ব্রিটিশ ভারতে ইংরেজদের অভিজাত ক্লাবের বাইরে বড় বড় হরফে লেখা থাকত, ‘‘কুকুর এবং ভারতীয়দের প্রবেশ নিষিদ্ধ।’’ ভারতের মাটিতে ভারতীয়দের প্রতি এই বৈষম্য মেনে নিতে পারেননি কেউ। ব্রিটিশ-বিরোধী আন্দোলনকে আরও জোরদার করে তুলেছিল ওই সাইনবোর্ড।ব্রিটিশরা দেশ ছেড়ে চলে গিয়েছেন। জগৎসভায় শ্রেষ্ঠত্বের আসনের আরও কাছাকাছি এগিয়েছে ভারত। কিন্তু বৈষম্য দূর হয়েছে কি? বিশ্বের নানা প্রান্তে, এমন কি প্রতিবেশি দেশগুলোর সাধারন মানুষের বড় একটি অংশের মধ্যে এখনও কিন্তু ভারতীয়দের কদর নেই। বরং ভারতীয়দের ঘৃণা করেন অনেকেই।ভারত থেকে প্রায় পাঁচ হাজার কিলোমিটার দূরে অবস্থিত দক্ষিণ কোরিয়া। চিনের উপকণ্ঠে এই দেশটিকে ঘিরে ভারতে উৎসাহ কম নয়। কোরিয়ান ব্যান্ড থেকে শুরু করে সিরিয়াল, সিরিজ়— ভারতে যথেষ্ট জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে।কিন্তু সেই কোরিয়ায় ভারতের অবস্থান কোথায়? ভারতীয়দের কী চোখে দেখেন কোরীয়রা? তা হয়তো অনেকেই জানেন না, এবং সেই তথ্য জানা থাকলে ভারতেও কোরিয়া-প্রীতি এক ধাক্কায় অনেকটা কমে যেতে পারে।ভারতীয়দের ঘৃণা করেন অধিকাংশ কোরীয়। সে দেশে প্রকাশ্যেই ভারতীয়েরা বৈষম্যের শিকার হন। সব জেনেও সে দেশের সরকার কোনও পদক্ষেপ করে না।দক্ষিণ কোরিয়ায় কোনও বর্ণবৈষম্যবিরোধী আইন নেই। অবাধেই সেখানে চলে বৈষম্যের বহিঃপ্রকাশ। এমনকি, কোরীয় বৈষম্যের হাত ধরে সেখানে ফিরেছে ব্রিটিশ আমলের সেই সাইনবোর্ড।দক্ষিণ কোরিয়ার রাজধানী সোল ছাড়াও বুসান, দায়েগু, ইঞ্চেওনের মতো বড় শহরের অভিজাত ক্লাব, রেস্তরাঁ এবং হোটেলের বাইরে বড় বড় সাইনবোর্ডে লেখা রয়েছে ভারত-বিরোধী সংলাপ— ‘ভারতীয়েরা নিয়ম মানেন না। তাঁদের প্রবেশ নিষিদ্ধ।’শুধু হোটেল, রেস্তরাঁ নয়, দক্ষিণ কোরিয়ায় প্রবাসী ভারতীয়দের অভিজ্ঞতাও খুব একটা ভাল নয়। তাঁদের কাছ থেকে জানা যায়, পথেঘাটে উঠতে-বসতে কতটা বৈষম্য এবং ঘৃণার শিকার হন ভারতীয়েরা।দক্ষিণ কোরিয়ার শপিং মল, দোকান-বাজারেও ভারতীয়দের ঢুকতে বাধা দেওয়া হয় অনেক সময়েই। দেশটিতে টিকতে না পেরে অনেকেই ভারতে ফিরে এসেছেন।দক্ষিণ কোরিয়া আসলে আদ্যন্ত বর্ণবাদী একটি দেশ। চামড়ার রং থেকে শুরু করে মুখের গড়ন, বাহ্যিক সৌন্দর্যই কোরীয় সমাজে সবচেয়ে বেশি প্রাধান্য পায়। কালো চামড়ার ভারতীয়েরা তাই পিছিয়ে থাকেন।দক্ষিণ কোরিয়ায় বাহ্যিক সৌন্দর্যকে এতটাই প্রাধান্য দেওয়া হয় যে, কলেজ পাশ করার পর ছেলেমেয়েরা বাবা-মায়ের কাছ থেকে উপহার হিসাবে পান প্লাস্টিক সার্জারির খরচ। অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে নিজেদের আরও ‘সুন্দর’ করে তোলেন তাঁরা।দেশের বিভিন্ন সংস্থায় চাকরির ইন্টারভিউতেও সৌন্দর্যকে বিশেষ ভাবে গুরুত্ব দেওয়া হয়। কে কত সুন্দর দেখতে, কার গায়ের রং কতটা উজ্জ্বল এবং ফর্সা, তার ভিত্তিতে চাকরি দেওয়া হয়।সৌন্দর্য এবং বর্ণের ভিত্তিতে বৈষম্য কোরিয়ার চাকরির বাজারে একসময় এতটাই বেড়ে গিয়েছিল যে, নিয়োগ নিশ্চিত করার আগে কোনও কর্মচারীর মুখ না দেখার নিয়ম চালু হয়েছিল বেশ কিছু সংস্থায়।ভারতীয়দের সম্পর্কে কোরিয়ার লোকজনের মধ্যে সাধারণ একটি বিদ্বেষ, ঘৃণার মনোভাব কাজ করে। ভারতীয় অর্থেই তাঁদের কাছে ‘নোংরা’, ‘বর্বর’ এবং ‘অস্পৃশ্য। যদিও এই ধরনের মানুষের ব্যতিক্রম আছে।দক্ষিণ কোরিয়ার মধ্যেই অনেক স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন, অসরকারি সংগঠন বর্ণবৈষম্যের বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে। দেশে বৈষম্যবিরোধী আইন প্রণয়নের চেষ্টাও চলছে। রাষ্ট্রপুঞ্জের তরফেও ওই আইন প্রণয়নের জন্য একাধিক বার দক্ষিণ কোরিয়া সরকারকে পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।স্বাধীনতা লাভের পরেও দীর্ঘ দিন দক্ষিণ কোরিয়ার সঙ্গে ভারতের কোনও দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক গড়ে ওঠেনি। আমেরিকা ঘনিষ্ঠ এই দেশ দীর্ঘ সময় পর্যন্ত ভারতকে রাশিয়ার ‘বন্ধু’ মনে করে দূরে সরিয়ে রেখেছিল।ফলে ভারত এবং দক্ষিণ কোরিয়ার মধ্যে প্রথম দিন থেকেই অলিখিত দূরত্ব তৈরি হয়েছে। পরে দুই দেশের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক গড়ে উঠলেও বাসিন্দাদের মন থেকে সেই দূরত্ব ঘোচেনি।স্যামসাং, হুন্ডাইয়ের মতো কোরিয়ান সংস্থা ভারতের বাজারে চুটিয়ে ব্যবসা করছে। ভারত থেকে তাদের লক্ষ্মীলাভও হচ্ছে বিস্তর। কিন্তু সে দেশে ভারতীয়দের কার্যত ‘অস্পৃশ্য’ করে রাখা হয়েছে।বিশেষজ্ঞদের মতে, ভারতীয় সংস্কৃতি, রীতি-রেওয়াজ সম্পর্কে দক্ষিণ কোরিয়ার মানুষদের কিছু বদ্ধমূল ভুল ধারণা রয়েছে। তা দূর করা দরকার। তার জন্য দুই দেশের মধ্যে আদানপ্রদান আরও বাড়িয়ে তুলতে হবে। তবেই ঘুচবে দূরত্ব। আনন্দবাজার পত্রিকার সৌজন্য।