নানা পদক্ষেপ নেওয়ার পরেও হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে মশার উপদ্রব কমেনি। সন্ধ্যার অন্ধকারের সঙ্গেই যেনও যুক্ত হয় মশার আতঙ্ক। যাত্রীসহ বিমানবন্দরে আসা হাজার হাজার মানুষ পড়েন মশার বিড়ম্বনায়। মশা নিয়ে বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ ও ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন একে ওপরের দোষারোপ করলেও ইতোমধ্যে নেওয়া হয়েছে বেশ কিছু পদক্ষেপ। এতে টার্মিনালের ভেতরে মশার উপদ্রব নিয়ন্ত্রণে আসলেও, টার্মিনালের বাইরের মশারা আছে বহাল তবিয়তে। এই ভোগান্তিতে সবচেয়ে বেশি আছেন বিমানবন্দরের বে- এরিয়ায় কর্মরত বিমানবন্দরের বিভিন্ন সংস্থার কর্মীরা।
বৃহস্পতিবার (১১ মার্চ) সন্ধ্যায় সরেজমিনে বিমানবন্দর এলাকায় ঘুরে এই চিত্র দেখা গেছে। সন্ধ্যা সোয়া ৬টায় বিমানবন্দরের ২ নম্বর টার্মিনালে গিয়ে দেখা গেলো অপেক্ষারত যাত্রীর স্বজনরা হাত পা নাড়ছেন মশার উৎপাতে। অন্য দিকে টার্মিনালের দ্বিতীয় তলায় বিদেশগামী যাত্রীদেরও টার্মিনালে প্রবেশের আগে সহ্য করতে হচ্ছে মশার কামড়।
প্রবাসী ভাইকে নিতে নোয়াখালি থেকে এসেছিলেন আমজাদ হোসেন, সঙ্গে তার দুই শিশু সন্তান। গামছা নাড়ছেন অনবরত শিশুদের মশার উৎপাত থেকে রক্ষা করতে।
১
মশার উৎপাতে অতিষ্ঠ আমজাদ হোসেন বলেন, ‘দেশে মশা আছে সব জায়গায়ই; কিন্তু বিমানবন্দরেও এত মশা! এখানে মশা মারতে ভালো ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।’
বিমানবন্দরে কর্মরতরা বলছেন, নভেম্বর থেকে বিমানবন্দরে মশার উৎপাত বাড়ে, শীতকালে মশার উপদ্রব থাকে সবচেয়ে বেশি। এই সময়ে দিনের বেলায়ও মশার কামড় সহ্য করতে হয়। শীত কমতে থাকলে মশার উপদ্রবও কমে। বর্ষার মৌসুমে সহনীয় হয় মশার উৎপাত।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিমানবন্দরে কর্মরত একটি এয়ারলাইন্সের কর্মকর্তা বলেন, এখন মশার ওষুধ দিচ্ছে নিয়মিত, এটা ঠিক। তবে সন্ধ্যায় একবার ফগার মেশিন দিয়ে ওষুধ দেওয়া হয়, এটা রাতে কয়েকবার হলে বিমানবন্দরে আগত যাত্রী ও বিমানবন্দরের সকল কর্মীদের জন্যই ভালো হয়। ওষুধে যেমন কাজ হচ্ছে, তেমনি ফেব্রুয়ারির পর থেকে এমনিতেই এই এলাকায় মশার উপদ্রব কমে যায়। সামগ্রিকভাবে মশার উপদ্রব আগের চেয়ে কমেছে।
বিমানবন্দরে গ্রাউন্ড হ্যান্ডিলিংয়ে কর্মীরা বলছেন, বিমানবন্দরের এপ্রোন এলাকায় মশার উৎপাত এখনও অসহনীয়। রাতের বেলায় ডিউটি করা দুরূহ হয়ে পড়ে। এপ্রোন এলাকায় উড়োজাহাজ থাকায়, যেখানে সেখানে মশার কয়েলও জালানো সম্ভব হয় না। ফলে মশার কামড় সহ্য করেই কাজ করতে হচ্ছে।
বরাবরই মশা নিবরাণ নিয়ে একে ওপরকে দোষারপ করে আসছে বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ ও ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি)। বিমানবন্দরের বাইরের এলাকা থেকে মশা আসছে এমন অভিযোগ তুলে ডিএনসিসি-কে দুষছে বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ। অন্যদিকে বিমাননবন্দরে পরিচ্ছন্নতার অভাব, মশার প্রজনন ক্ষেত্র আছে বলে অভিযোগ ডিএনসিসির।
এর প্রেক্ষিত্রে চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে মশার উৎপাত নিয়ন্ত্রণে ৭ সদস্যের কমিটি গঠন করে বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়। কমিটিতে বিমান মন্ত্রণালয়, বিমানবন্দর, সিটি করপোরেশন, স্বাস্থ্য অধিদফতর, বেবিচকের প্রতিনিধি অন্তভূক্ত করা হয়। বৈঠকে সিটি করপোরেশন, সিডিসি ও বেবিচকের সমন্বয়ে বিমানবন্দরের ভেতরে ও বাইরে তিন মাইলের মধ্যে পরিচ্ছন্নতা, মশা নিধনে সমন্বিত উদ্যোগ নিতে বলা হয়। পরবর্তীতে ২৩ ফেব্রুয়ারি ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) পক্ষ থেকে একটি ‘ভেহিকল মাউনটেড ফগার মেশিন’ শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষের কাছে হস্তান্তর করা হয়।
সরেজমিনে দেখা গেছে, অ্যাভিয়েশন কিউরিটির (অ্যাভসেক) একটি ফগার মেশিন পিক-আপ গাড়িতে স্থাপন করা হয়েছে। সন্ধ্যার পর একবার বিমানবন্দর এলাকায় কীটনাশক প্রয়োগ করা হয়। এছাড়া বিমানবন্দরের প্রবেশের গেটগুলোতে মশার কয়েল জ্বলানো হয়। টার্মিনালের ভেতরে ও বাহিরে কীটনাশকও ছেটানো হয়।
ডিএনসিসি প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. জোবায়দুর রহমান বলেন, ‘আমরা প্রায় ১১ লাখ টাকা দামের ভেহিকল মাউনটেড ফগার মেশিন শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষকে ক্রুসহ দিয়েছি। ফলে অল্প সময়ে বিমানবন্দরে পুরো এলাকায় ওষুধ ছেটানো সম্ভব হচ্ছে। এছাড়া, আমরা তাদের মশার উৎপত্তিস্থলগুলো চিহ্নিত করে দিয়েছি। বিমানবন্দরের ঝোপ পরিষ্কার করতে জনবল দিয়েও সহায়তা করেছি। ফলে সামগ্রিকভাবে মশার উপদ্রব কমছে। তবে বিমানবন্দরে ভেতর ও বাহিরের জলাশয়গুলো সব সময় পরিষ্কার রাখতে হবে, না হলে মশার বংশবৃদ্ধি হবে, উপদ্রব ছড়িয়ে পড়বে।’
হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের পরিচালক গ্রুপ ক্যাপ্টেন এএইচএম তৌহিদ-উল আহসান বলেন, ‘মশা নিধনে ক্র্যাশ প্রোগ্রাম নিয়েছি। জলাশয়, বিমানবন্দরের বিভিন্ন স্থান পরিষ্কার করা হচ্ছে নিয়মিত। কীটনাশক ছিটানো হয় নিয়মিত। ফলে মশার উপদ্রব কমেছে। গত মাসে সিডিসি একটি সার্ভে করে, যেখানে দেখা যায় বিমানবন্দর এলাকায় কোথাও মাশার লার্ভা পাওয়া যায়নি। এখন মশার উপদ্রব সহনশীল আছে।
তৌহিদ-উল আহসান বলেন, ‘মশা ৩ থেকে ৫ কিলোমিটার পর্যন্ত উড়ে যেত পারে। ফলে বিমানবন্দরের আশপাশের এলাক থেকেও মশা উড়ে আসতে পারে। এজন্য পদক্ষেপ নিতে আমরা সিটি করপোরেশনকে জানিয়েছি। শুধু বিমানবন্দর না, বিমানবন্দরেরর আশেপাশের এলাকা মশামুক্ত না হলে বিমানবন্দরকে পুরোপুরি মশামুক্ত করা সম্ভব না। বিমানবন্দরকে একেবারে মশামুক্ত করতে হলে বিমানবন্দরের আশেপাশের ৪ থেকে ৫ কিলোমিটার এলাকাও মশা মুক্ত করতে হবে। না হলে শুধু বিমানবন্দরে ব্যবস্থা নিয়ে মশামুক্ত করা সম্ভব হবে না।’