এক সময়ের অবহেলিত হালদা নদী এখন কঠোর নিরাপত্তার চাদরে ঢাকা। প্রায় প্রতিদিনই হালদা নদী রক্ষায় চলছে অভিযান। ইতোমধ্যে এ নদীকে বঙ্গবন্ধু হেরিটেজ ঘোষণা করায় নতুন মাত্রা যুক্ত হয়েছে। বেড়েছে এ নদীর গুরুত্ব। দেশের ৭৬১টি নদীর মধ্যে হালদাই একমাত্র নদী যেখানে রুই জাতীয় মাছের নিষিক্ত ডিম সংগ্রহ করা হয়। ১৯৪৫ সালে সালে এ নদীর রেনু পোনার পরিমাণ ছিল ৫ হাজার কেজি। ২০০৪ সালে এসে এ মাছের ডিমের পরিমাণ কমতে কমতে ২০ কেজিতে চলে আসে।
পরে সরকারের নানান কার্যকরী উদ্যোগে রেনু পোনার পরিমাণ বৃদ্ধি পেতে থাকে। সর্বশেষ ২০২০ সালে রেকর্ড পরিমাণ ২৫ হাজার ৫৩৬ কেজি মাছের ডিম সংগ্রহ করা হয়।
এ নদীকে আরও বেশি সুরক্ষিত ও এর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে আটটি পয়েন্টে স্থাপন করা হয়েছে আটটি সিসি টিভি ক্যামেরা। জানুয়ারিতে শুরু হওয়া এই প্রকল্পটি শেষ হয়েছে মার্চে।
এতে প্রায় ৪ লাখ ৬৫ হাজার টাকা খরচ হয়েছে বলে জানান সদরঘাট নৌ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) এবিএম মিজানুর রহমান।
তিনি বলেন, রামদাস মুন্সীহাটে অস্থায়ীভাবে ক্যাম্প নির্মাণ করা হয়েছে। সেই ক্যাম্পটাকে কেন্দ্র করে যেসব জায়গা বিপদজনক, হালদাকে ক্ষতিগ্রস্ত করা হয়, মাছ বেশি ডিম ছাড়ে সেরকম দেড়-দুই কিলোমিটার জুড়ে ৮টি হাই পাওয়ারফুল ক্যামেরা লাগানো হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, দুই কিলোমিটার বিস্তৃত এসব ক্যামেরা পাঁচ কিলোমিটার জায়গা কাভারেজ দিচ্ছে। এগুলো ৩৬০ ডিগ্রি এংগেলে ঘোরানো যাবে। মোবাইল থেকেও মনিটরিং করা যাবে।
এই ক্যামেরা দিয়ে ফেস ডিটেকশন পর্যন্ত নিয়ে আসা যায়। এছাড়াও কর্ণফুলী এবং হালদা নদীর মোহনা ও মদুনাঘাট ব্রিজের কাছেও ক্যামেরা লাগানোর প্রস্তাব রয়েছে। পরবর্তীতে সেখানেও লাগানো হবে। এসব সিসি ক্যামেরা ঢাকা, চট্টগ্রামসহ বিভিন্নস্থান থেকে একাধিক ডিভাইস দ্বারা মনিটরিং করা হচ্ছে। ’
এছাড়া সম্প্রতি সদরঘাট নৌ থানার আওতায় হাটহাজারী উপজেলার রাম দাশ মুন্সির হাটে স্থাপন করা হয়েছে অস্থায়ী নৌ-পুলিশ ক্যাম্প। সিসি ক্যামেরায় অসঙ্গতি দেখা দিলেই ছুঁটে যাচ্ছেন নৌ-পুলিশ ক্যাম্পের সদস্যরা।
এদিকে গত বৃহস্পতিবার সিসি ক্যামেরা দেখে অভিযানে গিয়ে বিভিন্ন পয়েন্ট থেকে ৭ হাজার মিটার অবৈধ ঘের জাল জব্দ করা হয়েছে।
হাটহাজারী উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) রুহুল আমিন বলেন, নাজিরহাট-কালুরঘাট পর্যন্ত প্রায় চল্লিশ কিলোমিটারের অভয়াশ্রম। রামদাস মুন্সীর ঘাট এলাকাতে ফাঁড়ি আছে। পুলিশ সেখানে সিসি ক্যামেরা লাগিয়েছে।
তিনি বলেন, একটা ভালো উদ্যোগ নিয়েছে। আমাদের প্রত্যাশা থাকবে পুলিশ শতভাগ এই উদ্যোগটা কাজে লাগাবে। অন্তত এই ছয় কিলোমিটার এলাকায় কেউ অপরাধ করতে পারবে না। তবে এই উদ্যোগটা সততার সাথে শতভাগ কাজে লাগাতে হবে।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ও হালদা রিভার রিসার্চ ল্যাবরেটরির সমন্বয়ক ড. মুহম্মদ মনজুরুল কিবরিয়া বলেন, দেশের সব নদী থেকে হালদা নদীর জৈববৈচিত্র আলাদা। তবে গোপনে জাল ফেলে মাছ ধরা, ডলফিন হত্যা করা বা বালু তোলার মতো ঘটনারও ঘটে আসছে। বিভিন্ন সময় পুলিশের সহায়তায় জাল ও ট্রলার আটক করা হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, এখন আমাদের ৪০ জন স্বেচ্ছাসেবী হালদা নদীর মা মাছ পাহারা বা সুরক্ষায় কাজ করছে। কিন্তু এত বড় একটি নদীকে এত কম মানুষ দিয়ে পাহারা দেয়া সম্ভব না। এই জন্য আমরা অনেকদিন ধরেই সিসি ক্যামেরা বসানোর কথা বলে আসছিলাম।
এই ক্যামেরাগুলো বসানোর ফলে কয়েকটা সুবিধা পাওয়া যাবে। যেকোনো স্থান থেকে নদী নজরদারি করা যাবে, রাতেও নদীতে কেউ জাল বসাচ্ছে কিনা, বালি উত্তোলন বা ডলফিন হত্যা করছে কিনা, অবৈধ কিছু করা হচ্ছে কিনা, সেটা বোঝা যাবে। সেই সঙ্গে যারা অবৈধ মাছ ধরে বা বালু তোলে, তাদের মধ্যেও একটা ভীতির তৈরি হবে।
নদীর প্রজনন ক্ষেত্রের অন্তত ১৫ কিলোমিটার এলাকা সিসি টিভির আওতায় আনতে হবে। নৌ পুলিশের পাশাপাশি একটি বেসরকারি সংস্থাও বাকি এলাকায় ক্যামেরা বসানোর উদ্যোগ নিয়েছে বলে তিনি জানান।