পত্রিকার জন্ম বাংলায় ২০০ বছরের বেশি হবে। তবে সেই ইতিহাসের প্রায় ৫০ বছর পর শুধু নারীদের জন্য প্রাকশিত হতে লাগল বামাবোধিনী পত্রিকা। এটি এখনকার সময়ের ম্যাগাজিন কিংবা নারীদের ফ্যাশন নিয়ে ছোট্ট আর্টিকেলের কথা বলছি না। সময়টা আজ থেকে প্রায় দেড়শ বছর কিংবা তারও কিছু আগে থেকে হবে। যেসময় নারীর স্বাধীনতা বলে তেমন কিছুই ছিল না। শুধু সংসারের চার দেয়াল যাদের জগত ছিল। স্বামীর মন জুগিয়ে চলা আর সন্তানের দেখভাল করা ছাড়া তেমন কোনো কাজের জন্য নারীদের প্রাধান্য দেয়া হত না।
সেই সময়ের কথাই বলছি, ১৮৬৩ খ্রিস্টাব্দে বা ১২৭০ বঙ্গাব্দের কথা। উনিশ শতকে নারীদের জন্য প্রথম প্রকাশিত সাময়িক পত্রিকা ছিল ‘মাসিক পত্রিকা’। প্রকাশ করেছিলেন ডিরোজিওর দুই শিষ্য প্যারীচাঁদ মিত্র এবং রাধানাথ শিকদার ১৮৫৪ খ্রিস্টাব্দে ১৬ই আগস্ট তারিখে। এরপর উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে নারীদের জন্য অনেক সাময়িক পত্রিকা হয়েছিল যেমন- ‘অবলাবান্ধব পত্রিকা’, ‘বঙ্গমহিলা’, ‘ বিনোদিনী’, ‘হিন্দুললনা’ ইত্যাদি। তবে সবচেয়ে জনপ্রিয় এবং গুরুত্বপূর্ণ ছিল ‘বামাবোধিনী পত্রিকা’।
সমাচার দর্পণকেপ্রথম বাংলা পত্রিকা হিসেবে ধরা হয়। ২০৪ বছর আগে ১৮১৮ সালের ২৩ মে এটি বের হয় শ্রীরামপুরের ব্যাপটিস্ট মিশন থেকে। বামাবোধিনী পত্রিকা প্রকাশিত হয়েছিল বামাবোধিনী সভার উদ্যোগে।বামাবোধিনী সভা কেশবচন্দ্র সেন এবং ব্রাহ্ম আদর্শ দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েছিল। ১৮৬৩ খ্রিস্টাব্দে বা ১২৭০ বঙ্গাব্দে ভাদ্রমাসে কলকাতার ১৬ নং রঘুনাথ চ্যাটুয্য স্ট্রীটের বাড়ির বামাবোধিনী সভার কার্যালয় থেকে বামাবোধিনী পত্রিকা প্রথম আত্মপ্রকাশ করেছিল। মূল্য ছিল মাত্র এক আনা। মুদ্রণ সংখ্যা ছিল এক হাজার। প্রথম গ্রাহিকা ছিলেন ভুবন মোহিনী বসু। ১৮৭৭ খ্রিঃ বামাবোধিনী সভা বন্ধ হয়ে গেলেও বামাবোধিনী পত্রিকা টিকেছিল। উমেশচন্দ্র দত্ত তার মৃত্যুর আগ পর্যন্ত চুয়াল্লিশ বছর ধরে সম্পাদনা করেন। ১৯০৭ সালে তার মৃত্যু হলেও ১৯২২ সাল পর্যন্ত আরও ষাট বছর এই পত্রিকা বের হয়েছে।
বামাবোধিনী পত্রিকার প্রথম সম্পাদক ছিলেন সাধারণ ব্রাহ্মসমাজের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা নেতা উমেশচন্দ্র দত্ত। বহু বাধাবিপত্তি স্বত্বেও তিনি হরিনাভি সহ অন্যত্র ব্রাহ্মসমাজকে জনপ্রিয় করে তুলেছিলেন। বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষকতা করার পর প্রথমে সিটি স্কুল পরে কলকাতার সিটি কলেজের অধ্যক্ষ হন। কলকাতার মানিকতলায় মূক ও বধিরদের জন্য নির্মিত বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিলেন।
বামাবোধিনী পত্রিকার সম্পাদনা ছাড়া ‘ধর্মসাধন’এবং ‘ভারত সংস্কারক’ পত্রিকা সম্পাদনা করতেন। তাছাড়া বামা-রচনাবলী এবং ‘স্ত্রী লোকদিগের বিদ্যার আবশ্যকতা’নামক পুস্তিকা রচনা করেছিলেন। উনিশ শতকে শিক্ষার উন্নতি ও নারীশিক্ষা আন্দোলনে উমেশচন্দ্র দত্তের অবদান অনস্বীকার্য। উমেশচন্দ্র দত্ত স্মরণীয় হয়ে আছেন বামাবোধিনী পত্রিকার সম্পাদনার জন্য।তিনি একাদিক্রমে চল্লিশ বছর এই পত্রিকার দায়িত্ব বহন করেছিলেন।
বামাবোধিনী পত্রিকায় বিভিন্ন বিষয় আলোচিত হতো। থাকতো ভ্রমণ বৃত্তান্ত,গল্প, উপন্যাস, কবিতা, চিত্রকলা, বিজ্ঞান, বিশ্লেষণ,বিদেশী নারী সাফল্য কাহিনী,শিক্ষা প্রসঙ্গ,স্বাস্থ্য জ্ঞান,শিশুপালন পদ্ধতি,ধর্ম আলোচনা এবং গার্হস্থ্য প্রসঙ্গ।তবে প্রধান বিষয়বস্তু ছিল তিনটি শিক্ষার প্রয়োজন ও সার্থকতা,শিশুপালন সংক্রান্ত নিয়মাবলী এবং পরিবারে রমণীর কর্তব্য ও স্থান।
পত্রিকার প্রবন্ধাবলীর সিংহভাগের লেখক ছিলেন পুরুষ। তবে কোনো অজ্ঞাত কারণে বেশিরভাগ নিজেদের নাম উল্লেখ করেননি। অবশ্য নারীরাও তখন লিখতেন এই পত্রিকায়। বামা-রচনাগুলো বামাবোধিনী পত্রিকার বিশেষ সম্পদ। জগদীশ চন্দ্র বসুর ভগিনী-দ্বয় লাবন্যপ্রভা বসু ও স্বর্ণপ্রভা বসু, কৃষ্ণভামিনী দাস ও শৈল্যবালা জায়া এবং পরবর্তী কালে মানকুমারী বসু লিখেছিলেন। তবে অধিকাংশ লেখিকা ছিলেন অনামা গৃহবধূ।
বামাবোধিনী পত্রিকা বনলতা দেবী সম্পাদিত অন্তঃপুরের মতো মৃদুভাষী বা সরযুবালা দত্ত সম্পাদিত ‘ভারত মহিলা’ এর মতো সোচ্চার না হয়ে মধ্যবর্তী অবস্থান নিয়েছিল।নারীশিক্ষা, নারী স্বাধীনতার সর্বোপরি সমাজে ও পরিবারে নারীর ভূমিকাকে তুলে ধরেছিল এবং মূল্যায়ন করেছিল। বাল্যবিবাহের আলোচনা বামাবোধিনীতে থাকলেও , যে আলোচনা বা বিলের প্রসঙ্গে সারাদেশে যে ঝড় উঠেছিল তার কোনো সংকেত ছিল না বামাবোধিনী পত্রিকায়। ১৮৬৩ খ্রিস্টাব্দে আগষ্টমাসে এই পত্রিকার প্রথম সংখ্যায় লেখা হয়েছিল-“বামাবোধিনীতে ভাষাতত্ত্ব, ভূগোল, ইতিহাস,জীবনচরিত,বিজ্ঞান,স্বাস্থ্যরক্ষা, নীতি ও ধর্ম, দেশাচার, পদ্য, গৃহঃচিকিৎসা, শিশুপালন, শিল্পকর্ম,গৃহকার্য্য ও অদ্ভূতবিবরণ প্রকাশিত হইবে”।
প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার বাইরে গিয়ে মেয়েদের শিক্ষিত করে তোলার এই উদ্যোগ - আজও অবাক করে। পত্রিকাটির একটি সংখ্যায় লেখা হয়েছিল-
"চিরদিন পরাধীন কারাবাসী-প্রায় / একেতে অবলা হায় জ্ঞানহীনা তায় / মানুষ হইয়া অন্ধ পশুমতো রয় / নারীর সমান দীন ভারতে কে হয়ৃ?এই জায়গা থেকেই বামাবোধিনী-তে বড় অংশ জুড়ে থাকত জ্ঞানবিজ্ঞান ও কুসংস্কার সম্পর্কিত আলোচনা। দীর্ঘ ষাট বছরের এমন একটি সফল উদ্যোগে জুড়ে ছিলেন সেসময়ের অনেক নারী সাহিত্যিক- রাসসুন্দরী দেবী থেকে শুরু করে জ্ঞানদানন্দিনী দেবী, সরলা দেবী, স্বর্ণকুমারী দেবী, বেগম রোকেয়া প্রমুখ। বোঝাই যায়, ব্যক্তিগত লেখালেখিকেও, নারীর নিজস্ব স্বরকে তুলে ধরতেও ত্রুটি রাখেনি বামাবোধিনী।
বামাবোধিনীর উদ্দেশ্য স্পষ্টতর রূপে প্রকাশ পেল পঞ্চাশ বছর পূর্তির সময়ে। সেই সময়ে পত্রিকায় পরিষ্কার করে বলা হয় “বঙ্গরমণীগনকে সর্ব্বপ্রকার জ্ঞানে বিভূষিত করা বামাবোধিনীর উদ্দেশ্য,এইজন্য সর্ব্বপ্রকার জ্ঞানগর্ভ প্রস্তাবই ইহাতে সন্নিবেশিত হইয়াছে। জ্ঞান প্রচার বামাবোধিনীর প্রধান উদ্দেশ্য হইলেও এই জ্ঞান যাহাতে ধর্ম্মভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত হইয়া নারীজীবনের যথার্থ শোভা সম্পাদন ও কল্যানবিধান করে, বামাবোধিনীর ইহা প্রাণগত ইচ্ছা। এই জন্য পাঠক পাঠিকার মনে ধর্ম্মভাব উদ্দীপন ও সংরক্ষণের জন্য ইহা প্রথম হইতেই প্রয়াস পাইয়াছেন”। বামাবোধিনী পত্রিকা সমকালীন বাংলা নারীদের অবস্থা সম্পর্কে জানবার এক গুরুত্বপূর্ণ দলিল ছিল।