এক সময় বিশ্বের দরবারে আমেরিকার এক এবং একমাত্র প্রতিপক্ষ ছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন। যুযুধান দুই পক্ষের মধ্যে চলত ‘ঠান্ডা লড়াই’। দীর্ঘ দিনের সংঘাতে বার বার উত্তপ্ত হয়েছে আন্তর্জাতিক রাজনীতি। তবে সে সব দিন এখন অতীত।সোভিয়েতের পতনের পর শুরু হয় আমেরিকার একচ্ছত্র ‘রাজত্ব’। বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী দেশ হিসাবে আত্মপ্রকাশ করে তারা। আমেরিকার মুদ্রাই এখন বিশ্ব অর্থনীতির চালিকাশক্তি।কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আমেরিকার আরও এক প্রতিপক্ষ তৈরি হয়েছে। গোপনে ক্রমে শক্তি বাড়িয়েছে চিন। শি জিনপিংয়ের দেশ এই মুহূর্তে বিশ্বের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ শক্তিধর দেশের তকমা পেয়েছে।আমেরিকার সঙ্গে চিনের প্রকাশ্য সংঘাত না হলেও বৈরিতার কথা গোপন নেই। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক বিষয়কে কেন্দ্র করে দুই শক্তিধর দেশের মধ্যে রেষারেষি চোখ এড়ায় না। প্রকাশ্যেই আমেরিকা এবং চিন একে অপরের বিরোধিতা করে।চিনের সঙ্গে এই দ্বৈরথের আবহেই আন্তর্জাতিক রাজনীতির পর্যবেক্ষকদের একাংশের দাবি, আমেরিকা সর্বোচ্চ শক্তিধরের সিংহাসন হারাতে বসেছে। বিশ্ব রাজনীতিতে ক্রমে আলগা হচ্ছে তাদের জমি।নানা বিষয়ে আমেরিকার দুর্বলতার ইঙ্গিত মিলেছে। আফগানিস্তান সমস্যা থেকে শুরু করে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ কিংবা পশ্চিম এশিয়ার সঙ্কট— এ কথা এখন স্পষ্ট যে, আমেরিকাই ‘শেষ কথা’ নয়।সম্প্রতি আরও একটি ক্ষেত্রে সেই ইঙ্গিত মিলেছে। আমেরিকার জোটসঙ্গী এক দেশের রাষ্ট্রপ্রধান হঠাৎ চিন সফরে যান। চার দিনের সফর শেষে দুই দেশের সম্পর্কের ইতিবাচক বার্তাও দিয়েছেন।কথা হচ্ছে অস্ট্রেলিয়াকে নিয়ে। অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী অ্যান্টনি অ্যালবানিজ় গত ৪ নভেম্বর চার দিনের সফরে চিনে গিয়েছিলেন। সাত বছর পরে অস্ট্রেলিয়া সরকারের তরফে কেউ পা রেখেছেন বেজিংয়ে।চিনে প্রতি বছর এই সফরের প্রতিশ্রুতি দিয়ে এসেছেন অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী। দুই দেশের সম্পর্ক মজবুত করার বিষয়ে জিনপিংয়ের সঙ্গে তাঁর আলোচনাও হয়েছে। ৫০ বছর আগে প্রথম অস্ট্রেলিয়ান রাষ্ট্রপ্রধান চিনে গিয়ে যেখানে দাঁড়িয়ে ছবি তুলেছিলেন, সেখানেই আবার ছবি তুলেছেন অ্যান্টনিও। এ ভাবে পুরনো সম্পর্কের স্বাদ ফিরিয়ে আনার বার্তা দেওয়া হয়েছে।অস্ট্রেলিয়ার এই আচমকা চিন-প্রীতি ভাল চোখে দেখেনি আমেরিকা। তারা মুখে কিছু না বললেও এ বিষয়ে হোয়াইট হাউসের উদ্বেগ অনুমেয়। কারণ আমেরিকার সঙ্গে জোটে রয়েছে অস্ট্রেলিয়া। তার মাঝে চিনের সঙ্গে তাদের ঘনিষ্ঠতা বাড়লে তা আমেরিকার জন্য অস্বস্তির কারণ হতে পারে।২০০৭ সালে আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া, ভারত এবং জাপান একটি জোট গঠন করে, যার নাম কোয়ার্ড্রিল্যাটারাল সিকিউরিটি ডায়লগ, সংক্ষেপে কোয়াড। অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী চিনে যাওয়ায় এই জোটের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে সন্দিহান হয়ে উঠেছেন অনেকে।ইন্দো-প্রশান্ত মহাসাগরীয় এলাকায় শান্তি বজায় রাখা এবং ওই এলাকার উন্নয়নের জন্য কাজ করাই কোয়াডের প্রাথমিক উদ্দেশ্য। তবে কূটনৈতিক বিশেষজ্ঞদের মতে, কোয়াড গঠনের নেপথ্যে আমেরিকার অন্য উদ্দেশ্য রয়েছে।এশিয়া তথা প্রশান্ত মহাসাগর সংলগ্ন এলাকায় আমেরিকা কোয়াডের মাধ্যমেই তাদের আধিপত্য বজায় রাখতে চায়। ওই এলাকায় যাতে চিন প্রভাব বিস্তার করতে না পারে, তার দিকেও নজর রয়েছে হোয়াইট হাউসের। কোয়াডের মাধ্যমে এশিয়ার দুই দেশ এবং অস্ট্রেলিয়াকে ‘হাতে’ রেখেছে আমেরিকা।এহেন জোটসঙ্গী চিনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হলে আমেরিকার বিপদ বাড়বে বলেই মনে করছেন বিশেষজ্ঞদের একাংশ। অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রীকে চিনে যেতে দেখে কেউ কেউ এমনও বলছেন যে, আমেরিকা আরও একটি বন্ধু ‘হারিয়ে’ ফেলল।চিনের সঙ্গে অস্ট্রেলিয়ার বাণিজ্যিক সম্পর্ক বহু দিনের। প্রতি বছর প্রচুর পণ্য দুই দেশের মধ্যে আদানপ্রদান হয়ে থাকে। তাই চিনকে প্রয়োজন অস্ট্রেলিয়ার। তাকে চটিয়ে দিয়ে অস্ট্রেলিয়া খুব একটা সুবিধা করতে পারবে না।অন্য দিকে, আমেরিকার সঙ্গেও অস্ট্রেলিয়ার বাণিজ্যিক বন্ধন দৃঢ়। কিন্তু এই দুই দেশের উৎপাদিত পণ্য প্রায় একই ধরনের। তাই চিনের কাছ থেকে অস্ট্রেলিয়ার ক্রয়যোগ্য পণ্যের সংখ্যা অনেক বেশি। বাণিজ্যে তাই চিনকেই বেশি প্রয়োজন অস্ট্রেলিয়ার।২০১৮ থেকে ২০১৯ সালে অস্ট্রেলিয়া এবং চিনের মধ্যে বাণিজ্যিক লেনদেন হয় প্রায় ১৪ হাজার ৬০০ কোটি ডলারের। চিনা পণ্যের রফতানি তালিকায় পাঁচ নম্বরে রয়েছে অস্ট্রেলিয়া।কিন্তু গত কয়েক বছরে অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে চিনের সম্পর্ক খুব একটা ভাল জায়গায় ছিল না। বেশ কিছু চিনা সংস্থাকে অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। বিশ্বের দরবারে কোভিড-১৯ ভাইরাসের উৎস হিসাবে চিনের নাম করেছিল এই অস্ট্রেলিয়াই। সম্পর্ক এমন জায়গায় পৌঁছেছিল যে, অস্ট্রেলিয়ার উপর বাণিজ্যিক নিষেধাজ্ঞা জারি করতে পারত চিন।২০২২ সালে নির্বাচনে জিতে অস্ট্রেলিয়ার ক্ষমতায় আসেন অ্যান্টনি। তিনি চিনের সঙ্গে বাণিজ্যিক সঙ্কটের আভাস পেয়েছিলেন। তাই আর ঝুঁকি নিতে চাননি। ঘনিষ্ঠতা বৃদ্ধি করেছেন জিনপিংয়ের সঙ্গে।চলতি বছরের মে মাসে অস্ট্রেলিয়ায় কোয়াডের বৈঠক ডাকা হয়েছিল। কিন্তু সেখানে আমেরিকার আচরণ অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে তাদের সুসম্পর্কের কফিনে শেষ পেরেকটি পুঁতে দেয় বলে মনে করছেন কেউ কেউ।কোয়াডের বৈঠকে যোগ দিতে অস্ট্রেলিয়া আসতে চাননি বাইডেন। শেষ মুহূর্তে তিনি সফল বাতিল করে দেন। বাইডেন এর পর যান জাপানে। সেখানে তিনি কোয়াডের সদস্যদের বৈঠকের জন্য ডেকে নিয়েছিলেন। যা পরোক্ষে অস্ট্রেলিয়ার চিন-ঘনিষ্ঠতার সিদ্ধান্তকে আরও মজবুত করে দেয়।অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী এর পরেই চিন সফরের কথা ঘোষণা করে দেন। তার পরে তড়িঘড়ি পশ্চিম এশিয়ার সঙ্কটদীর্ণ পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনার জন্য আমেরিকা অস্ট্রেলিয়াকে ডেকে পাঠায়। প্রধান অতিথি হিসাবে তাকে সম্মানও দেওয়া হয়। কিন্তু তত দিনে দেরি হয়ে গিয়েছে। অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী চিন সফর আর বাতিল করেননি। আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া এবং চিনের মধ্যেকার এই টানাপড়েন সাম্প্রতিক পরিস্থিতিতে আলাদা মাত্রা পেয়েছে। এদিকে আমেরিকার এশিয়ার শেষ বন্ধু ভারতের সাথেও ভাল সর্ম্পক যাচ্ছে না। বাংলাদেশের আসন্ন সংসদ নির্বাচন নিয়ে দুই দেশের মতানৈক্য হওয়ায় তাদের সর্ম্পকে তিক্ততা দেখা দিয়েছে। ভারত বাংলাদেশে একটি প্রগতিশিল সরকার তথা আওয়ামীলীগ ক্ষমতায় তাকুক সেটি চায়। আর আমেরিকা একটি সূস্ঠূ নির্বাচনের মধ্যেমে বর্তমান সরকারকে বিদায় দিতে চায়। এ নিয়ে দুই দেশের পররাষ্ট্র ও প্রতিরক্ষা মন্ত্রীদের মধ্যে সম্প্রতি সর্বশেষ বৈঠক হয় । এই বৈঠকে দুই দেশ একমত হতে পারেনি। এ কারনেই দুই দেশের সর্ম্পকে কিছুটিা হলেও বিঘ্ন হচ্ছে।