সারা দ্বীপে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে গুটিকয়েক কাঠের বাড়ি। সেই কাঠের বাড়িগুলিই আস্তানা দ্বীপের বাসিন্দাদের। নৌকা ছাড়া আর কোনও ভাবেই যাতায়াত সম্ভব নয় এই প্রত্যন্ত দ্বীপে। কোথায় রয়েছে এই দ্বীপ?প্রশান্ত মহাসাগরের দক্ষিণাংশে রয়েছে একাধিক আগ্নেয় দ্বীপ। সেগুলির মধ্যে একমাত্র বসবাসযোগ্য দ্বীপ হল পিটকায়ের্ন। ২০২১ সালের জনগণনা অনুযায়ী এই দ্বীপের জনসংখ্যা ৪৭।পিটকায়ের্ন দ্বীপ প্রথম নজরে পড়ে এক ১৫ বছরের বালকের। ১৭৬৭ সালের ৩ জুলাই প্রশান্ত মহাসাগরের উপর দিয়ে ভেসে চলেছিল ব্রিটেনের নৌবাহিনীর অন্তর্গত একটি যুদ্ধজাহাজ এইচএমএস সোয়ালো। এই যুদ্ধজাহাজের ক্যাপ্টেন ছিলেন ফিলিপ কার্টেরেট।যুদ্ধজাহাজের মধ্যে ছিল ১৫ বছর বয়সি রবার্ট পিটকায়ের্ন। ব্রিটেনের নৌবাহিনীর মেজর জন পিটকায়ের্নের পুত্র রবার্ট। ১৭৭৫ সালে বাঙ্কার হিলের যুদ্ধে প্রাণ হারান জন।যুদ্ধজাহাজে যাওয়ার সময় দূরে একটি ছোট দ্বীপ নজরে পড়ে রবার্টের। যে হেতু সে প্রথম দ্বীপের সন্ধান পেয়েছিল তাই তার উপাধি অনুসারে দ্বীপের নাম রাখা হয় পিটকায়ের্ন।১৭৯০ সালের ঘটনা। পিটকায়ের্ন দ্বীপে আটকে পড়ে ব্রিটেনের একটি জাহাজ। সেই জাহাজে ছিলেন ন’জন নৌসেনা, তাহিতি দ্বীপ থেকে আসা ছ’জন পুরুষ, ১১ জন মহিলা এবং এক শিশু।পিটকায়ের্ন দ্বীপে পৌঁছনোর পর জাহাজ পুড়িয়ে সেই দ্বীপেই পাকাপাকি ভাবে বাস করার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেন ২৭ জন যাত্রী। চাষবাস এবং মাছ ধরে দিন কাটাতেন তাঁরা। পাঁচ বছর ওই দ্বীপে ‘বন্দি’ ছিলেন সকলে। মূল ভূখণ্ডে ফেরার জন্য ব্যাকুল হয়ে ওঠেন তাঁরা।১৭৯৫ সালে পিটকায়ের্ন দ্বীপ থেকে একটি জাহাজ দেখতে পান সেখানকার বাসিন্দারা। জাহাজের নজর কাড়ার চেষ্টা করেন বাসিন্দারা। কিন্তু সেই জাহাজ দ্বীপে এসে থামেনি। তার ছ’বছর পর ১৮০১ সালে অন্য একটি জাহাজ নজরে পড়ে তাঁদের। কিন্তু সেই জাহাজও দ্বীপের সামনে দিয়ে চলে যায়।বহির্জগতের সঙ্গে কোনও উপায়েই যোগাযোগ করতে পারছিলেন না পিটকায়ের্নের বাসিন্দারা। ইতিহাসবিদদের দাবি, কয়েক বছরের মধ্যে আরও একটি জাহাজ দ্বীপের সামনে দিয়ে চলে যায়। জাহাজ থেকে দ্বীপের বা়ড়িগুলি দেখতে পেলেও সেই জাহাজের ক্যাপ্টেন দ্বীপের দিকে কোনও নৌকা পাঠাননি বলেও দাবি করা হয়।১৮০৮ সাল পর্যন্ত পিটকায়ের্ন দ্বীপেই ‘বন্দি’ থাকেন সেখানকার বাসিন্দারা। ১৮০৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে টোপাজ় নামে আমেরিকার একটি জাহাজ পিটকায়ের্ন দ্বীপে নোঙর ফেলে। জাহাজের অন্য কর্মীদের সঙ্গে ওই দ্বীপে ১০ ঘণ্টা সময় কাটান জাহাজের ক্যাপ্টেন মেহিউ।পিটকায়ের্ন দ্বীপে যে জনবসতি রয়েছে তা মেহিউয়ের মাধ্যমে জানাজানি হয়ে যায়। তার পর থেকে ওই দ্বীপের সামনে দিয়ে কোনও জাহাজ অতিক্রম করলেই কেউ না কেউ দ্বীপবাসীদের কাছে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস পৌঁছে দিতেন।১৮৩৮ সালের ৩০ নভেম্বর পিটকায়ের্ন দ্বীপ ব্রিটিশ শাসনের অন্তর্ভুক্ত হয়। ১৮৫০ সালের মাঝামাঝি সময়ে পিটকায়ের্ন দ্বীপের বাসিন্দারা ব্রিটেন সরকারের কাছে তাঁদের বসবাসের জায়গা আরও বৃদ্ধির অনুমতি চাইতে পাঁচ সপ্তাহ সমুদ্রপথে যাত্রা করে ১৯৩ জন নিকটবর্তী নরফক দ্বীপে যান।নরফক দ্বীপে পৌঁছনোর ১৮ মাস পর ১৭ জন আবার পিটকায়ের্ন দ্বীপে ফিরে যান। তার পাঁচ বছরের মধ্যে আরও ২৭ জন পিটকায়ের্ন দ্বীপে ফিরে যান। বাকিরা নরফক দ্বীপে স্থায়ী ভাবে থেকে যান।পিটকায়ের্ন দ্বীপে মাঝেমধ্যেই ইংল্যান্ডের তরফে সাহায্য করা হত। ১৮৭৮ সালে দু’টি বড় আকারের নৌকা, সিমেন্ট, ৯১ কেজি বিস্কুট, ৪৫ কেজি ওজনের মোমবাতি, ৪৫ কেজি ওজনের সাবান এবং জামাকাপড় দ্বীপের বাসিন্দাদের পাঠানো হয়।এমনকি পিটকায়ের্ন দ্বীপের বাসিন্দারা তুলোর চাষ করে যেন ব্যবসা করতে পারেন, সে কারণে ইংল্যান্ডের তরফে তুলোর বীজও পাঠানো হয় ১৮৮২ সালে।বহির্জগতের সঙ্গে যোগাযোগ না থাকায় এর প্রভাব পড়ে পিটকায়ের্ন দ্বীপের মহিলাদের উপর। এক প্রতিবেদনে দাবি করা হয়, দ্বীপের অধিকাংশ মহিলাই যৌন নিগ্রহের শিকার হয়েছেন। ১৯৯৯ সালে ব্রিটেনের এক পুলিশ আধিকারিক দ্বীপে গেলে এক ১৫ বছরের নাবালিকা ধর্ষণের অভিযোগ দায়ের করে।ব্রিটেনের পাশাপাশি নিউ জ়িল্যান্ড এবং অস্ট্রেলিয়ার পুলিশ কম সময়ের ব্যবধানে পিটকায়ের্ন দ্বীপে গিয়েছিল। সেই দ্বীপে যত মহিলা ছিলেন, সকলের সঙ্গেই কথা বলেন পুলিশকর্মীরা। তাঁদের সঙ্গে কথা বলে পুলিশ জানতে পারে, সেখানকার অধিকাংশ মহিলাকেই ধর্ষণ করা হয়েছে।পুলিশ সূত্রে খবর, পিটকায়ের্ন দ্বীপে পুরুষের সংখ্যা বেশি। ১২ বছর হলেই মেয়েরা সন্তানধারণে সম্ভব, এমন চিন্তাভাবনা পোষণ করতেন সেই দ্বীপের বাসিন্দারা।পুলিশ সূত্রে খবর, ধর্ষণে অভিযুক্তদের তালিকায় পিটকায়ের্ন দ্বীপের অধিকাংশ পুরুষের পাশাপাশি নাম ছিল সেখানকার মেয়র মাইক ওয়ারেনেরও। ২০০৮ সাল থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত ওই দ্বীপের মেয়র ছিলেন মাইক। ধর্ষণের অভিযোগের ভিত্তিতে সকলকে হাজতবাসের নির্দেশ দেওয়া হয়। নির্দিষ্ট সময় জেলবন্দি থাকার পর জামিনে ছেড়ে দেওয়া হয় তাঁদের।পিটকায়ের্ন দ্বীপে নৌকা ছাড়া আর কোনও ভাবে যাতায়াত করা সম্ভব নয়। এখনও বাইরে থেকে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস পৌঁছে দেওয়া হয় এই প্রত্যন্ত দ্বীপের বাসিন্দাদের কাছে।