অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে ১০ বছর কারাদণ্ডাদেশ বহাল থাকায় আওয়ামী লীগ নেতা হাজী মোহাম্মদ সেলিম সংবিধান অনুসারে এখন সংসদ সদস্য (এমপি) পদে থাকার ‘যোগ্যতা’ হারিয়েছেন বলে মনে করছেন আইনজীবীরা। তবে তারা বলছেন, রায় অনুসারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবেন স্পিকার।যেমনটি হয়েছিলো সম্প্রতি কুয়েতে দণ্ডিত হওয়ার পর সংসদ সদস্য পদ হারানো শহিদুল ইসলাম পাপুলের ক্ষেত্রে।বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে দুদকের করা মামলায় মঙ্গলবার (৯ মার্চ) বিচারপতি মো. মঈনুল ইসলাম চৌধুরী ও বিচারপতি এ কে এম জহিরুল হকের ভার্চ্যুয়াল হাইকোর্ট বেঞ্চ রায় ঘোষণা করেন।
রায়ে আওয়ামী লীগ দলীয় সংসদ সদস্য হাজী সেলিমের স্ত্রী মৃত্যবরণ করায় তাকে অব্যাহতি (অ্যাবেট) দেন। তবে হাজী সেলিমের দুই ধারায় দেওয়া ১৩ বছরের কারাদণ্ডাদেশের মধ্যে এক ধারার (১০ বছর) দণ্ড বহাল রেখেছেন আদালত। অপর ধারার দণ্ড (৩ বছর) থেকে তাকে খালাস দেওয়া হয়। একইসঙ্গে ১০ লাখ টাকা জরিমানা অনাদায়ের এক বছরের কারাদণ্ড দেন আদালত।
এ রায় পাওয়ার ৩০ দিনের মধ্যে তাকে বিচারিক আদালতে আত্মসমর্পণ করতে হবে। এ অবস্থায় তার সংসদ সদস্য পদ থাকবে কিনা এ নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
সংসদ সদস্য থাকার অযোগ্যতা সংক্রান্ত সংবিধানের ৬৬ (২) (ঘ) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, “তিনি নৈতিক স্খলনজনিত কোনো ফৌজদারি অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হইয়া অন্যূন দুই বৎসরের কারাদণ্ডে দণ্ডিত হন এবং তাঁহার মুক্তিলাভের পর পাঁচ বৎসরকাল অতিবাহিত না হইয়া থাকে। ”
এ বিষয়ে দুদকের আইনজীবী মো. খুরশীদ আলম খান বলেন, সংবিধানের ৬৬ (২) (ঘ) অনুচ্ছেদ অনুসারে যদি কেউ নৈতিকস্খলনের দায়ে ২ বছর বা তার বেশি সাজাপ্রাপ্ত হলে তিনি সংসদ সদস্য হিসেবে অযোগ্য হবেন। আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, তিনি যেহেতু দুর্নীতি মামলায় সাজাপ্রাপ্ত তাই এটা তার নৈতিকস্খলন। তাই সাংবিধানিকভাবে তিনি সংসদ সদস্য পদে থাকার যোগ্যতা হারিয়েছেন। তার সংসদ সদস্য পদ বাদ হয়ে যাবে। তবে বিষয়টি স্পিকার সিদ্ধান্ত নেবেন।
আইনজীবী মনজিল মোরসেদ বলেন, এটা তো নৈতিক স্খলন। তিনি পদে থাকার যোগ্যতা হারিয়েছেন। তবে স্পিকারের সামনে রায় যেতে হবে। যেমনটি হয়েছিলো শহিদ ইসলাম পাপুলের ক্ষেত্রে। স্পিকারের কাছে রায় এসেছে। তিনি সিদ্ধান্ত দিয়েছেন। এ অবস্থায় হাজী সেলিম যদি আপিল করে রায়ের ওপর স্থগিতাদেশ নিতে পারেন তাহলে তো ভিন্ন কথা। চূড়ান্তভাবে আপিল নিষ্পত্তি হতে হবে।
এদিকে এ রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করার কথা জানিয়েছেন আওয়ামী লীগ দলীয় এ সংসদ সদস্যের আইনজীবী সাঈদ আহমেদ রাজা। আদালতে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) পক্ষে ছিলেন আইনজীবী মো. খুরশীদ আলম খান, হাজী সেলিমের পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী আবদুল বাসেত মজুমদার ও আইনজীবী সাঈদ আহমেদ রাজা। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল তামান্না ফেরদৌস ও সাথী শাহজাহান।
রায় ঘোষণার পর আইনজীবী খুরশীদ আলম খান বলেন, দুদক আইনে করা মামলায় সম্পদের তথ্য গোপনের (২৬ এর ২ ধারা) অভিযোগে হাজী সেলিমকে বিচারিক আদালত ৩ বছরের কারাদণ্ডাদেশ দিয়েছিলেন। সেই অভিযোগ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত না হওয়ায় হাজী সেলিমকে তথ্য গোপনের অভিযোগ থেকে খালাস দিয়েছেন হাইকোর্ট। আদালত বলেছেন, দুদক এ অভিযোগ প্রমাণ করতে পারেনি।
কিন্তু দুদক আইনের ২৭ (১) ধারা অনুসারে জ্ঞাত আয় বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগে হাজী সেলিমকে বিচারিক আদালত ১০ বছরের কারাদণ্ডাদেশ দিয়েছিলেন। ওই অভিযোগে তার সাজা বহাল রেখেছেন হাইকোর্ট। একইসঙ্গে ১০ লাখ টাকা জরিমানা, অনাদায়ে ১ বছরের সশ্রম কারাদণ্ডাদেশের রায় দিয়েছেন।
এরপর বিচারিক আদালত যেদিন হাইকোর্টের রায়ের পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি পাবেন, সেদিন থেকে ৩০ দিনের মধ্যে হাজী সেলিমকে আত্মসমর্পণের নির্দেশ দিয়েছেন। আর আত্মসমর্পণ না করলে তার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করতে বলা হয়েছে। আর যেসব সম্পত্তি নিয়ে এ সাজা দেওয়া হয়েছে তা বাজেয়াপ্ত করে রাষ্ট্রীয় কোষাগারে নিতে হবে।
গত ৩১ জানুয়ারি এ শুনানি শুরু হয়েছিল। এর আগে গত ১১ নভেম্বর এ মামলার বিচারিক আদালতে থাকা যাবতীয় নথি (এলসিআর) তলব করেছিলেন উচ্চ আদালত। সে আদেশ অনুসারে নথি আসার পর আপিল শুনানির জন্য দিন ধার্য করা হয়।
২০০৭ সালের ২৪ অক্টোবর হাজী সেলিমের বিরুদ্ধে লালবাগ থানায় অবৈধভাবে সম্পদ অর্জনের অভিযোগে মামলা করে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।
এ মামলায় ২০০৮ সালের ২৭ এপ্রিল তাকে দুই ধারায় ১৩ বছরের কারাদণ্ড দেন বিচারিক আদালত।
২০০৯ সালের ২৫ অক্টোবর এ রায়ের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে আপিল করেন হাজী সেলিম। ২০১১ সালের ২ জানুয়ারি হাইকোর্ট এক রায়ে তার সাজা বাতিল করেন।
পরবর্তী সময়ে হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করে দুদক। ওই আপিলের শুনানি শেষে ২০১৫ সালের ১২ জানুয়ারি হাইকোর্টের রায় বাতিল করে পুনরায় হাইকোর্টে শুনানির নির্দেশ দেন আপিল বিভাগ।
পরে গত বছরের ৯ নভেম্বর দুদকের আইনজীবী খুরশীদ আলম খান জানিয়েছিলেন, ৮ নভেম্বর তিনি দুদক থেকে এ মামলা পরিচালনার জন্য নিয়োগপ্রাপ্ত হয়েছেন। পর দিন ৯ নভেম্বর মামলাটি শুনানির জন্য কার্যতালিকাভুক্ত করতে তিনি আদালতে আবেদন (মেনশন) করেন। আপিলটি কার্যতালিকাভুক্ত হওয়ার পর ১১ নভেম্বর নথি তলব করেন হাইকোর্ট।