ঢাকা, বৃহস্পতিবার ৯ই মে ২০২৪ , বাংলা - 

প্রশাসনে সততা-শৃঙ্খলা চর্চায় এগিয়ে নারীরা

স্টাফ রিপোর্টার।।ঢাকাপ্রেস২৪.কম

2021-03-07, 12.00 AM
প্রশাসনে সততা-শৃঙ্খলা চর্চায় এগিয়ে নারীরা

কর্মক্ষেত্রে নারীদের জন্য এখনো রয়েছে নানা চ্যালেঞ্জ। তারপরও প্রশাসনে আগের তুলনায় নারীরা বেশি আসছেন, উঠে আসছেন শীর্ষ পদগুলোতেও। আর প্রশাসনে দুর্নীতির বিষয়টি মাঝেমধ্যেই আলোচিত হলেও সেখানে নারী কর্মকর্তাদের নাম আসে না বললেই চলে।প্রশাসনের নারী কর্মকর্তাদের সংগঠনের নেতা, প্রশাসন নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষ ও সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, প্রশাসনে পুরুষদের চেয়ে নারী কর্মকর্তাদের মধ্যে দুর্নীতির প্রবণতা কম। নারীরা কর্মস্থলে পুরুষের চেয়ে বেশি নিয়মানুবর্তিতা ও শৃঙ্খলার স্বাক্ষর রাখছেন।আমাদের সামাজিক প্রেক্ষাপটে আমরা যেটা দেখি নারীদের মধ্যে দুর্নীতি কম দেখা যায়। নারীরা কম দুর্নীতি করেন

প্রশাসনের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পরিসংখ্যান নিয়ে সর্বশেষ ২০১৯ সালে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের প্রকাশিত ‘স্ট্যাটিসটিকস অব সিভিল অফিসার্স অ্যান্ড স্টাফস, ২০১৯’-এর তথ্য অনুযায়ী, প্রশাসনে প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির মোট কর্মকর্তার সংখ্যা ছিল ১৪ লাখ ৩৩ হাজার ৯৪৬ জন। এর মধ্যে নারী কর্মকর্তা ছিলেন তিন লাখ ৯৬ হাজার ৪১৭।

বর্তমানে প্রশাসনে ৭৬ জন সচিব ও সচিব পদমর্যাদার কর্মকর্তার মধ্যে নারী কর্মকর্তা রয়েছেন ১০ জন। মাঠ প্রশাসনে ৬৪ জেলা প্রশাসকের মধ্যে নারী ১০ জন এবং ৪৯২ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের (ইউএনও) নারী ১৪৯ জন।

জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সচিব শেখ ইউসুফ হারুন বলেন, ‘নারীরা প্রশাসনে আসার কারণে প্রশাসনের মান আরও বেড়েছে। দুর্নীতি কমেছে। নারীরা যদি আরও বেশি হারে এগিয়ে আসেন তবে দুর্নীতি কমানোর ক্ষেত্রে সহায়ক হবে। এছাড়া নারীর ক্ষমতায়ন, গণতন্ত্র প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ সহজ হবে।’

তিনি বলেন, ‘প্রশাসনে নারীরা অনেক এগিয়েছেন বলে আমরা মনে করি। আমাদের ৪৯২টি উপজেলার মধ্যে দেড়শ’র মতো নারী ইউএনও রয়েছেন। জেলা প্রশাসক রয়েছেন ১০ জনের মতো। সচিবও রয়েছেন ১১ জনের মতো।’

বাংলাদেশ অনেক এগিয়েছে, কিন্তু নারী কর্মকর্তারা এখনো ভালনারেবল। আমরা দেখেছি বিভিন্ন সময়ে মাঠ পর্যায়ে কাজ করতে গিয়ে অড সিচুয়েশন সৃষ্টি হচ্ছে ‘আগের কয়েক বছরের অনুপাত করলে দেখা যাবে এখনই নারীরা সর্বোচ্চ সংখ্যক রয়েছেন। যে কোনো পর্যায়ে তারা তাদের মতামত রাখছেন’—যোগ করেন জনপ্রশাসন সচিব।

বাংলাদেশ হাইটেক পার্ক কর্তৃপক্ষের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (সচিব) হোসনে আরা বেগম বলেন, ‘ওপরের পদগুলোতে নারীদের আরও পদায়ন হওয়া উচিত। নারী সচিব পুরুষের ১০ শতাংশ মাত্র।’ তিনি বলেন, ‘আমরা এখনো কর্মক্ষেত্রে নানা ধরনের সমস্যা ফেস করি। মেয়েরা কাজ করতে পারেন না, কথা বলতে পারেন না, নিজেকে উপস্থাপন করতে জানেন না—এখনো অনেকের মধ্যে এ ধারণা আছে। এর মধ্য দিয়েই আমরা কাজ করছি।’

হোসনে আরা বেগম বলেন, ‘মেয়েরা ছোটবেলা থেকেই একটি শৃঙ্খলার মধ্যে বড় হন। বাবা-মা ছেলেদের তুলনায় মেয়েদের বেশি নিয়ম-কানুনের মধ্যে রাখেন। একটা মেয়ে সন্ধ্যার পর বাইরে থাকতে পারেন না। মেয়েদের মধ্যে শৃঙ্খলা বোধটা ছেলেদের চেয়ে বেশি। কাজের ক্ষেত্রে মেয়েরা এর স্বাক্ষর রাখেন। একজন নারী পুরুষের তুলনায় বেশি অফিসে থাকেন। একটা মেয়ে চাইলে বাইরে ঘোরাঘুরি করতে পারেন না, করেন না।’

‘সততটাও মেয়েরা পরিবারের কাছ থেকে শেখেন। শৃঙ্খলার মধ্যে থাকার কারণে শুরু থেকেই তারা সততার প্রতি অঙ্গীকারাবদ্ধ থাকেন। প্রশাসনে কাজের ক্ষেত্রে ছেলেদের তুলনায় মেয়েরা বেশি সততার স্বাক্ষর রাখেন। মেয়েরা প্রশাসনে যত আসবেন দুর্নীতি তত কমবে।’

ক্যাডার সার্ভিসের নারী কর্মকর্তাদের সংগঠন বিসিএস উইমেন নেটওয়ার্কের মহাসচিব ও স্থানীয় সরকার বিভাগের যুগ্ম-সচিব সায়লা ফারজানা বলেন, ‘আমাদের সামাজিক প্রেক্ষাপটে আমরা যেটা দেখি নারীদের মধ্যে দুর্নীতি কম দেখা যায়। নারীরা কম দুর্নীতি করেন।’

তিনি বলেন, ‘সাধারণ যে প্র্যাকটিস, সেখানে দেখা যায় নারীরা প্রশাসনে কম দুর্নীতিগ্রস্ত হন। আইন-কানুনের প্রতি বেশি অনুগত হন। এটা পুরুষের ক্ষেত্রে হতে পারে, নারীর ক্ষেত্রেও হতে পারে। আমরা দেখে আসছি এটা নারীর ক্ষেত্রে একটু বেশি।’

‘প্রশাসনে নারীরা এখন অনেক ভালো কাজ করছেন। সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় যদি তারা সম্পৃক্ত থাকেন, তবে তারা যোগ্যতার স্বাক্ষর রাখছেন। নারীরা ভালো করার চেষ্টা করছেন। আমরা যারা মিড লেভেলে আছি, আমরা জুনিয়র কর্মকর্তাদের সবসময় উৎসাহ দেই, দুর্নীতিগ্রস্ত না হয়ে মানুষকে কীভাবে সেবা দেয়া যায়। সেই চেষ্টাটা আমাদের করতে হবে।’

সায়লা ফারজানা বলেন, ‘আগের তুলনায় নারীরা প্রশাসনে অনেক ভালো অবস্থানে আছেন। আমাদের প্রধানমন্ত্রী নারীদের জন্য অনেক সুযোগ তৈরি করেছেন। তবে আমাদের প্রত্যাশা ডিসিশন মেকিং পদগুলোতে আরও বেশি যেতে চাই। কারণ নারীরা ডিসিশন মেকিং পদগুলোতে যোগ্যতার স্বাক্ষর রাখছেন।’

তিনি আরও বলেন, ‘এখন আমাদের মাথায় শুধু উন্নয়ন, কারণ আমরা এখন স্বল্পোন্নত দেশ থেকে বেরিয়ে এসেছি। এখন উন্নয়ন দেশের পথে হাঁটছি। শুধু সেবা দেয়াই নয়, উন্নয়ন কাজেও নারীরা খুব ভালো ভূমিকা রাখতে পারছেন।’

‘নির্বাহী প্রকৌশলী পদে নারীদের অংশগ্রহণে ঘাটতি আছে। শুধু অ্যাডমিন ও পুলিশ দেখলেই হবে না। উন্নয়ন কাজ যেসব পদের মাধ্যমে হয় সেখানেও নারীর অংশগ্রহণ বাড়াতে হবে। সেখানে আমাদের অসন্তোষ এখনো রয়ে গেছে।’

এ যুগ্ম-সচিব বলেন, ‘আমি পিডব্লিউডি ক্যাডারের কয়েকটি মেয়েকে উদ্ধুদ্ধ করেছিলাম, তোমার জেলায় যাও, নির্বাহী প্রকৌশলী পদে কাজ করো। তাদের মধ্যে একজন আমাকে বলেন, পিপিআর (সরকারি ক্রয় বিধি) ফলো করে কাজ করা যায় না, সে কারণে আমরা যাব না।’

‘আমি তার বক্তব্যের ব্যাখ্যা দুই রকমভাবে দেব- একটি হলো প্রেসার থাকতে পারে, সেটা মোকাবিলা করার জন্য তাকে যথেষ্ট সাহসী হতে হবে এবং প্রেসার যাতে না থাকে সেজন্য তাকে সহযোগিতা করতে হবে। আমরা নারী কর্মকর্তাকে উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের ক্ষেত্রগুলোতে চাই। অন্যরা তাকে সহযোগিতা করবেন, তিনি যেন নিয়ম-কানুন মেনে কাজটি করতে পারেন।’


বিসিএস উইমেন নেটওয়ার্কের মহাসচিব বলেন, ‘বাংলাদেশ অনেক এগিয়েছে, কিন্তু নারী কর্মকর্তারা এখনো ভালনারেবল। আমরা দেখেছি বিভিন্ন সময়ে মাঠ পর্যায়ে কাজ করতে গিয়ে অড সিচুয়েশন (অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি) সৃষ্টি হচ্ছে। আমরা সবাই মিলে যদি কর্মক্ষেত্রের প্রতিবন্ধকতাগুলো দূর করার চেষ্টা করি, তবে নারী কর্মকর্তাদের জন্য কর্মক্ষেত্র আরেকটু মসৃণ হবে।’

সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা এম হাফিজ উদ্দিন খান এ বিষয়ে বলেন, ‘আমি যখন সরকারি চাকরি করেছি, তখন প্রশাসনে নারীদের সংখ্যা অনেক কম ছিল। যারা ছিলেন, যাদের আমি সহকর্মী হিসেবে পেয়েছি, তারা অনেক ভালো ছিলেন। ডিসিপ্লিন, কাজ সম্পাদন, সততা—সব দিক দিয়েই তারা ভালো ছিলেন।’

সাবেক মহাহিসাবরক্ষক ও নিয়ন্ত্রক (সিএজি) হাফিজ উদ্দিন আরও বলেন, ‘বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও অডিটর জেনারেলের অফিসে যাদের পেয়েছি, আই ফাউন্ড দেম গুড।’

তিনি বলেন, ‘নারীরা প্রশাসনে বেশি বেশি এলে দুর্নীতি কমবে, শৃঙ্খলাও বজায় রাখা সহজ হবে।’

নারী সচিব
বর্তমানে প্রশাসনে ৭৬ জন সচিব ও সচিব পদমর্যাদার কর্মকর্তা রয়েছেন। এর মধ্যে নারী ১০ জন।

সচিব ও সচিব পদমর্যাদার কর্মকর্তাদের মধ্যে রয়েছেন- বাংলাদেশ হাইটেক পার্ক কর্তৃপক্ষের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (সচিব) হোসনে আরা বেগম, খাদ্য সচিব ড. মোছাম্মৎ নাজমানারা খানুম, বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস প্রশাসন একাডেমির রেক্টর (সচিব) বদরুন নেছা, অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের সচিব ফাতিমা ইয়াসমিন, পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপ অথরিটির (পিপিপি) প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সচিব) সুলতানা আফরোজ, বাংলাদেশ সরকারি কর্মকমিশন সচিবালয়ের সচিব মোছা. আছিয়া খাতুন, পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য (সচিব) মোসাম্মৎ নাসিমা বেগম, বাংলাদেশ জ্বালানি ও বিদ্যুৎ গবেষণা কাউন্সিলের চেয়ারম্যান (সচিব) জাকিয়া সুলতানা, সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সচিব বেগম মাহ্ফুজা আখতার এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব মোসাম্মৎ হামিদা বেগম।

এছাড়া প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের মুখ্য সমন্বয়ক (এসডিজি) হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন অবসরপ্রাপ্ত সিনিয়র সচিব জুয়েনা আজিজ।

নারী জেলা প্রশাসক
বর্তমানে ৬৪ জেলার মধ্যে নারী জেলা প্রশাসক রয়েছেন ১০ জন। এদের মধ্যে অঞ্জনা খান মজলিস চাঁদপুর, ইয়াসমিন পারভীন তিবরিজি বান্দরবান, সৈয়দা ফারহানা কাউনাইন নরসিংদী, শাহিদা সুলতানা গোপালগঞ্জ, দিলসাদ বেগম রাজবাড়ীর জেলা প্রশাসক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।

এছাড়া মাদারীপুরে রহিমা খাতুন, শেরপুরে আনার কলি মাহবুব, জামালপুরে মুর্শেদা জামান, পঞ্চগড়ে সাবিনা ইয়াসমিন ও হবিগঞ্জে ইশরাত জাহান জেলা প্রশাসক হিসেবে দায়িত্ব সামলাচ্ছেন।