বান্দরবানের রুমা ও থানচিতে রাষ্ট্রায়ত্ত দুই ব্যাংকের তিন শাখায় ডাকাতির ঘটনায় নতুন করে আলোচনায় এসেছে পাহাড়ি সশস্ত্র সংগঠন কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট (কেএনএফ)। গত কয়েকদিনে ব্যাংক ডাকাতি ও বাজারে হামলার মাধ্যমে সন্ত্রাসী এ সংগঠন নিজেদের শক্তি জানান দেওয়ার চেষ্টা করছে। এ অবস্থায় পাহাড়ি সশস্ত্র এ সন্ত্রাসী সংগঠনের শক্তিমত্তা ও সদস্য সংখ্যা নিয়ে কৌতুহল অনেকের। অবশ্য কেএনএফ নিজেই বিষয়টি পরিষ্কার করেছে। সংগঠনটির দাবি, মিয়ানমার ও পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রায় চার হাজার সশস্ত্র সদস্য আছে তাদের।রোববার (৭ এপ্রিল) দিনগত রাত ১২টার দিকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রচার করা এক পোস্টে এ দাবি করা হয়েছে। সংগঠনটির পক্ষে এ তথ্য জানিয়েছেন আর্কাইভ ডিভিশনের কর্মকর্তা মি. মিঙ্গা।ওই পোস্টে বলা হয়, ‘বর্তমানে মিয়ানমার ও পার্বত্য চট্টগ্রামে এ সংগঠনের সামরিক প্রশিক্ষণে প্রশিক্ষিত সদস্যের (সশস্ত্র ও নিরস্ত্র সক্রিয় সদস্য) সংখ্যা ৪ হাজারেরও অধিক। বর্তমান সরকারকে সতর্ক করা হচ্ছে যে, কেএনএফের দাবি অচিরেই মেনে না নিলে সশস্ত্র আন্দোলন কঠিন রূপ নিতে বাধ্য হবে। যার জন্য কেএনএফ দায়ী থাকবে না।’দেশের গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনেও কেএনএফের এই দাবির পক্ষে তথ্য পাওয়া গেছে।খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, শুধু মিয়ানমার নয়, কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্টের (কেএনএফ) সদস্যরা প্রশিক্ষণ নেয় ভারতেও। কেএনএফের সশস্ত্র সদস্যদের প্রাথমিক প্রশিক্ষণের মেয়াদ তিন মাস। এর মধ্যে এক মাস ভারতের মিজোরামে তাত্ত্বিক ও শারীরিক প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। বাকি দুই মাস মিয়ানমারের বিচ্ছিন্নতাবাদী গ্রুপের সঙ্গে মিয়ানমার আর্মির বিরুদ্ধে যুদ্ধের মাধ্যমে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়।কেএনএফের দাবি, বিশেষ প্রয়োজনের তাগিদে ২০১৭ সালে সশস্ত্র শাখায় রূপ নেয় কেএনএফ। প্রথম অবস্থায় সশস্ত্র শাখাটির নাম রাখা হয় কুকি-চিন ন্যাশনাল ভলান্টিয়ার বা কেএনভি। এই কেএনভি কয়েক বছর গোপনে তাদের সাংগঠনিক কার্যক্রম পরিচালনা করে। পরবর্তী সময়ে ভারতের মণিপুর এবং মিয়ানমারের বিদ্রোহী গ্রুপগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলে।২০১৭ সালে সংগঠনটির কেন্দ্রীয় কমিটি তাদের কয়েকশ সদস্যকে ভারতের মণিপুর রাজ্যে সামরিক প্রশিক্ষণে পাঠায়। পরবর্তী সময়ে শতাধিক সদস্য মিয়ানমারের কাচিন, কারেন প্রদেশ এবং ভারতের মণিপুর রাজ্যে প্রশিক্ষণে অংশ নেয়। ২০১৯ সালে ইনফেন্ট্রি কমান্ডো প্রশিক্ষণ শেষে কয়েকশ সদস্য সশস্ত্র অবস্থায় ফিরে আসে। এরপর তারা গোপনে তাদের কার্যক্রম চালাতে থাকে বলে দাবি সংগঠনটির।মূলত বান্দরবান জেলার রুমা উপজেলার কেওক্রাডং পর্বতের আশপাশের পাহাড়ে কুকি-চিনের আস্তানা। তবে তাদের অধিকাংশ সদস্য বর্তমানে ছদ্মবেশে মিশে আছে সাধারণ মানুষের সঙ্গে। চাঁদাবাজি-লুটপাটসহ বিভিন্ন অপকর্মের লক্ষ্যে স্বল্প সময়ের জন্য লোকালয়ে এলেও কাজ শেষে দ্রুতই ফের আস্তানায় ফিরে যায় সশস্ত্র এসব সন্ত্রাসী। এমনকি অনেকেই প্রতিবেশী দেশে আশ্রয় নেয় বলেও অভিযোগ রয়েছে।রুমা ও থানচির দুই ব্যাংকের তিন শাখায় ডাকাতি ও লুটপাটের পর কুকি-চিন সদস্যরা আর লোকালয়ে আসেনি। গতকাল রোববার থেকে যৌথ বাহিনীর সমন্বিত অভিযানে টিকতে না পেরে সন্ত্রাসী এ সংগঠনের কিছু সদস্য সীমান্ত পেরিয়ে প্রতিবেশী দেশে চলে গেছে বলেও একাধিক সূত্রে জানা গেছে।২০২২ সালে ফেসবুকে পেজ খুলে পার্বত্য চট্টগ্রামের সশস্ত্র গোষ্ঠী হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট (কেএনএফ)। শুরু থেকেই পার্বত্য চট্টগ্রামে স্বায়ত্তশাসিত পৃথক রাজ্য প্রতিষ্ঠার দাবি জানিয়ে আসছিল কেএনএফ। নয়টি উপজেলা নিয়ে পৃথক রাজ্য গঠনের দাবি তাদের। সম্প্রতি সে দাবি থেকে সরে এসেছে বিচ্ছিন্নতাবাদী সশস্ত্র এ গোষ্ঠী। তারা ওই অঞ্চলের সাতটি উপজেলা নিয়ে ‘স্বশাসিত পরিষদ’ প্রতিষ্ঠার দাবি তুলেছে।
দুবছর আগে ২০২২ সালে নিজেদের সামরিক প্রশিক্ষণের ভিডিও ফেসবুক ও ইউটিউবে আপ করে সংগঠনটি। সে সময় তারা ফেসবুকে নিজেদের কমান্ডো টিম ‘হেড হান্টার’ সম্পর্কে জানায়। ওই বছরের জুলাইয়ে ফেসবুক পোস্টে কেএনএফ জানায়, তাদের একদল কমান্ডো মিয়ানমারের কাচিন থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে ফিরে এসেছে। এরপর আগস্টে সামরিক পোশাক পরিহিত একদল ব্যক্তির ছবি দিয়ে কেএনএফ দাবি করে এরা তাদের কমান্ডো।তবে গোয়েন্দা সূত্র ও স্থানীয়রা বলছেন, কেএনএফের সশস্ত্র সদস্য সংখ্যা শুরুতে খুব বেশি ছিল না। তখন হয়তো ১৫ থেকে ২০ জনের মতো সদস্য ছিল। কিন্তু পরে তাদের সংখ্যা বাড়ে। পরের দুই বছরে অন্তত নয়টি বড় ধরনের সন্ত্রাসী ঘটনা ঘটিয়েছে কেএনএফ। গত বছর কেএনএফের সন্ত্রাসীদের চারটি হামলার ঘটনায় পাঁচ সেনাসদস্য নিহত হন। এছাড়া এক আওয়ামী লীগ নেতাসহ অন্তত ১০ জন বেসামরিক মানুষকে হত্যা করে কেএনএফ।জঙ্গি সংগঠন জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়ার সদস্যদের দুর্গম পাহাড়ে সশস্ত্র প্রশিক্ষণ দেওয়ার অভিযোগও আছে কেএনএফের বিরুদ্ধে। ২০২২ সালে জঙ্গিদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার অভিযোগ ওঠে। সেসময় পার্বত্য এলাকায় ‘জঙ্গি বিরোধী’ সমন্বিত অভিযানের পর কেএনএফের সশস্ত্র তৎপরতা খুব একটা দৃশ্যমান ছিল না। তবে গত সপ্তাহে বান্দরবানের রুমা ও থানচিতে ব্যাংক ডাকাতি ও হামলার ঘটনায় নতুন করে আলোচনায় আসে কেএনএফ।
নতুন হামলার কারণ কী
স্থানীয়দের সূত্রে জানা যায়, পার্বত্য চট্টগ্রামে বম, পাংখোয়া, লুসাই, খিয়াং, ম্রো ও খুমি জাতিগোষ্ঠীর মানুষ নিয়ে গঠিত হয়েছে কেএনএফ। মূলত সীমান্তের ওপারে কুকি-চিনদের নানামুখী আন্দোলন ও তৎপরতা অনুপ্রেরণা যুগিয়েছে এসব ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর কিছু সদস্যকে।নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর (অব.) এমদাদুল ইসলাম বলেন, ‘কেএনএফের সশস্ত্র তৎপরতার সঙ্গে ভারতের মণিপুরের কুকিদের সঙ্গে স্থানীয় মেইতেইদের চলমান সশস্ত্র বিরোধ এবং মিয়ানমারের বিভিন্ন গোষ্ঠীর সঙ্গে সরকারি বাহিনীর অব্যাহত সংঘাতের যোগসূত্র রয়েছে।’
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. রাহমান নাসির উদ্দিন বলেন, ‘কেএনএফের সঙ্গে শান্তি প্রতিষ্ঠা কমিটি যখন সংলাপ করছে, আলাপ-আলোচনা চলছে, সেসময় এ ধরনের শোডাউন, ব্যাংক ডাকাতি, অস্ত্র লুট এবং অপহরণের ঘটনা খুব স্বাভাবিক নয়।’
তিনি মনে করেন এর পেছনে তিনটি কারণ থাকতে পারে। প্রথমত, কেএনএফ তাদের শক্তিমত্তার জানান দেওয়ার চেষ্টা করেছে। দ্বিতীয়ত, কেএনএফের মধ্যকার অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব এ ঘটনার মধ্য দিয়ে বের হয়ে এসেছে। তৃতীয়ত, নিজেদের পক্ষ থেকে সংলাপ ভেস্তে দিতেই এ নতুন ঘটনা ঘটিয়েছে।অধ্যাপক ড. রাহমান নাসির উদ্দিন বলেন, ‘যেহেতু ভারতের মণিপুরের কুকিরা একটা শক্ত প্রতিরোধ তৈরি করছে। আবার মিয়ানমারের চিন রাজ্যে চিন ন্যাশনাল ডিফেন্স ফোর্স জান্তা বাহিনীকে পরাজিত করে একের পর এক শহর দখল করছে। এ অবস্থায় বাংলাদেশে বসে কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট শান্তির চুক্তি সইয়ের নামে আত্মসমর্পণ করবে- এটা তারা মানতে পারছে না। তাই নিজেদের পক্ষ থেকে সংলাপের পরিবেশ নষ্ট করতে এ শোডাউন করেছে কেএনএফ।’