ঢাকা, বৃহস্পতিবার ২১ই নভেম্বর ২০২৪ , বাংলা - 

গোলকধাঁধায় ডা. সাবিরা হত্যাকাণ্ড

ষ্টাফ রিপোটার।।ঢাকাপ্রেস২৪.কম

2024-01-26, 12.00 AM
গোলকধাঁধায় ডা. সাবিরা হত্যাকাণ্ড

রাজধানীর কলাবাগানে চিকিৎসক ডা. কাজী সাবিরা রহমান লিপি (৪৭) হত্যাকাণ্ডের পেরিয়েছে পৌনে তিন বছর। এখনো উদ্ঘাটন হয়নি আলোচিত এ হত্যাকাণ্ডের রহস্য। নিজ শয়নকক্ষে তাকে ছুরিকাঘাত ও জবাই করে হত্যা করা হয়। খুনের বিষয়টি নিশ্চিত হলেও হত্যাকাণ্ডের কারণ কিংবা হত্যাকারীর বিষয়ে কোনো কূলকিনারা করতে পারেনি পুলিশ। মামলার তদন্তভার পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) ওপর পড়লে সংস্থাটিও রয়েছে গোলকধাঁধায়। দেশজুড়ে আলোচিত ও চাঞ্চল্যকর এ মামলার তদন্তভার পাওয়ার পর থেকে সন্দেহভাজন, প্রত্যক্ষদর্শী, সহকর্মী ও স্বজনসহ অর্ধশতাধিক লোককে দফায় দফায় জিজ্ঞাসাবাদ করেও মেলেনি কোনো ক্লু। জিজ্ঞাসাবাদ শেষে তাদের সবাইকে ছেড়ে দেওয়া হয়। ডা. সাবিরার দ্বিতীয় স্বামী সাবেক ব্যাংক কর্মকর্তা এ কে সামছুদ্দিন আজাদকে গ্রেফতার করেও এ হত্যাকাণ্ডের রহস্য উদ্ঘাটন করা যায়নি। সামছুদ্দিন আজাদ বর্তমানে জামিনে আছেন।তদন্ত সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র বলছে, ডা. সাবিরা হত্যায় তার স্বামী সামছুদ্দিন আজাদের জড়িত থাকার বিষয়ে তথ্য-উপাত্ত পাওয়া যায়। তবে রিমান্ডে তিনি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের উত্তর এড়িয়ে যান। জমে থাকা দীর্ঘ ক্ষোভের কারণে ডা. সাবিরাকে হত্যা করা হয়ে থাকতে পারে।পিবিআই বলছে, ঘটনাটি ক্লুলেস ও জটিল। পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে তদন্ত চলছে। তদন্তে নির্দোষ কাউকে আইনের আওতায় আনা হবে না। যে বা যারা জড়িত তাদেরই শুধু আসামি করা হবে।২০২১ সালের ৩০ মে রাজধানীর কলাবাগানের ফার্স্ট লেনের ৫০/১ হোল্ডিংয়ের বাড়ির তৃতীয় তলার একটি ফ্ল্যাট থেকে গ্রিন লাইফ হাসপাতালের চিকিৎসক কাজী সাবিরা রহমানের মরদেহ উদ্ধার করা হয়। চাঞ্চল্যকর এ মামলাটি কাগজে-কলমে থানা পুলিশ তদন্ত করলেও রহস্য উদ্ঘাটনে ডিবিসহ অন্য সংস্থাও ছায়া তদন্ত শুরু করে। পরে ২০২১ সালের ২২ আগস্ট তদন্তভার পায় পিবিআই। বর্তমানে মামলাটির তদন্ত করছে পিবিআইয়ের ঢাকা মেট্রো উত্তর বিভাগ। অনেক দূর এগোলেও এখনো তারা পৌঁছাতে পারেনি কোনো সমাধানে।

 

চিকিৎসক সাবিরা হত্যায় পারিবারিক দ্বন্দ্ব, আলাদা বাসাভাড়া নেওয়া, স্বামীর আগের দুই বিয়ের তথ্য গোপন এবং খুনের রাতে ফেসবুক মেসেঞ্জারে কথাকাটাকাটিসহ বেশকিছু তথ্য পায় পিবিআই।জিজ্ঞাসাবাদে স্বামী সামছুদ্দিন আজাদ বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য গোপন করেন। তিনি সাবিরাকে বিয়ে করার আগে আরও দুটি বিয়ে করেছিলেন। প্রথম ঘরে এক মেয়ে এবং দ্বিতীয় ঘরেও এক মেয়ে আছে তার। সবশেষ সাবিরার ঘরেও তার এক মেয়ে রয়েছে। তবে সাবিরার কাছে প্রথম বিয়ের কথা তিনি গোপন করেছিলেন। এ নিয়ে দুজনের মধ্যে বিরোধ তৈরি হয়েছিল বলে একটি সূত্রে জানা যায়।

 

হত্যাকাণ্ডের আগের রাতে চিকিৎসক সাবিরার সঙ্গে মেসেঞ্জারে দীর্ঘ ২৮ মিনিট কথা হয় সামছুদ্দিন আজাদের। ওই কথোপকথনে তিনি চিৎকার-চেঁচামেচি করেন। খুনের দিন সকালে তিনি ফজরের নামাজের জন্য ওঠার পর তার মোবাইলে ইনকামিং ও আউটগোয়িং কল বন্ধ পাওয়া যায়। অর্থাৎ, ওই সময় তার মোবাইল বন্ধ ছিল। গাড়িচালক কখনই তার বাসায় রাতে থাকতেন না। খুনের রাতে সাবিরার স্বামীর মালিবাগের নিজ বাসায় ছিলেন চালক। সবমিলে সন্দিগ্ধ আসামির তালিকায় শীর্ষে আছেন স্বামী এ কে সামছুদ্দিন আজাদ।সাবিরার স্বামী আজাদের তিন পাতার একটি নোট উদ্ধার করেছে পিবিআই। নোটের বিষয়ে জানা যায়, বিয়ের কারণে নিজে খুবই জুলুমের শিকার হয়েছেন স্বামী সামছুদ্দিন আজাদ। তার আগের দুই ঘরের দুই মেয়ের সঙ্গে করা হতো বিরূপ আচরণ। চিকিৎসক সাবিরা প্রায়ই বিয়ে নিয়ে নিজের হতাশা এবং অন্য কাউকে বিয়ে করলে ভালো হতো বলতেন।ডা. সাবিরা কন্ট্রাক্ট ম্যারেজ বা লিভ টুগেদারে বিশ্বাসী ছিলেন উল্লেখ করে ডায়েরিতে আজাদ লেখেন, স্বার্থপরতা ও আত্মকেন্দ্রিক ভাবনায় নিমগ্ন ছিলেন সাবিরা। সংসার নয় টাকাই ছিল মুখ্য। বিয়ের নামে সাইনবোর্ড, বিয়ের নামে মূলত আর্থিক ডিলিংস করেছেন সাবিরা। পারিবারিক শিক্ষা ও জ্ঞানের অপপ্রয়োগ এবং সাংসারিক দায়িত্বহীনতা, মানবিক মূল্যবোধের অভাব ছিল তার।

 

চিকিৎসক সাবিরাকে মানসিক বিকারগ্রস্ত ও উন্মাদ বলেও মনে করতেন স্বামী আজাদ। নোটের শেষাংশে ‘আল্লাহর কাছে বিচার পাবেন’ বলে উল্লেখ করেন সামছুদ্দিন আজাদ।২০০৬ সালে সামছুদ্দিন আজাদের সঙ্গে সাবিরার বিয়ে হয়। পরের বছর এক মেয়ে হয় তাদের। এর আগে চট্টগ্রামের একটি মেডিকেল কলেজে পড়ার সময় ১৯৯৮ সালে উবাইদ উল্লাহ নামে এক চিকিৎসকের সঙ্গে সাবিরার বিয়ে হয়েছিল। ১৯৯৯ সালে সেই ঘরে এক ছেলের জন্ম হয়। ২০০৩ সালে সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যান উবাইদ উল্লাহ।পিবিআই সূত্র জানায়, নানা তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে ডা. সাবিরার স্বামী সামছুদ্দিন আজাদকে ২০২২ সালের ১৯ এপ্রিল এ মামলায় সন্দেহভাজন হিসেবে গ্রেফতার করা হয়। পরদিন আদালতে হাজির করে রিমান্ড চাইলে আদালত তিনদিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। এরপর ২১ থেকে ২৩ এপ্রিল তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। তিনি অসুস্থ হওয়ায় জিজ্ঞাসাবাদ করা হয় আদালতের অনুমতিসাপেক্ষে একজন চিকিৎসকের উপস্থিতিতে।

 

তদন্ত সংশ্নিষ্টরা জানান, জমে থাকা দীর্ঘ ক্ষোভের বলি হয়েছেন ডা. সাবিরা। এতটাই চতুরতার সঙ্গে খুন করা হয়েছে, ঘাতকরা কোনো চিহ্ন রাখেনি। যে কারণে একটু সময় লাগছে। গত দুই বছরের মধ্যে বাড়ির তত্ত্বাবধায়ক, গৃহকর্মী, ভাড়াটিয়া ও পাশের কক্ষের বাসিন্দাসহ সাবিরার সহকর্মী এবং স্বজনসহ প্রায় অর্ধশতাধিক ব্যক্তিকে দফায় দফায় জিজ্ঞাসাবাদ করেছেন তদন্ত সংশ্লিষ্টরা। তবে ঘনিষ্ঠজনদের কেউ এ হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছেন বলেই সন্দেহ রয়েছে। সন্দেহের এ তালিকার পুরোভাগে রয়েছেন ডা. সাবিরার স্বামী সাবেক ব্যাংক কর্মকর্তা এ কে সামছুদ্দিন আজাদ।

 

মামলাটির তদন্তকারী কর্মকর্তা পিবিআই পরিদর্শক মো. জুয়েল মিঞা  বলেন, ‘হত্যাকাণ্ডের প্রকৃত কারণ এখনো বের করা যায়নি, তদন্ত চলমান। ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ থেকে হত্যাকাণ্ড ঘটেছে বলে মনে করা হচ্ছে। বাড়ির কেয়ারটেকার বেশির ভাগ সময় ভবনের বাসিন্দাদের দরকারি কেনাকাটা করতে দোকানে যেতেন। আর এ অবস্থায় বাড়ির প্রধান ফটক থাকতো অরক্ষিত অবস্থায়।’

 

‘এ সুযোগ কাজে লাগিয়েছে খুনি বা খুনিরা। সাবিরার স্বামী এ কে সামছুদ্দিন আজাদকে গ্রেফতার করা হয়েছিল। তাকে রিমান্ডেও নেওয়া হয়। তার কাছ থেকে তেমন কিছু পাওয়া যায়নি। তবে তাকে সন্দেহ করার অনেকগুলো কারণ রয়েছে। সাবিরার সঙ্গে স্বামীর সম্পর্ক স্বাভাবিক ছিল না। সাবিরার ভাড়া বাসায় স্বামী কয়েকবার গিয়েছিলেন, সেটা তার মোবাইলের কললিস্ট পর্যালোচনা করে জানা গেছে।’জানতে চাইলে পিবিআই ঢাকা মেট্রো (উত্তর) বিশেষ পুলিশ সুপার মো. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ‘সাবিরার স্বামী বা অন্য কেউ খুন করেছেন, দুটোই হতে পারে। সরাসরি এ হত্যাকাণ্ডে জড়িত কে বা কারা, তা স্পষ্ট না হলেও বেশকিছু তথ্যের ভিত্তিতে স্বামী আজাদকে সন্দেহের তালিকায় শীর্ষে রাখা হয়েছে। পাশাপাশি আরও কয়েকজন রয়েছেন। যাদের নাম এখনই প্রকাশ করছি না। তদন্ত নিয়ে অনেক গোলকধাঁধা থাকলেও যারা জড়িত তাদের শনাক্ত করে আইনের আওতায় আনতে তদন্ত চলমান।’