সরকার পতনের দাবিতে গত ২৮শে অক্টোবরের পর থেকে হরতাল-অবরোধের মতো কর্মসূচি পালন করছে বিএনপি। চলমান এই আন্দোলন নিয়ে দলীয় মূল্যায়নে কিছু জেলায় ঘাটতির চিত্র খুঁজে পেয়েছেন দলটির হাইকমান্ড। এ কারণে এসব জেলায় নতুন বার্তা দেয়া হয়েছে সামনের আন্দোলনকে ঘিরে। কোনো কোনো জেলার দায়িত্বপ্রাপ্তদের দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেয়া হয়েছে। আবার কোনো কোনো জেলায় দায়িত্বপ্রাপ্তদের সঙ্গে সহযোগী সমন্বয়ক করা হয়েছে। এসব জেলা নেতাদের সামনের দিনে আন্দোলন কর্মসূচিতে আরও জোরালো ভূমিকা রাখতে কেন্দ্র থেকে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে সম্প্রতি। দলীয় সূত্রে জানা যায়, অন্তত ২৫টি সাংগঠনিক জেলায় চলমান কর্মসূচি সেভাবে পালন হচ্ছে না। জেলা বিএনপি’র দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা নানা কারণে কর্মসূচিতে সক্রিয় নন। তাদের কেউ বিদেশে আবার কেউ রাজধানীতে অবস্থান করেন। তাদের কারও কারও নামে তেমন মামলাও নেই। সর্বশেষ গত রোববার হওয়া মানবন্ধন কর্মসূচিতেও কিছু নেতাকে দেখা যায়নি।
এ ছাড়া সাবেক এমপি ও দলের এমপি প্রার্থী এবং জেলার দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতাদের কেউ কেউ দলের কর্মীদের সঙ্গেও তেমন যোগাযোগ রাখছেন না। কেন্দ্র থেকে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তারা বলেন, কর্মসূচি পালন করলেই গ্রেপ্তার হতে হবে। এতে আন্দোলন ক্ষতিগ্রস্ত হবে। গ্রেপ্তার এড়াতেই তারা প্রকাশ্যে কর্মসূচিতে যান না। তবে কর্মীদের দিয়ে দলীয় কর্মসূচি পালন করান। অনেক জেলায় অন্তর্কোন্দলের কারণে বিভক্ত হয়ে কর্মসূচি পালন হচ্ছে। জেলায় দলের অঙ্গ-সংগঠনের নেতারা দায়সারা গোছের অলিগলিতে ঝটিকা মিছিল করছেন। দলীয় হাইকমান্ড মনে করছে ব্রাহ্মণবাড়িয়া, মুন্সীগঞ্জ, শরীয়তপুর, নরসিংদী, কুমিল্লা, চাঁদপুর, ভোলা, চুয়াডাঙ্গা, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, মেহেরপুর, সাতক্ষীরা, টাঙ্গাইল, দিনাজপুর, ঠাকুরগাঁও, সৈয়দপুর, বাগেরহাট, ঝালকাঠি, পটুয়াখালী, পাবনা, রাজশাহী, নওগাঁ, নাটোর, গোপালগঞ্জ, বরগুনা, বরিশাল উত্তর জেলার নেতারা আরও সক্রিয় ভূমিকা পালন করলে আন্দোলন ভিন্নমাত্রা পাবে। কুড়িগ্রাম, চট্টগ্রাম উত্তর, জয়পুরহাট, নেত্রকোনা, জামালপুর, ময়মনসিংহ উত্তর, রাজবাড়ী জেলায় বিভক্ত হয়ে কর্মসূচি পালন হচ্ছে। এসব জেলায় কর্মসূচি পালনে সমন্বয়ের তাগিদ দেয়া হয়েছে দলের পক্ষ থেকে।
দলীয় মূল্যায়ন: চলমান আন্দোলন কর্মসূচি পালনের ক্ষেত্রে এগিয়ে আছে সিলেট বিভাগের জেলাগুলো। সিলেট ও হবিগঞ্জে কঠোর আন্দোলন হচ্ছে। রাজপথে জোরদার আন্দোলনের কারণে হবিগঞ্জের সাবেক আহ্বায়ক জি কে গউছসহ জেলার সবগুলো অঙ্গ সংগঠনের সভাপতি-সাধারণ সম্পাদককে গ্রেপ্তার করে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। কম-বেশি হচ্ছে সুনামগঞ্জ ও মৌলভীবাজারেও। সিলেটের পর বগুড়া ও চট্টগ্রামে প্রায় প্রতিদিনই কর্মসূচি পালন করছেন জেলার নেতারা। এ ছাড়া ফেনী, লক্ষ্মীপুর, যশোর, কুষ্টিয়া, নড়াইল, নোয়াখালী, জামালপুর, ময়মনসিংহ দক্ষিণ, সিরাজগঞ্জ, গাজীপুর, গাইবান্ধা, লালমনিরহাট, মানিকগঞ্জ, মাদারীপুরসহ প্রায় অর্ধশত সাংগঠনিক জেলায় কম-বেশি আন্দোলন হচ্ছে। গাজীপুর জেলা বিএনপির সভাপতি ফজলুল হক মিলনের তত্বাবধানে নেতাকর্মীরা প্রায় প্রতিদিন মিছিল ও পিকেটিং করছে। মহানগর বিএনপির নেতাদের নির্দেশে নেতাকর্মীরা পিকেটিং অব্যাহত রেখেছে। তবে ২৫টি সাংগঠনিক জেলায় আশানুরূপ আন্দোলন হচ্ছে না। সাতক্ষীরা জেলার আহ্বায়ক ও সদস্য সচিবকে চলমান কর্মসূচি পালন করতে দেখা যায়নি। একই অবস্থা বাগেরহাট ও চুয়াডাঙ্গায়ও জেলার আহ্বায়ক ও সদস্য সচিবসহ পুরো কমিটি নিষ্ক্রিয় রয়েছে। নাটোর জেলার আহ্বায়ক, যুগ্ম আহ্বায়ক ও সদস্য সচিব এবং সব ও উপজেলা পৌরসভার নেতাদেরও কর্মসূচি পালন করতে দেখা যায়নি।
রাজশাহী জেলার পুরো আহ্বায়ক কমিটি নিষ্ক্রিয়। তবে মহানগরের আহ্বায়ক ও সদস্য সচিব মাঝে-মধ্যে কর্মসূচি পালন করেন যুবদল, ছাত্রদলের নেতাকর্মীরা বিচ্ছিন্ন কর্মসূচি পালন করে। চাঁপাইনবাবগঞ্জের আহ্বায়ক একদিনও কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করেননি। সদস্য সচিব অল্পসংখ্যক নেতাকর্মী মাঝেমধ্যে কর্মসূচি পালন করলেও পুরো কমিটি প্রায় নিষ্ক্রিয়। নওগাঁর আহ্বায়ককে চলমান কোনো কর্মসূচি পালন করতে দেখা যায়নি। এ ছাড়া ময়মনসিংহ দক্ষিণের আহ্বায়ককে কোনো কর্মসূচিতে দেখা যায়নি। পাবনা জেলার একজন যুগ্ম আহ্বায়ক ছাড়া অন্য যুগ্ম আহ্বায়কদের কেউ কর্মসূচি পালন করেন না। কিশোরগঞ্জ জেলার সভাপতি গ্রেপ্তারের পর ভারপ্রাপ্ত আহ্বায়ক সেভাবে কর্মসূচি পালন করেন না। শেরপুরের সাধারণ সম্পাদককে কোনো কর্মসূচিতে দেখা মেলেনি। টাঙ্গাইলের মির্জাপুর পৌর সভাপতিকে নিষ্ক্রিয়তার দায়ে দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেয়া হয়েছে। ঘাটাইল ছাড়া অধিকাংশ থানার নেতারা নিষ্ক্রিয়। নারায়ণগঞ্জ জেলার সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদককে চলমান কর্মসূচিতে দেখা যায়নি। মুন্সীগঞ্জের সদস্য সচিবসহ দায়িত্বশীল নেতারা কর্মসূচি পালন করেন না। বরিশাল উত্তর জেলার আহ্বায়ক ও সদস্য সচিবসহ পুরো কমিটি নিষ্ক্রিয় রয়েছে। পটুয়াখালী ও ঝালকাঠির আহ্বায়ক ও সদস্য সচিবদের কর্মসূচি পালন করতে দেখা যায়নি। চাঁদপুরের সভাপতি ও কুমিল্লা দক্ষিণের আহ্বায়ককেও চলমান কর্মসূচিতে দেখা যায়নি।
যেসব জেলায় দেয়া হয়েছে ভারপ্রাপ্ত দায়িত্ব: গত দুদিনে পাবনা জেলা বিএনপি’র সমন্বয়ক হিসেবে বিএনপি চেয়ারপাসনেরর বিশেষ সহকারী শামসুর রহমান শিমুল বিশ্বাসকে, বাগেরহাট জেলা বিএনপি’র সমন্বয়ক হিসেবে সাবেক সভাপতি আব্দুস সালামকে ও সাতক্ষীরা জেলা বিএনপির সহ-সমন্বয়ক হিসেবে জেলা বিএনপি’র যুগ্ম আহ্বায়ক ও তারিকুল হাসানকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। এ ছাড়া বরিশাল মহানগর বিএনপি’র যুগ্ম আহ্বায়ক এডভোকেট জিয়াউদ্দিন শিকদারকে ভারপ্রাপ্ত আহ্বায়ক, টাঙ্গাইল জেলা বিএনপি’র সাবেক সদস্য সচিব মাহামুদুল হক শানুকে ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক, টাঙ্গাইলের মির্জাপুরে সিনিয়র সহ-সভাপতি আলী আজম সিদ্দিকীকে ভারপ্রাপ্ত সভাপতি, ফরিদপুর জেলা বিএনপি’র যুগ্ম আহ্বায়ক এবি সিদ্দিক মিতুলকে ভারপ্রাপ্ত আহ্বায়ক ও জেলা বিএনপি’র যুগ্ম আহ্বায়ক আফজাল হোসেন খান পলাশকে ভারপ্রাপ্ত সদস্য সচিব হিসেবে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। এদিকে নভেম্বরে গাইবান্ধা জেলা বিএনপি’র সহ-সভাপতি শহীদুজ্জামান শহীদকে ভারপ্রাপ্ত সভাপতি, হবিগঞ্জ জেলা বিএনপি’র আহ্বায়ক মোহাম্মদ আবুল হাসিম বিদেশে অবস্থান করায় পরবর্তী নির্দেশ না দেয়া পর্যন্ত জেলা বিএনপি’র যুগ্ম আহ্বায়ক মোছাম্মৎ শাম্মী আক্তারকে ভারপ্রাপ্ত আহ্বায়ক, সাতক্ষীরা জেলা বিএনপি’র যুগ্ম আহ্বায়ক হাবিবুর রহমান হাবিবকে জেলা বিএনপি’র সমন্বয়কের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। এ ছাড়া দিনাজপুর জেলার সিনিয়র সহ-সভাপতি মোকাররম হোসেনকে ভারপ্রাপ্ত সভাপতি, নড়াইল জেলার যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক কাজী সুলতানুজ্জামান সেলিমকে ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক, গাইবান্ধা জেলার ১ম যুগ্ম সম্পাদক ইলিয়াস হোসেনকে ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক, রংপুর মহানগরের ১ম যুগ্ম আহ্বায়ক শহিদুল ইসলাম মিজুকে ভারপ্রাপ্ত আহ্বায়ক, সদস্য আব্দুস সালামকে ভারপ্রাপ্ত সদস্য সচিব করা হয়েছে।
এ বিষয়ে বিএনপি’র সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেন, ভয়ঙ্কর গ্রেপ্তার, জুলুম-নির্যাতন নিপীড়নের মধ্যেও বিএনপি নেতাকর্মীরা মাঠে দাঁড়াচ্ছে। দলীয় কর্মসূচি পালন করছে। কিন্তু পঁচাত্তরের ঘটনার পর আওয়ামী লীগ ছিন্নভিন্ন হয়ে গিয়েছিল। তাদের খুঁজে পাওয়া যায়নি। চলমান আন্দোলনে বিএনপি ঐকবদ্ধ রয়েছে। দুই-একজন লোভী নেতা ছাড়া বিএনপি’র কেউই একতরফা নির্বাচনে যায়নি। এটাই আমাদের এক ধরনের বিজয়।