ঢাকা, মঙ্গলবার ৩ই ডিসেম্বর ২০২৪ , বাংলা - 

বুধবার ঐতিহাসিক মুজিবনগর দিবস

মনিরুল ইসলাম মনির, মেহেরপুর

2024-04-16, 12.00 AM
বুধবার ঐতিহাসিক মুজিবনগর দিবস

বুধবার ১৭ এপ্রিল ঐতিহাসিক মুজিবনগর দিবস। বাঙালি জাতির এক অবিস্মরণীয় দিন। ১৯৭১ সালের এই দিনে মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলা আ¤্রকাননে বাংলাদেশের স্বাধীনতার নতুন সূর্য উদীত হয়। পরে এই বৈদ্যনাথতলাকেই ঐতিহাসিক মুজিবনগর হিসেবে নামকরণ করা হয়। মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম প্রধান সংগঠক নবগঠিত বাংলাদেশ সরকারের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ ১৯৭১ সালের ৩০ মার্চ চুয়াডাঙ্গা সীমান্ত দিয়ে ভারত গমনের সময় দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চল রনাঙ্গনের নেতৃবৃন্দের সাথে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে এ এলাকার নিরাপত্তা ও ভৌগলিক অবস্থা সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়ার পর ১৪ এপ্রিল শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানের তারিখ নির্ধারণ করেন। প্রথম দিকে চুয়াডাঙ্গাতে শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠিত হওয়ায় কথা থাকলেও যুদ্ধ পরিস্থিতির নাটকীয় পরিবর্তনের ফলে নিরাপত্তার কথা বিবেচনা করে শপথ গ্রহণের স্থান চুয়াডাঙ্গার পরিবর্তে ইপিআর-উইংয়ের অধীন মেহেরপুর সীমান্ত এলাকা বৈদ্যনাথতলা(বর্তমান মুজিবনগর) নির্ধারণ করা হয়।

দিনের পর দিন মুক্তিযোদ্ধারা মরণপণ যুদ্ধের পরে স্বীকৃতি না পেয়ে মুক্তিকামী মানুষের মনোবল যখন ভাঙতে শুরু করে। ঠিক এমনই এক সঙ্কটকালীন সময়ে ভারতীয় বিএসএফ’র ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা গোলক মজুমদার ও ৭৬ বিএসএফ ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লে. কর্নেল চক্রবর্তী বৈদ্যনাথতলায় এসে স্থানীয় সংগ্রাম কমিটি এবং তৎকালীন মহকুমা প্রশাসক তৌফিক-ই-এলাহীসহ আওয়ামী নেতৃবৃন্দের সাথে কথা বলে বৈদ্যনাথতলা আ¤্রকাননে (বর্তমানে মুজিবনগর স্মৃতিসৌধ) জায়গা দেখিয়ে মঞ্চ তৈরির প্রস্তুতি সম্পন্ন করতে বলেন। আপামর জনতার স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণের মাধ্যমে ১৬ এপ্রিল এলাকার কাঠের চৌকি সংগ্রহ করে তৈরি করে মঞ্চের কাজ, বাঁশের বাতা দিয়ে বেস্টনি নির্মাণ এবং স্থানীয়ভাবে ভাঙা চেয়ার টেবিল দিয়েই আয়োজন সম্পন্ন করে। আনুসাঙ্গিক সরঞ্জাম আসে ভারতের হৃদয়পুর বিএসএফ ক্যাম্প থেকে। অত্যন্ত গোপনীয়তার সাথে আয়োজন সম্পন্ন করা হয়।

১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল সেই মাহিন্দ্রক্ষণে তাজউদ্দীন আহমদ ও সৈয়দ নজরুল ইসলাম অন্যান্য নেতৃবৃন্দকে সাথে নিয়ে সকাল নয়টার দিকে বৈদ্যনাথতলায় পৌঁছান। দেশি-বিদেশি সাংবাদিক এবং ভারতীয় নিরাপত্তাবাহিনীর সদস্যরাও আসেন। বহু প্রতীক্ষিত শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান শুরু হয় সকাল এগারটায়।

মেজর আবু উসমান চৌধুরী পৌঁছাতে বিলম্ব হওয়ায় পুলিশ অফিসার মাহবুবউদ্দীন আহমেদ ইপিআর আনসারের একটি ছোট্ট দল নিয়ে নেতৃবৃন্দকে অভিবাদন জানান। অভিবাদন গ্রহণের পর স্থানীয় শিল্পীদের জাতীয় সঙ্গীত পরিবেশনের মধ্যদিয়ে সৈয়দ নজরুল ইসলাম বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেন। পার্শ্ববর্তী গৌরিনগরের(অব: প্রভাষক সরকারী কলেজ মুজিবনগর) বাকের আলীর কোরআন তেলাওয়াত এবং ভবেরপাড়া গ্রামের পিন্টু বিশ্বাসের বাইবেল পাঠের মাধ্যমে শুরু হয় আনুষ্ঠানিক কার্যক্রম। এর পরে আওয়ামী লীগের চিফ হুইফ অধ্যাপক মো. ইউসুফ আলী বাংলার মুক্ত মাটিতে স্বাধীনতাকামী কয়েক হাজার জনতা এবং শতাধিক দেশি-বিদেশি সাংবাদিকের সামনে দাঁড়িয়ে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পাঠ করেন। ঐতিহাসিক সেই স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে প্রদত্ত ক্ষমতাবলে চিফ হুইফ অধ্যাপক ইউসুফ আলী রাষ্ট্রপ্রধান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অনুপস্থিতিতে উপ-রাষ্ট্র প্রধান হিসেবে সৈয়দ নজরুল ইসলামকে শপথবাক্য পাঠ করান। এরপর গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তাজউদ্দীন আহমেদের নাম ঘোষণা করেন এবং প্রধানমন্ত্রীর সাথে পরামর্শক্রমে মন্ত্রী পরিষদের সদস্য আইন, সংসদ ও পররাষ্ট্র মন্ত্রী হিসেবে খন্দকার মোশতাক আহমদ, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে এএইচএম কামরুজ্জামান এবং অর্থমন্ত্রী হিসেবে ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলীকে পরিচয় করিয়ে দেন। এ অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান উপস্থিত না থাকলেও বারবার উচ্চারিত হয় তার নাম।

মন্ত্রী পরিষদের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর প্রধান সেনাপতি হিসেবে কর্নেল এমএজি ওসমানী এবং সেনাবাহিনীর চিফ অফ স্টাফ পদে কর্নেল আব্দুর রবের নাম ঘোষণা করা হয়। এরপরে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমেদ উপস্থিত সকলের সামনে ৩০ মিনিটের এক উদ্দীপনাময় ভাষণ দেন। ভাষণে তিনি বলেন, আজ থেকে স্বাধীন বাংলাদেশের রাজধানী হবে এ বৈদ্যনাথতলা এবং এর নতুন নাম হবে মুজিবনগর। তিনি ভাষণে বিশ্ববাসীর কাছে নতুন রাষ্ট্রের স্বীকৃতি দান ও সামরিক সাহায্যের আবেদন জানান।

বক্তৃতা এবং শপথগ্রহণ পর্ব শেষে নেতৃবৃন্দ মঞ্চ থেকে নেমে এলে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতিকে গার্ড অব অনার প্রদান করেন ১২ সদস্যর টিম। তৎকালীন পুলিশ অফিসার মাহবুব উদ্দিন আহমেদ এর নেতৃত্বে ইয়াদ আলী, আনসার সদস্য আজিমুদ্দিন শেখ, সিরাজুল ইসলাম, অস্থির মল্লি¬ক, হামিদুল ইসলাম, সাহেব আলী, লিয়াকত আলী, নজরুল ইসলাম, ফকির মোহাম্মদ, মহিউদ্দিন, কেসমত আলী ও মফিজ উদ্দিন। উপস্থিত জনতার জয়বাংলা ধ্বনিতে মুখরিত হয়ে ওঠে মুজিবনগরের আ¤্রকানন। সব মিলিয়ে ঘণ্টা দু’য়েকের মধ্যে অনুষ্ঠান শেষ হয়। মুজিবনগর সরকারের নেতৃত্বেই টানা নয় মাস যুদ্ধ শেষে লাখ শহীদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত হয় বাংলার স্বাধীনতা। বিশ্বের মানচিত্রে ঠাঁই করে নেয় স্বাধীন সার্বভৌম নামের বাংলাদেশ।

      জনপ্রশাসন মন্ত্রী ও মেহেরপুর-১ আসনের সংসদ সদস্য ফরহাদ হোসেন জানান, এবার মুজিবনগর দিবস জাঁক জমক পূর্ণভাবে পালন এবং জন সমাবেশ হবে। বঙ্গবন্ধুর স্মরণে মেহেরপুরবাসী এই দিনটির অপেক্ষায় থাকে।

      জেলা প্রশাসক শামীম হাসান জানান, ঐতিহাসিক মুজিবনগর দিবস উপলক্ষে মুজিবনগরে দিনব্যাপী অনুষ্ঠানমালার আয়োজন করা হয়েছে। এ উপলক্ষে মুজিবনগর স্মৃতিসৌধে সকাল ৯টায় জাতীয় পতাকা উত্তোলনের মধ্য দিয়ে দিবসটি উদযাপনের আনুষ্ঠানিক কার্যক্রমের সূচনা হবে। এরপর মজিবনগর স্মৃতিসৌধে পুষ্পমাল্য অর্পণ শেষে প্রধান অতিথি গার্ড অব অনার গ্রহণ করবেন। এর পরপরই থাকবে আর্কষনীয় কুচকাওয়াজ প্রদর্শন ও আনসার ভিডিপি বাহিনীর পরিবেশনায় “সোনালী স্বপ্নের দেশ” শিরোনামে একটি গীতিনাট্য। মূল পর্ব সকাল সাড়ে ১০টায় শেখ হাসিনা মঞ্চে আলোচনা সভা।  আলোচনা সভায় প্রধান অতিথি হিসাবে উপস্থিত থাকবেন মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ,ক,ম মোজাম্মেল হক এমপি, মহিলা ও শিশু বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী সিমিন হোসেন রিমি সহ মন্ত্রীবর্গ, জাতীয় সংসদ সদস্য, জাতীয় পর্যায়ের বিশিষ্ট ব্যাক্তিবর্গ ও স্থানীয় লোকজন। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করবেন জনপ্রশাসন মন্ত্রী ও মেহেরপুর-১ আসনের সংসদ সদস্য ফরহাদ হোসেন।