মোবাইল ফোনে পাঠাতেন। অসীম তা পাঠিয়ে দিতেন তার সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ পরীক্ষার্থীদের কাছে।’সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম (দক্ষিণ) বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার (ডিসি) মো. শহীদুল ইসলাম বলেন, ‘দুই বছর আগেও অসীম গাইনের কিছুই ছিল না। প্রশ্নফাঁস করে তিনি কোটি কোটি টাকা বাগিয়ে নিয়েছেন। যার কিছুই ছিল না এখন তিনি শত কোটি টাকার মালিক। এখন পর্যন্ত অসীমের গ্রামের বাড়িতে বাগানবাড়ি, একাধিক ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের খোঁজ মিলেছে। এছাড়া এলাকায় হুন্ডি কারবারি ও মানবপাচারের বিষয়েও তদন্ত করা হচ্ছে।’
এ বিষয়ে ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (গোয়েন্দা) মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ বলেন, ‘প্রশ্নপত্র ফাঁসের হোতা পলাতক অসীম গাইন প্রশ্নপত্র ফাঁস করে শত শত কোটি টাকার মালিক হয়েছেন। পাশাপাশি মানবপাচারেও জড়িত তিনি। অবৈধ টাকায় বিলাসবহুল বাড়ি ও গাড়ির মালিক হয়েছেন। তিনি যেই হোন না কেন তাকে গ্রেফতার করা হবে।’তিনি আরও বলেন, ‘যেসব অভিভাবক প্রশ্নপত্র কেনার জন্য সন্তানের হাতে লাখ লাখ টাকা দিয়েছেন সেসব অভিভাবককেও শনাক্ত করে আইনের আওতায় আনা হবে। এছাড়া যারা এরই মধ্যে প্রশ্ন পেয়ে পরীক্ষা দিয়ে উত্তীর্ণ হয়েছে তাদেরও শনাক্তের কাজ চলমান।’