নারী একটা সময় ঘরবন্দিই ছিল। সময়ের পরিবর্তনে ভাগ্য বদলেছে তাদেরও।বাড়ির চৌকাঠ ডিঙিয়ে নারী এখন পা রাখছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও কর্মক্ষেত্রে। ঘরে এবং বাইরে সমানতালে এগিয়ে যাচ্ছে নারী। কর্মক্ষেত্রে দিন দিন বাড়ছে নারীর অংশগ্রহণও। বিশেষ করে চিকিৎসাখাতে এক দশক আগের তুলনায়ও নারীর অংশগ্রহণ বাড়ছে। এমনকি চিকিৎসাখাতের নেতৃত্বেও রয়েছেন অনেক নারী। চিকিৎসা পেশায় নারীর এই অগ্রযাত্রায় যেমন সুবিধা আছে, তেমনি আছে চ্যালেঞ্জও। সুবিধা নেওয়ার বিষয়টি ধরে রেখে চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় করণীয় নির্ধারণ করে বাস্তবায়নের কথা বলছেন সংশ্লিষ্টরা। মেডিক্যালে পড়াশোনায় নারীর সাফল্যসাম্প্রতিক বছরগুলোতে চিকিৎসা বিষয়ে পড়াশোনায় নারীর এগিয়ে থাকার চিত্র উঠে আসছে এমবিবিএস ভর্তি পরীক্ষায়। ২০২৩-২০২৪ শিক্ষাবর্ষে এমবিবিএস প্রথম বর্ষের ভর্তি পরীক্ষার ফলাফলে দেখা যায়, পাসের হারে ছেলেদের চেয়ে মেয়েরা এগিয়ে রয়েছেন। উত্তীর্ণ পুরুষ প্রার্থী ২০ হাজার ৪৫৭ জন, যা উত্তীর্ণ প্রার্থীর ৪০ দশমিক ৯৮ শতাংশ। উত্তীর্ণ নারী প্রার্থীর সংখ্যা ২৯ হাজার ৪৬৬ জন, যা মোট প্রার্থীর ৫৯ দশমিক ০২ শতাংশ। অর্থাৎ ছেলেদের চেয়ে নয় হাজার নয় জন মেয়ে বেশি উত্তীর্ণ হয়েছেন। পরীক্ষায় প্রাপ্ত সর্বোচ্চ নম্বরও পেয়েছেন তানজিম মুনতাকা সর্বা।
এর আগের বছর ২০২২-২৩ শিক্ষাবর্ষের এমবিবিএস প্রথম বর্ষের ভর্তি পরীক্ষার প্রকাশিত ফলাফলে দেখা যায়, ভর্তি পরীক্ষায় মোট উত্তীর্ণ হয়েছেন ৪৯ হাজার ১৯৪ শিক্ষার্থী। এর মধ্যে মেয়ে উত্তীর্ণ হয়েছেন ২৮ হাজার ৩৮১ জন অর্থাৎ ৫৭ দশমিক ৬৯ শতাংশ। আর ছেলেদের মধ্যে উত্তীর্ণ হয়েছেন ২০ হাজার ৮১৩ জন, যা ৪২ দশমিক ৩১ শতাংশ। এক্ষেত্রে ছেলেদের থেকে মেয়ে সাত হাজার ৫৬৮ জন বেশি পাস করেছেন।
২০২১-২০২২ শিক্ষাবর্ষে এমবিবিএস প্রথম বর্ষের ভর্তি পরীক্ষার ফলাফলে দেখা যায়, প্রাথমিকভাবে যোগ্য বিবেচিত হন ৭৯ হাজার ৩৩৭ জন। এর মধ্যে ৫৫ দশমিক ১৩ শতাংশই ছাত্রী। পরীক্ষায় যোগ্য বিবেচিতদের মধ্যে ৩৪ হাজার ৮৩৩ জন ছাত্র এবং ৪৪ হাজার ৫০৪ জন ছাত্রী। ছেলেদের থেকে মেয়েরা নয় হাজার ৬৭১ জন বেশি পাস করেছেন।
২০২০-২১ শিক্ষাবর্ষের এমবিবিএস ভর্তি পরীক্ষার ফলাফলে দেখা যায়, ৪৮ হাজার ৯৭৫ জন পরীক্ষার্থী পাস করেন। এর মধ্যে সরকারি মেডিকেল কলেজে ৪ হাজার ৩৫০ জন ভর্তির সুযোগ পান। সরকারি মেডিকেল কলেজে সুযোগ পাওয়া শিক্ষার্থীদের মধ্যে দুই হাজার ৩৪১ জন মেয়ে ও দুই হাজার ৯ জন ছেলে। এক্ষেত্রেও ছেলেদের থেকে মেয়েরা ৩৩২ জন বেশি। সেবার মেধা তালিকায় প্রথম স্থান অর্জন করেন মিশোরী মুনমুন।
২০১৯-২০ শিক্ষাবর্ষে সরকারি ও বেসরকারি মেডিকেল কলেজে এমবিবিএস কোর্সের প্রথম বর্ষে ভর্তি পরীক্ষার উত্তীর্ণ হন ৪৯ হাজার ৪১৩ জন। এদের মধ্যে মেয়ে ২৬ হাজার ৫৩১ জন, আর ছেলে ২২ হাজার ৮৮২ জন। ওই বছরেও ছেলেদের থেকে মেয়েরা তিন হাজার ৬৪৯ জন বেশি উত্তীর্ণ হন।
নারীর অধিক অংশগ্রহণ স্বাস্থ্যসেবায় ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে
নারী মায়ের এবং বোনের জাতি। নারীদের মধ্যে সেবার মানসিকতা সবসময়ই বিদ্যমান। চিকিৎসার মত সেবাধর্মী পেশায় নারীর অধিকমাত্রায় অংশগ্রহণ এবং সাফল্য স্বাস্থ্যসেবার ক্ষেত্রে ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে বলেই সংশ্লিষ্টদের অভিমত। পাশাপাশি নারী চিকিৎসক বাড়লে স্বাস্থ্যসেবায় কিছু চ্যালেঞ্জও দেখা দিতে পারে বলে জানান সংশ্লিষ্টরা। সেক্ষেত্রে সমস্যা এবং সম্ভাবনার দুটোর সমন্বয় করে সমাধানের উদ্যোগ গ্রহণ জরুরি বলে তারা জানান।
শ্যামলী ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট টিবি হাসপাতালের সহকারী পরিচালক ডা. আয়েশা আক্তার এ বিষয়ে বলেন, আমাদের সময় মেডিক্যাল শিক্ষার্থীর সংখ্যা ছেলেদের তুলনায় মেয়ে একেবারেই কম ছিল। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জন্য, নারী শিক্ষা, স্বনির্ভরতা, নারীর ক্ষমতায়ন বৃদ্ধি পেয়েছে। পাশাপাশি নারীরা সুরক্ষিত পরিবেশ এবং স্বাধীনভাবে চলাফেরা করতে পারছে বলেই সব ক্ষেত্রে ভালো ফলাফল করছে।
নারী চিকিৎসক বাড়ার ইতিবাচক বিষয় কী জানতে চাইলে তিনি বলেন, চিকিৎসক সরাসরি রোগীদের দেখে সেবা প্রদান করেন, এক্ষেত্রে ইতিবাচক বিষয় হচ্ছে আমাদের দেশে এখনো ধর্মীয় বা অন্যান্য কারণে, বিশেষ করে প্রান্তিক পর্যায়ের নারীরা পুরুষ ডাক্তারের কাছে যেতে চান না, আবার পুরুষ ডাক্তারের কাছে রোগের সব কিছু বিস্তারিত বলতেও স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন না, নারী চিকিৎসক বাড়লে এসব সমস্যার সমাধান হবে বলেই আশা করি।
আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন চিকিৎসাবিজ্ঞানী বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব হেলথ সায়েন্সের (বিইউএইচএস) সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ডা. লিয়াকত আলী বলেন, আজ থেকে ৩০/৪০ বছর আগে মেডিক্যালে ছেলেদের মেয়ের অনুপাত আনুমানিক এক তৃতীয়াংশ ছিল, এখন সেটা উলটো হয়ে গেছে। এর সঙ্গে নারীর ক্ষমতায়ন এবং নারীর অগ্রগতির বিষয়টিও জড়িত। পড়াশোনার ক্ষেত্রে মেয়েরা অনেক এগিয়ে গেছে।
তিনি আরও বলেন, মেয়েরা চিকিৎসা পেশায় আসার ইতিবাচক দিক যেমন রয়েছে, তেমনি নেগেটিভ কিছু বিষয়ও আছে, সেটা রীতিমত আতঙ্কজনক। মেয়েরা চিকিৎসা পেশায় আসছে, আমি তাদের ভীষণভাবে অভিনন্দন জানাই, কিন্তু যেটা ঘটছে বেশ কিছু ক্ষেত্রে পাস করার পর কেউ কেউ চাকরিও করছেন না, প্র্যাকটিসও করছেন না, এই সংখ্যা কিন্তু কম না। আবার উপজেলা লেভেলে বা অন্য কোনো শহরে মেয়ে চিকিৎসকদের পোস্টিং দেওয়া বা পাঠানো খুবই কঠিন হয়ে যায়। সাংঘাতিক রকমের তদবির হয়। এর সঙ্গে হয়তো উপজেলা পর্যায়ে তাদের সামাজিক নিরাপত্তার বিষয়টিও থাকতে পারে। সেক্ষেত্রে তাদের নিরাপত্তা ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধির চেয়ে কীভাবে বদলি হয়ে আসা যায় সেটাই মুখ্য বিষয় হয়ে যায়। মেয়ে চিকিৎসক বাড়ুক এটা অত্যন্ত সুখবর, পাশাপাশি সমস্যাগুলো সমাধানেরও উদ্যোগ প্রয়োজন।
যা বলছেন স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রী
বর্তমান সরকারের স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রালয়ের প্রতিমন্ত্রী হিসেবে সদ্য যোগদান করেছেন ডা. রোকেয়া সুলতানা। তিনি রংপুর মেডিক্যাল কলেজের প্রথম ব্যাচের শিক্ষার্থী ছিলেন। তার সময়ে মেডিক্যালে মেয়ে শিক্ষার্থীদের অনুপাত কেমন ছিল জানতে চাইলে তিনি বাংলানিউজকে বলেন, আমাদের সময় ১৫ থেকে ২০ শতাংশ মেয়ে শিক্ষার্থী ছিল, যা এখন প্রায় ৬০ থেকে ৭০ শতাংশে পৌঁছেছে।
চিকিৎসা পেশায় নারীর অংশগ্রহণ বাড়লে সুবিধা কী, জানতে চাইলে তিনি বলেন, গ্রামের মেয়ে বা অন্য মেয়েরাও মেয়ে চিকিৎসকদের কাছেই যেতে বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। এক্ষেত্রে সুবিধা হবে। আবার মেডিক্যালের কিছু বিষয় যেমন নিউরো সার্জারি, অর্থোপেডিক সার্জারি, কার্ডিয়াক সার্জারিতে মেয়েরা কম পড়াশোনা করে। এসব বিষয়ে মেয়েদের অনুপাত অনেক কম। আমি এবং আমাদের মন্ত্রী চিন্তা করছি, কিছু সুযোগ-সুবিধা দিয়ে, ছুটি বা বয়স বাড়িয়ে দিয়ে আমরা এসব বিষয়ে মেয়েদের অংশগ্রহণ বাড়াতে পারি কি না।
স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ প্রতিমন্ত্রী বলেন, উপজেলা পর্যায়ে নারী চিকিৎসক যেতে বা থাকতে চান না, তারা নিজেদের ইনসিকিউরড (অনিরাপদ) মনে করেন। অনেকের আবার প্রকৌশলী বা অন্যান্য পেশার চাকরিজীবী ছেলেদের সঙ্গে বিয়ে হয়ে যায়। এক্ষেত্রে কিছু অসুবিধা হবে, তবে কাউকে সরকারি চাকরি করতে হলে তো, থাকতেই হবে। তাদের সিকিউরিটির বিষয়ে রাজনৈতিক পর্যায়ে, প্রশাসনিক বিভাগে আমরা কথা বলেছি, ভবিষ্যতে আরও বলবো যেন কোনো সমস্যা না হয়।
তিনি আরও বলেন, আগে ডাক্তার মেয়েরা ডাক্তার ছেলেকেই বিয়ে করতো, এক জায়গায় পোস্টিং হতো, কিন্তু এখন তো আর সেটা পারবে না। আর মেয়েরা সারাজীবন তো সেখানে থাকবে না, এখন দুই বছর থাকার বাধ্যকতা আছে। পোস্ট গ্রাজুয়েশন করলেও বাধ্যতামূলক দুই বছর রাখার চিন্তা করছি। এখনো নিয়ম করিনি, তবে চিন্তাভাবনা করছি। আবার উপজেলা পর্যায়ে মেয়ে চিকিৎসকদের বাচ্চাদের পড়াশোনা করার মত স্কুলেরও যথেষ্ট অভাব আছে, এক্ষেত্রে চিকিৎসা সেবার আমরা যেমন বিকেন্দ্রীকরণ করছি, তেমনি শিক্ষা ব্যবস্থার বিকেন্দ্রীকরণ হলে এ সমস্যার কিছুটা হলেও সমাধান হবে।