কার ভাগ্যের চাকা কখন ঘুরবে কেউ জানে না। সময়ের ফেরে কেউ কোটিপতি থেকে দেউলিয়া হয়ে গিয়েছেন। আবার দেখা গিয়েছে, অভাব আর অনটন যাঁর নিত্যসঙ্গী ছিল, তিনি কোটিপতি হয়েছেন। তেমনই এক জলজ্যান্ত উদাহরণ রমেশ বাবু।আপনি হয়তো স্বপ্নেও ভাবতে পারবেন না তিন কোটি টাকার রোলস রয়েসে চড়ে অফিসে আসবেন। কিন্তু রমেশ বাবু পারেন। তিনি পারেন রোলস রয়েসে চেপে সেলুনে যেতে। ভাবছেন তো, এই রমেশ বাবু কে? ভারতের কোটিপতি নাপিত।বেঙ্গালুরুর বাসিন্দা রমেশ বাবু। একেবারে নিম্নবিত্ত পরিবার থেকে উঠে এসেছেন তিনি। রমেশের বাবার সেলুন ছিল। সেই সেলুন চালিয়ে সামান্য যা আয় হত, তা দিয়েই সংসার চলত। তখন রমেশ বাবু খুব ছোট। সাল ১৯৮৯। রমেশ বাবুর বয়স তখন সাত বছর। হঠাৎই তাঁর বাবা পি গোপাল মারা যান। গোটা সংসাদের দায়িত্ব এসে পড়ে রমেশের ছোট কাঁধে।প্রথমে সংসার চালাতে সংবাদপত্র বিক্রি করা শুরু করেন রমেশ। পরে বাবার সেলুনে গিয়ে কাজ শুরু করলেন তিনি। সেই পথচলা শুরু।রমেশ বাবুর জীবনের উত্থানের কাহিনি রূপকথাকেও হার মানাবে। তবে এ শুধু কাহিনিই নয়, এর নেপথ্যে রয়েছে রমেশ বাবুর কঠোর পরিশ্রম। অনেকেই দামি গাড়ি চড়ে রমেশের সেলুনে আসতেন। ছোট্ট ছেলেটির মনে তখন থেকেই শখ জাগে নতুন নতুন গাড়ি কেনার। কিন্তু সেই শখ মেটাতে গেলে তো বিপুল টাকা দরকার! ফলে তাঁর কাছে সেটি অলীক কল্পনা ছাড়া আর কিছুই ছিল না।কিন্তু রমেশ বাবু দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিলেন, এই শখ তিনি পূরণ করবেনই। আরও পরিশ্রম করতে শুরু করেন রমেশ। স্বপ্ন যে তাঁকে পূরণ করতেই হবে।কিছু টাকা জমিয়ে ১৯৯৩ সালে কিস্তিতে একটি মারুতি ওমনি গাড়ি কেনেন রমেশ। কিন্তু সেলুন চালিয়ে সেই গাড়ির কিস্তি দিতেও নাজেহাল হতে হয়েছিল। তাঁর মা যে বাড়িতে পরিচারিকার কাজ করতেন সেই বাড়ির গৃহকর্তা রমেশকে ভাড়ায় গাড়ি চালানোর পরামর্শ দেন। আর সেই পরামর্শই তাঁর জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেয়।মারুতি ওমনি নিয়ে গাড়ির ব্যবসায় নামলেন রমেশ। কিন্তু তাঁর লক্ষ্য ছিল আরও উঁচুতে। বেঙ্গালুরুতে যে গাড়ির ব্যবসা রমরমিয়ে চলতে পারে, সেই আন্দাজ তিনি পেয়েছিলেন। তাই সেলুনের পাশাপাশি গাড়ির ব্যবসায় নিজেকে উজাড় করে দেন। মারুতি ওমনি দিয়ে পথচলা শুরু করলেও সময়ের সঙ্গে গাড়ির সংখ্যাও বৃদ্ধি করতে শুরু করেন রমেশগাড়ির ব্যবসার বহর আরও বৃদ্ধি করেন রমেশ। ধীরে ধীরে হয়ে ওঠেন উদ্যোগপতি। ব্যবসার বহর যখন আরও বৃদ্ধি পেল, রমেশ কিনে ফেললেন একটি রোলস রয়েস।পেশায় তিনি নাপিত হলেও সঙ্গে রয়েছে ট্যুরস অ্যান্ড ট্র্যাভেলসের ব্যবসা। আর এই দুই পেশাতেই বাজিমাত করেছেন রমেশ। বর্তমানে এক জন সফল উদ্যোগপতি তিনি। বেঙ্গালুরু শহরে রমেশের সংস্থাই প্রথম মার্সিডিজ় গাড়িকে ভাড়া খাটানোর কাজে লাগায়।তার পরের সময়টা যেন পুরো গল্পের মতো। একটা সময় এল, যখন রমেশের হাতে প্রচুর টাকা। এমন কোন গাড়ি নেই তাঁর গাড়িশালে রয়েছে। যত নতুন গাড়ি বেরিয়েছে, তখনই কিনেছেন তিনি। আবার সেই গাড়ি ভাড়া খাটিয়ে টাকা উপার্জন করেছেন। কোনওটার ভাড়া এক হাজার টাকা তো, কোনওটা ৫০ হাজার।বর্তমানে প্রায় ৪০০টিরও বেশি গাড়ির মালিক রমেশ। যার মধ্যে ১২০টি বিলাসবহুল গাড়ি। রমেশের সংগ্রহে রয়েছে ‘রোলস রয়েস গোস্ট’। যার বাজারদর তিন কোটি টাকা।‘ মার্সিডিজ় মেব্যাক এস৬০০’। যার দাম আড়াই কোটি টাকার বেশি। এ ছাড়াও রয়েছে ‘বিএমডব্লিউ’, ‘জাগুয়ার’, ‘ল্যান্ড রোভার’, ‘বেন্টলে’-র মতো বিলাসবহুল গাড়ি।সাধারণত ‘রোলস রয়েস’ বা ‘মার্সিডিজ’-এর মতো কোটি কোটি টাকার গাড়ির সংগ্রহের কথা উঠলেই শিল্পপতি মুকেশ অম্বানী, গৌতম আদানির বা তাবড় তাবড় ক্রীড়াবিদদের প্রসঙ্গ চলে আসে। সেই তালিকায় জায়গা করে নিয়েছেন রমেশ বাবুও।রমেশের যেখানে ৪০০টিরও বেশি গাড়ি রয়েছে, সেখানে মুকেশ অম্বানীর রয়েছে মাত্র ১৬৮টি গাড়ি। দেশের আরও এক শিল্পপতি গৌতম আদানিকেও টেক্কা দিয়েছেন রমেশ। আদানি গোষ্ঠীর মালিকের ঝুলিতে রয়েছে ১০টি বিলাসবহুল গাড়ি।রমেশের ‘ট্যুরস অ্যান্ড ট্রাভেলস’ সংস্থায় ৩০০ জনেরও বেশি কর্মী রয়েছেন। তাঁর সংস্থার গ্রাহকের তালিকাও চমকপ্রদ। অমিতাভ বচ্চন, ঐশ্বর্য রাই বচ্চন, আমির খান, সচিন তেন্ডুলকরের মতো খ্যাতনামীরা রমেশের সংস্থার গ্রাহক।গাড়ির ব্যবসায় কোটিপতি হলেও নিজের আসল কাজকে কিন্তু ভোলেননি রমেশ। গত কয়েক দশক ধরে প্রতি দিন সেলুনে আসেন। অন্তত পাঁচ ঘণ্টা সময় কাটান। গ্রাহকদের চুল কাটেন। তবে নিজের পছন্দের রোলস রয়েসে চেপেই সেলুনে আসেন রমেশ। তাঁর এই উত্থান আর পরিশ্রমের কাহিনি সকলের কাছে অনুপ্রেরণার জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত।