রেসকোর্স ময়দানে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সেই ঐতিহাসিক ভাষণের দিনটি এবার প্রথম রাষ্ট্রীয়ভাবে পালিত হচ্ছে। সরকারের সিদ্ধান্তে জাতীয় দিবস হিসেবে এবার পালিত হচ্ছে ৭ মার্চ। তবে বঙ্গবন্ধুর কালজয়ী এ ভাষণের দিন রাষ্ট্রীয়ভাবে পালনের স্বীকৃতি পেতে অপেক্ষা করতে হয়েছে ৫০টি বছর। এ জন্য প্রয়োজন হয়েছে উচ্চ আদালতের নির্দেশনাও।২০২০ সালের ৭ অক্টোবর বঙ্গবন্ধুর ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ দেওয়া ভাষণের দিনটিকে ‘ঐতিহাসিক ৭ মার্চ’ হিসেবে ঘোষণার জন্য সরকারের সাংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রস্তাব মন্ত্রিসভায় অনুমোদন পায়। পরে ১৫ অক্টোবর মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ এ বিষয়ে পরিপত্র জারি করে। তবে সরকার স্বপ্রণেদিত হয়ে দিবসটি ঘোষণার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিষয়টি তা বলা যাবে না। এজন্য নাগরিককে দুই বার উচ্চ আদালতের সরণাপন্ন হতে হয়েছে। যার সূত্র ধরে দিবসটির স্বীকৃতির আদেশ আসে উচ্চ আদালত থেকেই। সরকার আদালতের ওই আদেশ বাস্তবায়ন করেছে মাত্র।
সরকার জাতীয় ও আন্তর্জাতিক দিবস উদযাপন পালন সংক্রান্ত পরিপত্রের ‘ক’ শ্রেণিভুক্ত দিবস হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয় দিনটিকে। তবে ক-শ্রেণিভুক্ত অন্যান্য দিবসের মতো ৭ মার্চ সাধারণ ছুটি ঘোষণা হয়নি।
৭ মার্চ যুক্ত হওয়ার পর সরকারের ক-শ্রেণিভুক্ত দিবস দাঁড়ালো ১৯টিতে। এগুলো হলো- ২১ ফেব্রুয়ারি শহীদ দিবস/আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস; ৭ মার্চ ঐতিহাসিক দিবস; ১৭ মার্চ জাতির পিতার জন্মদিবস ও জাতীয় শিশু দিবস; ২৫ মার্চ গণহত্যা দিবস; ২৬ মার্চ স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবস; ৫ আগস্ট শহিদ ক্যাপ্টেন শেখ কামাল-এর জন্মবার্ষিকী; ৮ আগস্ট বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন নেছা মুজিবের জন্মবার্ষিকী; ১৫ আগস্ট জাতীয় শোক দিবস; ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবস; ঈদ-উল-আযহা (১০ জিলহজ্জ); ঈদ-ই মিলাদুন্নবী (সা.) (১২ রবিউল আউয়াল); বাংলা নববর্ষ (১ বৈশাখ/১৪ এপ্রিল); দুর্গাপূজা; বড়দিন (২৫ ডিসেম্বর); বৌদ্ধ পূর্ণিমা (মে মাসে); মে দিবস-(১মে); রবীন্দ্র জয়ন্তী (২৫ বৈশাখ) এবং নজরুল জয়ন্তী (১১ জৈষ্ঠ)।
এসব দিবস কোনটি কীভাবে পালন করা হবে তা মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে পরিপত্র জারি করে নির্ধারণ করা হয়। এক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয়ভাবে অনুষ্ঠানমালার আয়োজনের পাশাপাশি কোন কোনও দিনও সাধারণ ছুটি ঘোষণা হয়। কোনও দিন জাতীয় পতাকা উত্তোলন হয়। কোনোদিন একইসঙ্গে জাতীয় পতাকা উত্তোলন ও সাধারণ ছুটি থাকে। আবার কয়েকটি দিন রয়েছে সাধারণ ছুটি বা জাতীয় পতাকা উত্তোলনের বিধান না রেখে কেবল রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠান মালার আয়োজন করা হয়।
সরকারের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী দিবসটি উদযাপনের উদ্যোক্তা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের। তবে বিষয়ভিত্তিক বণ্টনের আওতায় মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক এবং শিক্ষা মন্ত্রণালয় এর সঙ্গে সংযুক্ত রয়েছে।
ক-শ্রেণিভুক্ত অন্যান্য দিনের মতো ৭ মার্চের এ দিনটিতে জাতীয় পতাকা উত্তোলনের সিদ্ধান্ত হয়। যার প্রেক্ষিতে গত ১৬ ফেব্রুয়ারি মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে গেজেট নোটিফিকেশনের মাধ্যমে পতাকা বিধিমালা, ১৯৭২’ সংশোধন করে ৭ মার্চকে পতাকা উত্তোলন দিবসের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। যার কারণে এবার ৭ মার্চ বাংলাদেশের সর্বত্র সরকারি ও বেসরকারি ভবনসমূহে এবং বিদেশে অবস্থিত কূটনৈতিক মিশনের অফিস ও কনস্যুলার পোস্টসমূহে বাধ্যতামূলকভাবে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করা হচ্ছে।
এর আগে উচ্চ আদালতের নির্দেশনা মানতে ২০২০ সালের ১৩ জুলাই মন্ত্রিসভার বৈঠকে সাত মার্চকে ঐতিহাসিক দিবস ঘোষণায় সম্মতি দেয় মন্ত্রিসভা। ওই বৈঠকে বিশেষ দিবস হিসেবে ঘোষণার জন্য সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়কে নতুন করে মন্ত্রিসভায় প্রস্তাব আনতে বলা হয়। যার প্রেক্ষিতে গত বছর ৭ অক্টোবর মন্ত্রিসভা থেকে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি আসে।
এদিকে ৭মার্চ ঐতিহাসিক দিবস ঘোষণা করে তা পালনে গত বছর (২৫ ফেব্রুয়ারি ২০২০) উচ্চ আদালত আদেশ দেন। সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী বশির আহমেদের ২০১৭ সালে দায়ের করা এ সংক্রান্ত রিটের প্রেক্ষিতে আদালত এ রায় দিয়েছিলেন। এর আগে ২০০৯ সালে সেক্টর কমান্ডার কে এম সফিউল্লাহ ও অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন হাইকোর্টে এ সংক্রান্ত একটি রিট করেন। যার প্রেক্ষিতে ঐতিহাসিক ৭ মার্চকে জাতীয় ঐতিহাসিক দিবস ঘোষণা করে গেজেট জারির নির্দেশ দিয়েছিলেন হাইকোর্ট। তবে কোনও অদৃশ্য কারণে সেটা বাস্তবায়ন হয়নি।
অবশ্য বাংলাদেশের ৭ মার্চকে স্বীকৃতি দেওয়ার আগেই ওইদিনকার বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণটিকে জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সাংস্কৃতিক সংস্থা (ইউনেস্কো) স্বীকৃতি দিয়েছে। ২০১৭ সালের ৩০ অক্টোবর ইউনেস্কো এই ভাষণটিকে ‘বিশ্ব প্রামাণ্য ঐতিহ্য’ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে ‘ইন্টারন্যাশনাল মেমোরি অব দ্য ওয়ার্ল্ড রেজিস্ট্রার’ এ অন্তর্ভুক্ত করে। সারা বিশ্ব থেকে আসা প্রস্তাবগুলো দুই বছর ধরে নানা পর্যালোচনার পর উপদেষ্টা কমিটি তাদের মনোনয়ন চূড়ান্ত করে। ইউনেস্কো তাদের মেমোরি অব দ্য ওয়ার্ল্ড (এমওডব্লিউ) কর্মসূচির উপদেষ্টা কমিটি ৭ মার্চের ভাষণসহ মোট ৭৮টি দলিলকে 'মেমোরি অফ দা ওয়ার্ল্ড ইন্টারন্যাশনাল রেজিস্ট্রারে' যুক্ত করে।
‘ঐতিহাসিক ৭ মার্চ’ দিবস যথাযথ মর্যাদায় পালনে সরকার অর্থও বরাদ্দ দিয়েছে। সরকারের সাংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয় থেকে মাঠ প্রশাসনকে এজন্য ৩০ কোটি ১০ লাখ টাকা টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এজন্য জেলা প্রশাসনকে এক লাখ টাকা এবং উপজেলা প্রশাসনকে ৫০ হাজার টাকা করে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।