সাংবিধানিক অধিকারের কথা বলে বুয়েটে ছাত্ররাজনীতি ফিরিয়ে আনা একটি নিষ্ঠুর প্রতারণা বলে মন্তব্য করেছে জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল।বুয়েটের সাধারণ শিক্ষার্থীদের ছাত্ররাজনীতিবিরোধী আন্দোলনের সঙ্গে একাত্মতা পোষণ করে সংগঠনটির নেতারা বলছেন, বুয়েট ক্যাম্পাসে ছাত্ররাজনীতি থাকবে কি না, তা নির্ধারণ করবে সেখানকার শিক্ষার্থীরা।সাংবিধানিক অধিকারের কথা বলে ছাত্রলীগ বুয়েটে ছাত্ররাজনীতি ফিরিয়ে আনার যে কথা বলেছে তা একটি নিষ্ঠুর প্রতারণা।ছাত্রদল নেতারা বলছেন, ছাত্ররাজনীতির নামে ছাত্রলীগ ক্যাম্পাসে একক দখলদারিত্ব এবং শিক্ষার্থী নির্যাতনের টর্চার সেল পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে চাচ্ছে। একই সঙ্গে ছাত্ররাজনীতি চালু করতে হলে ক্যাম্পাসে সব রাজনৈতিক সংগঠনের সহাবস্থান নিশ্চিত করা আবশ্যক।বুধবার (৩ এপ্রিল) ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে (ডিআরইউ) ‘বুয়েট সংকট: সন্ত্রাসমুক্ত শিক্ষাঙ্গন এবং গণতান্ত্রিক ছাত্র রাজনীতির দাবিতে’ এক সংবাদ সম্মেলনে ছাত্রদল নেতারা এসব কথা বলেন। সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন ছাত্রদলের সভাপতি রাকিবুল ইসলাম রকিব। তিনি বলেন, বুয়েটের উদ্ভূত পরিস্থিতি ছাত্রদল অত্যন্ত গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছে। ছাত্রদল মনে করে, ছাত্রলীগের প্রাণঘাতী নির্যাতন থেকে নিস্তার পেতেই বুয়েটের শিক্ষার্থীরা ছাত্রলীগের রাজনীতির বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। শহীদ আবরার ফাহাদকে পূর্বপরিকল্পিতভাবে খুন করার পরে মুষ্টিমেয় দুই-একজন বাদে বুয়েটের সব শিক্ষার্থী সন্ত্রাসী সংগঠন ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে, যদিও ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্রে নিরাপত্তার অভাবে তারা ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ করার কথা বলেছে। ছাত্রদল মনে করে বুয়েটের শিক্ষার্থীদের আপাতদৃষ্টিতে ছাত্ররাজনীতির বিরুদ্ধে যে অবস্থান তার একক দায়ভার ছাত্রলীগের। ছাত্রলীগ দীর্ঘদিন ধরে খুনি, ধর্ষক, নারী নির্যাতনকারী, প্রশ্নফাঁসকারী, মাদকব্যবসায়ী এবং টেন্ডারবাজদের অভয়ারণ্য। দেশের ছাত্ররাজনীতির ইতিহাসকে কলঙ্কিত করেছে ছাত্রলীগ। ছাত্রদলসহ কোনো গণতান্ত্রিক ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগের এই দুষ্কর্মের দায়ভার বহন করবে না।
তিনি আরও বলেন, বুয়েটে রাজনীতি নিষিদ্ধ হওয়ার পরে বুয়েটের শিক্ষার্থীরা স্বস্তি এবং নিরাপত্তা লাভ করেছে। কারণ বুয়েটসহ সারাদেশের প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্রলীগ টর্চার সেল গড়ে তুলেছে। শহীদ আবরার ফাহাদ হত্যাকাণ্ডের পরে বুয়েটের টর্চার সেলগুলো বন্ধ হলেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় এবং সরকারি কলেজগুলোর হলে ছাত্রলীগের টর্চার সেলে নির্যাতন অব্যাহত রয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গেস্টরুমে ছাত্রদের মারধর করার শতাধিক ঘটনা বিভিন্ন সময়ে জাতীয় পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো হলে ছাত্রদলসহ অন্যান্য বিরোধী দলের সমর্থক কোনো শিক্ষার্থী অবস্থান করতে পারে না। ছাত্রদল সমর্থন করার কারণে এযাবত পাঁচ শতাধিক ছাত্রকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এর হল থেকে পাশবিক নির্যাতন করে বের করে দেওয়া হয়েছে।
মধুর ক্যান্টিন দখলে রেখে ছাত্রলীগ বিশ্ববিদ্যালয়ের গণতন্ত্র চর্চার কফিনে শেষ পেরেক মেরেছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধুর ক্যান্টিন ছাত্ররাজনীতির আতুড়ঘর এবং গণতন্ত্র চর্চার তীর্থস্থান হিসেবে খ্যাত ছিল। কিন্তু ছাত্রলীগ গত পনের বছর ধরে এককভাবে মধুর ক্যান্টিন দখলে রেখে বিশ্ববিদ্যালয়ের গণতন্ত্র চর্চার কফিনে শেষ পেরেক মেরে দেয়। মধুর ক্যান্টিনে নিষ্ঠুর ফ্যাসিবাদ কায়েম করে বুয়েটে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে যাওয়া একটি প্রহসন। এর পেছনে রাজনীতি চর্চার কোনো উদ্দেশ্য নেই। বরং বুয়েটের ক্যান্টিন, মেস, দোকানপাট থেকে চাঁদাবাজি এবং উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ড থেকে টেন্ডারবাজি করতে না পারার হতাশা থেকে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় নেতারা ছাত্রলীগ সমর্থক নগণ্য সংখ্যক বিপথগামী বুয়েটের শিক্ষার্থীর সহায়তায় ক্যাম্পাসে পুনরায় লুটপাট এবং সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড শুরু করার ষড়যন্ত্র করেছে।
বুয়েটে ছাত্রলীগের কার্যক্রম চালু করার পদক্ষেপ বুয়েটের সাধারণ শিক্ষার্থীদের জীবনের নিরাপত্তার জন্য হুমকিস্বরূপ উল্লেখ করে তিনি বলেন, বুয়েটের শিক্ষার্থীরা এখন শঙ্কিত এই কারণে যে, ছাত্রলীগের কার্যক্রম পুনরায় চালু হলে তাদের পড়াশোনা এবং ক্লাস পরীক্ষা বাদ দিয়ে ছাত্রলীগের মিছিল-মিটিং ও গেস্টরুমে হাজিরা দিতে হবে। তাদের কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ না করলে শারীরিক নির্যাতনের শিকার হতে হবে। ছাত্রলীগের ক্যাডারদের বিরাগভাজন হলে হল থেকে বিতাড়িত করা হতে পারে। বুয়েটের প্রতিটি শিক্ষার্থী আতঙ্কিত কারণ, যেকোনো মুহূর্তে তাদের যে কারও জীবনে ছাত্রলীগের নির্যাতনে শহীদ আবরারের মতো মর্মান্তিক পরিণতি নেমে আসতে পারে। ছাত্রলীগের উপস্থিতিতে বুয়েটের সাধারণ শিক্ষার্থীদের জীবনের নিরাপত্তাহীনতা এবং একাডেমিক পড়াশোনার ক্ষতির আশঙ্কাকে আমরা অত্যন্ত যৌক্তিক মনে করছি। এ বিষয়ে আমরা অত্যন্ত উদ্বিগ্ন।
রাকিবুল ইসলাম রকিব বলেন, ছাত্রলীগ ক্যাম্পাসগুলোতে ‘টোটালিটারিয়ান ভায়োলেন্ট অ্যাক্টিভিজম’ করছে। ক্যাম্পাসে ভায়োলেন্স এবং টর্চারকে ছাত্ররাজনীতি বলা যায় না। ছাত্ররাজনীতি চালু করতে হলে সব রাজনৈতিক সংগঠনের সহাবস্থান নিশ্চিত করা আবশ্যক। ক্যাম্পাসে এবং হলে সব রাজনৈতিক সংগঠনকে অবাধে রাজনৈতিক কার্যক্রম চালানোর সুযোগ দিতে হবে। সব শিক্ষার্থীকে স্বাধীনভাবে মতপ্রকাশের সুযোগ দিতে হবে।
আদালতের নির্দেশে বুয়েটে ছাত্ররাজনীতি ফিরছে, এখন ছাত্রদল কমিটি দেবে কি না এমন প্রশ্নের জবাবে ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক বলেন, ছাত্রলীগ প্রগতিশীলতার নাম করে ক্যাম্পাসে নব্য মৌলবাদ সৃষ্টি করেছে। খুনের রাজত্বের মাধ্যমে তারা ক্যাম্পাসে ভয়ের সৃষ্টি করেছে। বুয়েটে ছাত্ররাজনীতি থাকবে কি না তা নির্ধারণ করবে সেখানকার সাধারণ শিক্ষার্থীরা। এখন তারা যদি আমাদের স্বাগত জানায়, তাহলে আমরা ক্যাম্পাসে সাংগঠনিক কর্মতৎপরতা বাড়াব।
ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক নাছির উদ্দিন নাছিরের সঞ্চালনায় সংবাদ সম্মেলনে আরও উপস্থিত ছিলেন ছাত্রদলের সিনিয়র সহ-সভাপতি আবু আফসান মোহাম্মদ ইয়াহিয়া, সিনিয়র যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক শ্যামল মালুম, সাংগঠনিক সম্পাদক আমানউল্লাহ আমান, দপ্তর সম্পাদক জাহাঙ্গীর প্রধান, প্রচার সম্পাদক শরীফ প্রধান শুভ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদলের সভাপতি গণেশ চন্দ্র রায় সাহস, সাধারণ সম্পাদক নাহিদুজ্জামান শিপন প্রমুখ।