ঢাকা, মঙ্গলবার ৩ই ডিসেম্বর ২০২৪ , বাংলা - 

হত্যাই ভারতে মুসলিম শাসনের অবসান

সোহেল সানি

2021-03-05, 12.00 AM
 হত্যাই ভারতে মুসলিম শাসনের অবসান

ক্ষমতার লোভ বড়ই ভয়ঙ্কর। রাজ-সিংহাসন দখল নিয়ে সংঘটিত হয়েছে পিতা-পুত্র এবং ভাই ভাই হত্যাকাণ্ড। রাজতন্ত্রে প্রাসাদ ষড়যন্ত্রই ছিলো সিংহাসন লাভের মূল হাতিয়ার। ভারতবর্ষে মুসলিম শাসনের অবসান ঘটিয়ে ইংরেজদের ক্ষমতায় বসিয়েছে। হিন্দু মুসলিম ঐক্যে প্রায় দুইশত বছরের ইংরেজ  শাসনকালের অবসান ঘটালেও দেশবিভাগ ভারতবর্ষে মুসলমানদের ক্ষমতাসীন হওয়ার পথ চিরতরে বন্ধ করে দিয়েছে। তারপরও ষড়যন্ত্র বন্ধ হয়নি পাক-ভারত-বাংলায়। রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রে হত্যাকাণ্ডের শিকার হতে হয়েছে মহাত্মা গান্ধী, লিয়াকত, বঙ্গবন্ধু, ভুট্টো, ইন্ধিরা,রাজীব, বেনজীরকে। বৌদ্ধ পাল বংশের বা হিন্দু সেন বংশের শাসনামলেও প্রাসাদ ষড়যন্ত্র ছিলো।
মুসলিম শাসনামলে এ ষড়যন্ত্র প্রকট হয়ে ওঠে। সংঘটিত হয় একটার পর একটা হত্যা। ষড়যন্ত্রের মুখে ঝরে পড়ে অসংখ্য প্রাণ। রক্তের বন্ধন অপেক্ষা ক্ষমতার মসনদ রাজপরিবারের সদস্যদের কাছে বড় হয়ে উঠছিল।                                     
বাংলায় মুসলিম শাসনামলের অবসান ঘটার নেপথ্যে এই ষড়যন্ত্রই কাজ করে। এসব চক্রান্ত অগণিত মুসলিম শাসকের জীবন কেড়ে নিয়েছে। রাজপ্রাসাদের ক্ষমতার লড়াই হয়েছে যুদ্ধের ময়দানে। রাজ্যক্ষমতা রক্তের বন্ধনকে করেছে অস্বীকার। ফলে পিতার হাতে পুত্র বা পুত্রের হাতে পিতার নিহত হতে হয়েছে। ভাই ভাইকে হত্যা করে সিংহাসন দখল করা হয়ে উঠেছিল এক প্রাসাদীয় সংস্কৃতি।                                            বংশীয় শাসনপরিক্রমে পিতা-পুত্র,ভাইয়ে-ভাইয়ে শুধু নয়, রাজপ্রভুকে হত্যার মাধ্যমে সিংহাসনে আহরণের নজির দাস-ক্রীতদাসের বেলায়ও রয়েছে - বাংলায় তথা বাংলাদেশে।                                                       বর্তমান যুগে শাসকদের বলা হয়- রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী বা প্রতিমন্ত্রী-উপমন্ত্রী। আর প্রাচীন যুগে ভারত উপমহাদেশের প্রজাদের কাছে শাসকরা পরিচিত ছিলেন সম্রাট-সম্রাজ্ঞী, সুলতান-বাদশা, রাজা-মহারাজা, রানী-মহারানী,উজির-উজিরে আজম, নবাব-আমীর, নাজির-নাজিম, লেঃ গভর্নর-গভর্নর, গভর্নর জেনারেল-ভাইসরয় বা ছোটলাট-বড়লাট নামে। বাংলায় মুসলিম যুগের শাসনামলে শাসকরা সুলতান, গভর্নর, নবাব-সুবেদার, রাজা মহারাজা, উজির নাজির বলে অভিহিত ছিলেন।
মুসলিম যুগে বঙ্গাল দেশ 'বাঙলা' নামধারণ করে। বাঙলার মুসলমান শাসকদের অধিকাংশেরই পরিণতি ঘটে বড়ই নির্মম ও নিষ্ঠুরতায়।
বাংলার সেযুগ এক বিষাদ-বেদনায় গাঁথা। হত্যার মাধ্যমে সিংহাসন দখল পাল্টা দখলই ছিল ক্ষমতালিপ্সু রাজপরিবারের সদস্যদের মধ্যে এক স্বভাবসুলভ আচরণ।
নিয়মবহির্ভূত প্রতিযোগিতা কখনই রক্তাপাতহীন ছিলনা।
হত্যা ছাড়া সিংহাসন দখলের আর বিকল্প পথ ছিল না। হত্যার পথ অবলম্বনে প্রাসাদ ষড়যন্ত্রই ছিল প্রধান হাতিয়ার। যে ষড়যন্ত্রে সেনাপতিরাও পারিবারিক বিবাদ, যুদ্ধবিগ্রহ, সংঘাত,সংঘর্ষ ও হত্যার মদদদাতা ছিলেন।শাসকদের এ অবর্ণনীয় ইতিকথা বিচিত্র বটে।                                               "বঙ্গ' দেশের বারবার নতুন নামধারণেরও একটা ইতিহাস রয়েছে।"বঙ্গ'' ও 'বাঙ্গালা' হল 'বেঙ্গলা' পূর্তুগীজদের কারণে। ফরাসীরা পূর্তুগীজদের খেদিয়ে 'বেঙ্গলা'-কে করল 'বাঙ্গালা। আবার ফরাসীদের তাড়িয়ে ইংরেজরা নামকরণ করল 'বেঙ্গল।
মুসলিম যুগের সূচনায় হলে 'বঙ্গাল।'
ইলিয়াস শাহী বংশের শাসক সুলতান শামসুদ্দীন ইলিয়াস শাহ সমগ্র 'বঙ্গদেশ' দখল করে এদেশের নামকরণ করেন 'বাঙলা।'
এর সুবাদে দিল্লীর বাদশাকর্তৃক "শাহ বাঙালিয়ান" খেতাব লাভ করেন ইলিয়াস শাহ। ইংরেজরা ইংরেজী ভাষায় নামকরণ করেছিল 'বেঙ্গল প্রেসিডেন্সি' বা 'সুবে বাঙলা।' কালক্রমে বানানে 'বাঙলা' হয়ে ওঠে  'বাংলা।'   ১৯৪৭ সালের দেশবিভাগের পরও ' বাংলা' দেশবাচক অর্থে ব্যবহৃত হচ্ছে।
যদিও বঙ্গমাতার অঙ্গচ্ছেদ করে 'পূর্ববাংলা' ও 'পশ্চিমবাংলা' নামে দুটি প্রদেশে পরিণত করা হয়। ১৯৪৬-৪৭ সালে  বাংলার সর্বশেষ প্রধানমন্ত্রী শহীদ সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে স্বাধীন অখন্ড বাংলা করার চেষ্টা পরাহত হয়।
১৯৭১ সালে 'পূর্ববাংলা' বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে স্বাধীন 'বাংলাদেশ'র অভ্যুদয় হলেও 'পশ্চিমবাংলা' ভারতের স্বাধীনতায় এখনও পরাধীন।                                                    ১৯০৫ সালে ব্রিটিশ পার্লামেন্টে 'বঙ্গভঙ্গ' আইন পাস করে বাংলা বিভাগ করে 'পূর্ববঙ্গ' ও 'পশ্চিমবঙ্গ' নাম দেয়া হয়েছিল। তুমুল আন্দোলনের মুখে ১৯১১ সালে বঙ্গভঙ্গ রদ হলে 'বাংলা' স্বরূপে আত্মপ্রকাশ করে। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তানের অধীনে 'পূর্ববাংলা' প্রদেশ হলে এ নামও মুছে দিয়ে নাম রাখা হয় 'পূর্বপাকিস্তান।'বঙ্গ, বঙ্গাল, বাঙ্গালা, বেঙ্গলা, বাঙলা, বেঙ্গল বা  বাংলাদেশ যে নামে ডাকা হোক প্রাচীন বঙ্গদেশ বা বঙ্গরাজ্য বলতে পূর্ববঙ্গ বা পূর্ববাংলা এমনকি পূর্বপাকিস্তান শুধু নয়, সমগ্র বাংলাদেশ বলতে পশ্চিমবঙ্গ বা পশ্চিম বাংলা, কর্ণসুবর্ণ অর্থাৎ মুর্শিদাবাদ, গৌড়, সমতট, চন্দ্রদ্বীপ, হরিকেল, রাঢ়, তাম্রলিপ্ত, বারক, পুন্ড্র, বরেন্দ্র, বঙ্গাল,পান্ডুয়া, লক্ষ্মণাবতী, নবদ্বীপ, মালদহ, কলকাতা, বিহার, উড়িষ্যা, আসাম, ত্রিপুরা, বর্ধমান, সবই বঙ্গদেশের অধীনভুক্ত ছিল।                                            
সমগ্র বঙ্গদেশের একটা ভৌগোলিক চিত্র পাওয়া চীনা পরিব্রাজক হুয়েন সাং এর বিবরণীতে। সেটা ৬৩৮ সালের কথা। বঙ্গদেশে চারটি রাজ্য ছিল। পূর্ববঙ্গের রাজ্য নাম ছিল 'সমতট রাজ্য। দক্ষিণবঙ্গ রাজ্য হিসাবে পরিচিত ছিল 'তাম্রলিপ্ত রাজ্য' হিসাবে। উত্তরবঙ্গ রাজ্যের নাম 'পুন্ড্রবর্ধন রাজ্য' হিসাবে এবং পশ্চিমবঙ্গে রাজ্যের নাম ছিল 'কর্ণসুবর্ণ রাজ্য।'
খ্রিষ্টীয় দশম শতাব্দীততে দক্ষিণ বাংলায় বৃহত্তম বরিশাল এলাকা নিয়ে 'চন্দ্রদ্বীপ' নামেও একটি রাজ্য ছিল। পালযুগে বঙ্গদেশ উত্তর ও দক্ষিণ দু'ভাগে বিভক্ত ছিল। তুর্কী, খিলজী আমলে লক্ষ্মণাবতী, নবদ্বীপে সরকারের মূল কেন্দ্র ছিল। পাল ও সেন রাজাদের আমলে মূল কেন্দ্র ছিল সোনারগাঁও,বিক্রমপুর। মোগল আমলে রাজধানী হয় ঢাকা। বাংলার প্রাচীন কালে এদেশে বাস করত অস্ট্রিক, দ্রাবিড় ও আর্যরা। মৌর্যযুগে বৌদ্ধ ও জৈনধর্ম বেশ প্রসার লাভ করে। পালরা বৌদ্ধ ছিলেন।
অষ্টম শতকে পাল রাজত্বের শুরু, কিন্তু মুসলমানদের আগমের আগে সেন রাজাদের আমলে বাংলায়  ব্রাক্ষণ্যবাদ প্রসারিত হয়। সেন রাজারা ছিলেন গোঁড়া হিন্দু। প্রাক মুসলিম যুগে বাংলার জনগণ ছিল হিন্দু, বৌদ্ধ উপজাতীয় এবং জৈন ধর্ম মতাতাবলম্বী।                                                 বাংলায় 'বাং' গোত্রের লোকদের প্রাধান্য বজায় থাকে। পরবর্তীকালে আগত বিভিন্ন গোত্রের সংমিশ্রণে বিশেষ করে মুসলমানদের আগমনের সাথে এদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য পরিবর্তিত হয়।                                               বঙ্গদেশে তিন ভাবে ইসলাম প্রচার হয়।                                  আরব বনিকরা, তুর্কী বিজয়ের ফলে এবং মুসলমান সুফী দরবেশদের ধর্মপ্রচারের ফলে। মহানবী হযরত মহম্মদ (সঃ) এর সময় তাঁর কয়েকজন সাহাবী মালাবরের রাজা চেরুমল ও জেরুমলের সাথে সাক্ষাত করেন। রাজাদ্বয় ইসলাম গ্রহণ করেন। আরবীয় মুসসলমান সরাফ ইবন মালিককে ইসলাম প্রচারের অনুমতি দেন। তাঁকে জমিও দান করা হয়। মালাবরের রাজা মক্কায় যান এবং হযরতের খিদমতে উপস্থিত হয়ে তাঁর কাছে ইসলামের বায়আত গ্রহণ করেন। স্থানীয়দের কাছে যা ছিল মশহুর। দেশে ফেরার সময় রাজা পথিমধ্যে মৃত্যুবরণ করেন।
১২০৪ সাল থেকে ১৭৬৫ সাল পর্যন্ত ৭৬ জন রাজা, সুলতান,গভর্নর নাযিম পর্যায়ক্রমে বাংলা শাসন করেন। ২৬ জন ছিলেন স্বাধীন সুলতান। ইসলাম প্রচার করতে এদেশে আসেন, হযরত শাহ জালাল, হযরত শাহ আলী বোগদাদী,খানজাহান আলী, শাহ দৌলা শহীদ, বাবা আদম শহীদ,শাহ সুলতান মাহি সারওয়ার, শেখ জালালউদ্দীন তাবরেজী, শেখ আঁখী সিরাজউদ্দীন, শেখ আলাওল হক, হযরত নূর কুতুব ই আলম শাহ, সাইফুদ্দীন শাহ, ইসমাইল গাজী প্রমুখ।                                           চন্দ্রগুপ্তের সময় বঙ্গদেশের কিছু অংশ গুপ্ত সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হলেও পতনের পর আবার স্বতন্ত্র রাজ্য গড়ে ওঠে।
খ্রিষ্টীয় সপ্তম শতাব্দীতে মুর্শিদাবাদ জেলার প্রাচীন কর্ণসুবর্ণ নগরকে কেন্দ্র করে স্বাধীন গৌড়রাজের উদ্ভব হয়। রাজা শশাঙ্ক গৌড়ের সিংহাসনে বসেন। তাঁদের গৌড়, বঙ্গ, বঙ্গাল দেশের 'অধীশ্বর' বলা হয়।                              সেন রাজাদের পর ১৫৭৬ সালে মোগল সম্রাট আকবর বাংলাদেশ দখল করারার পর গৌড়ের রাজনৈতিক সত্ত্বা লুপ্ত হয়। তখন থেকে সমগ্র বাংলাদেশ 'বাঙলা' নামে পরিচিত। দুই বছর বাঙলা মোগলদের অধীনে ছিল। আকবরই বাঙলাকে ১৯টি জেললায় বিভক্ত করেন। সরকার বা বিভাগ নামে। এর ৬৮৯ মহাল ছিল। পরে ৩৪ বিভাগে ১৩৫০টি মহহাল ছিল।                                             ১৭৫৭ সালে বাংলা ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর হাতে এবং ১৮৫৮ সালে ব্রিটিশ সরকারের অধীনে চলে যায়। ১৮৬৭ সালে ইংরেজ সরকারের অধীনে ভারত ১২টি শাসন বিভাগে বিভক্ত ছিল।
বেঙ্গল, বোম্বে, ব্রিটিশ ব্রক্ষ, মাদ্রাজ, উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ, পাঞ্জাব, আসাম, মধ্য প্রদেশ, বেরার ও মহীশূর ও কুর্গ, রাজপুতানা, মধ্য ভারত। আসাম ১৮৬৭ সালে বাংলায় অন্তর্ভুক্ত হয়। একইভাবে অন্তর্ভুক্ত ছিল  যুক্ত প্রদেশ, বিহার ও উড়িষ্যা। বাংলার সীমানা কমিয়ে দেয় বঙ্গ, আসাম, বিহার, উড়িষ্যা ও ছোট নাগপুরে সীমাবদ্ধ করে।
চন্দ্রবংশ,পালবংশ, সেনবংশ, তুর্কী ও আফগান যুগ, ইলিয়াস শাহী আমল, হোসেন শাহী আমল,আফগান আমল ও মোগল যুগ সব যুগেই হত্যা হয়েছে। 'হত্যাকারী অবশ্যই হত্যার শিকার হবেন'ঐতিহাসিক এই প্রবাদই যে সত্য এবং শেষ কথা তা   বাংলায় মুসলিম শাসন এবং শাসকের পরিণতিই বলে দেয়। পদ-পদবীতে সম্রাট, সুলতান, আমীর, গভর্নর যে নামেই তাঁরা সিংহাসন অলঙ্কৃত করুন না কেন, তাঁরা প্রত্যেকেই রাজ্যশাসক।
'রক্ত-মূল্য' পরিশোধযোগ্য?
জনৈক বিধবা মায়ের একমাত্র পুত্র সুলতানের ছোঁড়া তীরে বিদ্ধ হয়ে নিহত হলেন। বিচারিক  দরবারে হাজির হলেন শোকার্ত বিধবা। বিচারপ্রার্থির অভিযোগ আমলে নিয়ে কাজী ( বিচারক) সুলতানের বিরুদ্ধে সমন জারী করলেন।  রাজ্যের অধিপতি সুলতান বিচারিক দরবারে হাজির হলেন। সাধারণ অপরাধীর বেশে। রায়ে সুলতানকে 'রক্তমূল্য' পরিশোধার্থে বিপুল অর্থদন্ড দিলেন এবং রায় ঘোষণার পরপরই সুলতানের প্রতি আদেশ আরোপিত হলো, সুলতানকে দোষী সাব্যস্ত করে আদালত এই মর্মে আদেশ করছে যে, সুলতান অপরাধ স্বীকারপূর্বক সয়ং তরবারীর দ্বারা নিজের বামহস্তে আঘাতপূর্বক নূন্যতম শত ফোটা রক্ত বিসর্জন দিয়ে নিহতের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শণ করুন। রায় ঘোষণার কয়েক মিনিটের মধ্যে সুলতান কাজীর আদেশ কার্যকর করে দরবারে উপস্থিত সবাইকে বিস্মিত করে দেন। বিচারক নিজেই তাঁর এজলাস ছেড়ে সুলতানকে কুর্নীশ করে প্রশংসাসংবলিত বাক্যদ্বারা অভিষিক্ত করে বলেন, আপনার ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠার যে স্বপ্ন সেই স্বপ্নপূরণের পথে ন্যায়পরায়ণ রাজ্যশাসক হিসাবে আপনার মেহেরবানী প্রস্ফুটিত হলো যে ভাষায় তাই  সর্বচ্চো আইন। সেই আইনের বিচার সভায় আমি কাজী হিসাবে অভিভূত, রাজ্যবাসীও অভিভূত হবে নিশ্চয়। আল্লাহ আপনার শাসন দীর্ঘ করুন, আয়ু দীর্ঘ করে। সেই দন্ডপ্রাপ্ত সুলতান হচ্ছেন গিয়াসউদ্দীন আজম শাহ। বিচারকের উদ্দেশ্যে তাঁর প্রতিক্রিয়া ছিল," ন্যায়বিচারক হিসাবে দায়িত্বপালনে পক্ষপাতমূলক ব্যর্থতা দেখালে কাজীর মাথাকে দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন করে দিতেন সুলতান।
কাজী সিরাজউদ্দীন হাস্যস্বরে পাল্টা বলেন, আইন অমান্য করে বিচারের প্রতি বৃদ্ধাঙ্গলী প্রদর্শণ করলে এজলাসে উঠে সুলতানকে চাবুক মারার আদেশ দিতাম। সুলতান গিয়াসউদ্দীন আজম শাহকে ১৪১১ সালে হত্যা করেন তাঁরই আমীর রাজা গণেশ। সোনারগাঁও মোগড়াপাড়ার শাহ চিল্লাপুরে সমাধিস্থ করা হয় তাঁকে। তাঁর মৃত্যুর পর সাইফুদ্দীন হামজা শাহ সিংহাসনে আরোহন করার পর ঐতিহাসিকরা তাঁকে সুলতান -উল সালাতিন নামে অভিহিত করেন। রাজা গণেশ তাঁকেও হত্যা করে। শূন্যতার কারণে দাস শিহাবউদ্দীন সুলতান ঘোষণা করে সিংহাসনে বসেন। রাজা গণেশ তাঁকেও হত্যা করে। শিহাবউদ্দীনের পুত্র আলাউদ্দিন ফিরোজ শাহ সিংহাসনে বসার কিছুদিন পর রাজা গণের হাতেই নিহত হন। রাজা গণেশ সিংহাসনে বসার পর বিভিন্নভাবে মুসলমানদের বিতাড়িত করেন। শায়খ বদরুল ইসলাম ও তাঁর পুত্র ফরিদুল ইসলাম আনুগত্য প্রকাশ করতে অস্বীকৃতি জানালে দরবারে ভেতরেই নৃশংসভাবে পিতাপুত্রকে হত্যা করে গণেশ। পরমধর্মদ্বেষ থেকে রাজা গণেশ মুক্ত হতে পারেননি। বহু মসজিদ তিনি ধ্বংস করেন। মুসলমানরা অত্যাচার থেকে রেহাই পেতে সুফী সাধক শায়খ নূর কুতুব উল আলমের আশ্রয় প্রার্থনা করেন। জৌনপুরের সুলতান ইব্রাহিম তাঁর সৈন্যবাহিনী নিয়ে বাঙলার দিকে অগ্রসর হন। বরিশালের পিরোজপুরে (তখন ফিরোজপুর) ঘাঁটি স্থাপন করেন। এ খবর পেয়ে শায়খ নূর লুতুব উল আলমের কাছে গিয়ে আত্মসমর্পণ করেন। জৌনপুরের সুলতানের সঙ্গে সমঝোতা করার প্রস্তাব দিলে গণেশকে জানিয়ে দেয়া হয়, রাজা গণেশ ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করলে রাজী আছেন। রাজা গণেশ রাজী হয়ে যান। কিন্তু স্ত্রী বাঁধা দেন। শেষ পর্যন্ত স্ত্রীর পরামর্শে পুত্র যদুকে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে সিংহাসনে বসার সুযোগ গ্রহণ করেন।  যদুর নামে হয়ে ওঠেন জালালউদ্দীন মোহাম্মদ। জৌনপুরের সুলতানকে বাঙলা ত্যাগ করতে বলেন। সুলতান চলে গেলে রাজা গণেশ তাঁর পুত্রকে বন্দী করেন। এবং যদুকে হিন্দুধর্মে পুনরায় দীক্ষিত করার জন্য চাপসৃষ্টি করেন। কিন্তু জালাল উদ্দীন মোহাম্মদ পুনায় যদু হতে রাজী না হয়ে ইসলাম ধর্মকে প্রচার করে ছড়িয়ে দেন। রাজা গণেশ মুসলমানদের ওপর অত্যাচার শুরু করলে শায়খ নূর কুতুব উল আলম মর্মাহত হয়ে ভেঙ্গে পড়ে মারা যান। রাজা গণেশ তাঁর পুত্র শায়খ আনোয়ার এবং তাঁর ভাতিজা শায়খ জায়েদকে বন্দী করে সোনারগাঁও নির্বাসন দেন। রাজা গণেশ শায়খ আনোয়ারকে হত্যা করার খবর পেয়ে ওদিনই জালাল উদ্দীন মোহাম্মদ তাঁর জন্মদাতা পিতা রাজা গণেশকে সিংহাসনে বসা অবস্থায় হত্যা করেন। এবং জালাল উদ্দীন মুহাম্মদ এবার নিজেই সিংহাসনে বসেন। সুলতান হিসাবে কুড়ি বছর তিনি রাজত্ব করেন। পান্ডুয়া থেকে গৌড়ে রাজধানী স্থানান্তর করেন।
১৪৩৪ সালে মৃত্যুবরণ করলে পান্ডুয়ায় তাঁকে সমাধিস্থ করা হয়। জালালউদ্দীনের পুত্র ১৪ বছর বয়সে সিংহাসনে বসেন। কিন্তু অচিরেই তাঁর দুই দাস সাদী খান ও নাসির খান শামস আলাউদ্দিন আবুল মুজাহিদ আহমেদ শাহকে হত্যা করে। সিংহাসনে বসা নিয়ে বিবাদ হলে নাসির খান সাদী খানকে হত্যা করেন। সিংহাসনে বসলেও নাসির খানকে আমীর উমরাহগণ তাঁর কর্তৃত্ব মানতে অস্বীকার করেন। এক সপ্তাহের ব্যবধানে নাসির খানও হত্যার শিকার হন। এরপর নাসিরুদ্দিন আবুল মুজাফফর মাহমুদ হাজী ইলিয়াসের উত্তরাধিকারী হিসাবে সিংহাসনে আরোহন করেন। সুলতান হিসাবে তিনি ২৪ বছর রাজত্ব করেন। রাজধানী তখন গৌড়।
সেনাপতি খুলনার বাগেরহাটের মুসলিম শাসনের বিস্তার ঘটান। যাঁর নাম খান জাহান আলী। বাগেরহাটে তাঁর নির্মিত ষাট গম্বুজ মসজিদ এখনও পর্যটকদের দৃষ্টি কাড়ে। ১৪৫৯ সালে খান জাহান আলী মৃত্যু বরণ করেন ওখানেই তাঁর সমাধি। সুলতান নাসির উদ্দীন ১৪৬০ সালে মারা যান। তাঁরপুত্র রুকন উদ্দীন বারবক শাহ সুলতান হন। তাঁর সময়ে মক্কা থেকে কুরাইশ বংশীয় শাহ ইসমাইল গাজী নামে এক ব্যক্তি একচত কুড়িজন সঙ্গী নিয়ে বাঙলায় আসেন। শাহ ইসমাইল গাজী সুলতান বারবক শাহকে সহায়তা করেন। বারবক শাহ ১৪৭৪ সালে তিনি মারা যান। ১৪৭৫ সালে তাঁর পুত্র শামসুদ্দীন আবিল মোজাফফর ইউসুফ শাহ সুলতান হন। তিনি ইসলামী আইন কঠোরভাবে পালনে কতিপয় নির্দেশ দেন। মদ্যপান নিষিদ্ধ করেন।
১৪৭৯ সালের গৌড়ের জামে মসজিদ তাঁর অক্ষয় কীর্তি। তাঁর রাজত্বের সময়ে ঢাকার মিরপুরে শাহ আলী বোগদাদীর দরগায়ে একটি মসজিদ নির্মান করা হয় ১৮৮০ সালে। শাহ আলী বোগদাদী তাঁর চারজন মুরিদ অবস্থান করেন। ১৫৭৭ সালে ফতেহ শাহ'র রাজত্বকালে তিনি ইন্তেকাল করেন। মসজিদের ভেতরেই তাঁকে দাফন করা হয়। ইউসুফ শাহ আমলেই বঙ্গভবন এলাকায় শেখ জালাল দখিনি নামে একজন দরবেশের মাজার আছে। সুলতান ইউসুফ শাহ সম্পর্কে অপ্রীতিকর মন্তব্য করায় সৈন্যরা ১৪৭৫ সালে তাঁকে হত্যা করে। ১৪৮১ সালে সুলতান ইউসুফ ইন্তেকাল করেন। তাঁর পুত্র সিকান্দার শাহ সিংহাসনে বসেন। অযোগ্য। তাই  দরবারের সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিরা সুলতান ইউসুয়ফ শাহর পিতার মাহমুদ শাহর পুত্র ফতেহ শাহকে সিংহাসনে বসান১৪৮২ সালে। সাত বছর রাজত্ব করেন। সুলতান ফতেহ শাহ অনুগত আবিসিনীয় কমান্ডার আমীরুল উমারা মালিক আন্দিল রাজধানীর বাইরে অবস্থানকালে রক্ষীবাহিনীর নেতা শাহজাদা সুলতান ফতেহ শাহকে হত্যা করে। শাহজাদা সুলতান বারবক শাহ নাম ধারণ করে সিংহাসন দখল করেন। কিন্তু ফতেহ শাহর অনুগত কমান্ডারআমালিক আন্দিল সুযোগ বুঝে বারবক শাহ হত্যা করে শাহজাদাকে। সিংহাসন দখল করেন আন্দিল শাহ। তিনি সুলতান সাইফুদ্দীন আবুল মুজাফফর ফিরোজ শাহ দ্বিতীয় নাম ধারণ করেন। ১৪৮৬ থেকে ১৪৮৯ সাল পর্যন্ত। সুলতান ফিরোজ শাহ ১৪৮৯ সালে তাঁকে হত্যা করা হয়। তাঁর পুত্র নাসিরুদ্দিন আবুল মুজাহিদ মাহমুূ শাহ দ্বিতীয় ১৪৯০ সালে সিংহাসনে বসেন। এক বছরের মধ্যে সামসুদ্দীন মুজাফফর শাহ তাঁকে হত্যা করে। সিংহাসন দখল করলেও ১৪৯১ সালে সৈয়দ হোসেন তাঁকে হত্যা করে সিংহাসন দখল করেন। তাঁর নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় আলাউদ্দিন হোসেন শাহ। ইলিয়াস শাহী বংশের শাসনও শেষ হয়। হোসেন শাহী বংশের শাসনকাল হোসেন শাহী শাসনামল স্থায়ী হয় ৪৬ বছর। চারজন সুলতানের দেখা মেলে এ আমলে। আলাউদ্দিন হোসেন শাহ ১৪৯৪ সালে এ বংশের প্রতিষ্ঠাতা। পর্তুগীজরা প্রথম চট্টগ্রাম বন্ূরে পদার্পণ করে। আলাউদ্দিন শাহ গৌড় থেকে রাজধানী একডালায় স্থানান্তর করেন। বাংলাদেশের সমগ্র অঞ্চল, বিহার, উড়িষ্যা, ত্রিপুরা, আসাম রাজ্যের বহু এলাকা তাঁর রাজ্যের অধীনস্থ ছিল। ১৫১৯ সালে সুলতান হোসেন শাহ মৃত্যু হলে তাঁর পুত্র নাসিরুদ্দিন নসরত শাহ সিংহাসনে বসেন। বাংলা সাহিত্যের বিকাশে তিনি বিরাট ভুমিকা রাখেন। গৌড়ের বিখ্যাত সোনা মসজিদ, বর্ধমান, মালদায়, ঢাকায়,পাবনায়, রাজশাহীতে বড় বড় মসজিদ নির্মান করেন। একজন খোজার হাতে নসরত শাহ বা নাসিরুদ্দিন শাহ মারা যান। তাঁর পুত্র আলাউদ্দিন আবুল মুজাফফর ফিরোজ শাহ সিংহাসনে বসেন। এক বছরের মাথায় তাঁর চাচা গিয়াসউদ্দীন মাহমুদ শাহর হাতে নিহত হন।
১৫৩৩ সালে পর্তুগীজরা বাংলায় প্রথম বানিজ্য ঘাঁটি স্থাপন করে। বাংলা শের খানের দখলে চলে যায় ১৫৩৮ সালে। সুলতান মাহমুদ শাহ পালিয়ে দিল্লীর সম্রাট হুমায়ুনের সাহায্য প্রার্থনা করেন। গৌড়ের দিকে সৈন্বাহিনী প্রপরণ করেন হুমায়ুন। পথিমধ্যে সুলতান মাহমুদ শাহ শুনতে পান তাঁর দুই ভাই পুত্রকে আফগানরা শের খানের বাহিনী হত্যা করেছে। এতে তিনি মৃত্যু বরণ করেন।
আফগান শাসনামল
১৫৩৮ সালে শেরখান গৌড়ে প্রবেশ করেন। পুত্র জালাল খান এবং জেনারেল খাওয়াস খানকে পাঠান সম্রাট হুমায়ুনের অগ্রাভিযান মোকাবেলার জন্য প্রতিরোধ করতে। কিন্তু তাদের পালিয়ে যেতে হয়। কিন্তু শের খান গৌড় শহরকে পুড়িয়ে দেন। ধনরতœ লুন্ঠন করেন। ১৫৩৮ সালে হুমায়ুন গৌড়ে আসেন। তিনি নতুন শহর গড়ে তোলার কাজ শুরু করে দেন এবং নামকরণ করেন জান্নাতাবাদ। কিন্তু শের খান বিহারে আধিপাত্য বিস্তার করেন। হুমায়ুন এসময় খবর পান তাঁর ভাই মীর্জা হিন্দাল আগ্রায় বিদ্রোহ করেছে। তিনি জাহাঙ্গীর কুলী বেগকে বাংলার দায়িত্ব দিয়ে আগ্রায় পথে যাত্রা করেন। শের খান আক্রমন করতেবথাকে। করামনসা নদীর কাছে হুমায়ুন ঘাঁটি করেন। শের খান থোরাডি নদীর তীরে শিবির স্থাপন কররেন। সন্ধি হয়। ১৫৩৯ সালে জুন মাসে শের খান আকষ্মিক মোগল শিবিরে আক্রমন চালান। সম্রাট হুমায়ুন কোনমতে প্রাণে বেঁচে যান। শের খান বাংলায় এসে মোগল গভর্নর জাহাঙ্গীর কুলী বেগকে হত্যা করেন। ফরিদউদ্দীন ববুল মুজাফফর শের শাহ নাম ধারণ করে সিংহাসনে বসেন।
১৫৪০ সালে হুমায়ুন শের শাহর বিরুদ্ধে আক্রমন করেন। কনৌজের বিলগ্রামে সংঘটিত যুদ্ধে হুমায়ুন পরাজিত হয়। খিজির খানকে বাংলার গভর্নর করে শের শাহ দিল্লী যান। খিজির খান স্বাধীনতা ঘোষণা করলে শের শাহ পুনরায় গৌড়ে এসে তাঁকে বন্দী করেন। শের শাহ প্রদেশকে তিনভাগে ভাগ করেন। একটা সরকার, যার দায়িত্ব পালন করবে একজন আমীর। তাদের কাজ তদারকী করবে কাজী ফজিলত। রাজকীয় আদেশ কার্যকর করা হচ্ছে কিনা তা দেখার দায়িত্ব কাজীর। দিল্লীর শাসনকর্তা শের শাহ পাঁচ বছর রাজত্ব করেন।
সোনারগাঁও থেকে দিল্লী পর্যন্ত গ্রান্ড ট্রাঙ্ক রোড সূচনা হয়।১৫৪৫ সালে শের শাহ মৃত্যুর পর পুত্র জালাল খান দিল্লীর সিংহাসনে বসেন। জালাল উদ্দীন আবুল মোজাফফর ইসলাম শাহ নাম ধারণ করে। সলিম শাহ নামেও পরিচিত ছিলেন।                                                       ১৫৩৩ সালে জালাল খান মারা গেলে নাবালক পুত্র ফিরোজ খান কয়েকদিন রাজত্ব করেন। শের শাহ চাচাতো ভাই মুবারিজ খান শিশুপুত্রকে হত্যা করে সিংহাসন দখল করেন। মোহাম্মদ শাহ আদদিল নাম ধারণ করেন। বাংলার গভর্নর মোহাম্মদ খান শূর স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। শামসুদ্দীন আবুল মোজাফফর মোহাম্মদ শাহ নাম ধারণ করে। মোহাম্মদ শাহ আদিলকে হত্যা করেন তাঁর জেনারেল হিমু। মোহাম্মদ শাহ আদিল গভর্নর নিয়োগ করেন শাহবাজ খানকে। কিন্তু মোহাম্মদ শাহ অনুগতরা নিয়োগ করেন খিজির খানকে বাংলার গভর্নর। খিজির খান গিয়াসউদ্দীন বাহাদুর শাহ নাম ধারণ করে শাহবাজ খানকে হত্যা করেন। গৈড়পর মসসনদে বসেন। শাহ আদিলকেও তিনি হত্যা করেন। ১৫৫৭ সালে। গিয়াস উদ্দীন বাহাদুর শাহ ছয় বছর রাজত্ব করেন।
১৫৬০ সালে মারা যান। তাঁর ভাই জালালুদ্দীন গিয়াসউদ্দীন আবুল মোজাফফর জালাল শাহ নাম ধারান করে সিংহাসনে বসেন। ১৫৬৩ সালে জালাল শাহ পুত্র সিংহাসনে বসলে জনৈক কররানীর ভাই তাজ খান কররানী তাঁকে হত্যা কররে। গৌড়ের সিয়ংহাসন দখলে নেন। ১৫৬৩ সালেই তাজ খান কররানী মারা গেলে সুলয়মান কররানী বাঙলা ও বিহারকে শাসনের অধীনে আনেন। ১৫৭২ পর্যন্ত রাজত্ব কররেন। উড়িষ্যাকেও রাজ্যভুক্ত করেন।
দিল্লীর সম্রাট আকবর মুনিম খানপর সাথে সন্ধি করেন। গৌড় থেকে টান্ডা রাজধানী স্থানান্তর কররেন। তাঁর মৃত্যুর পর পুত্র বায়েজিদ শাহ সিংহাসনে। কিন্তু তিনিও নিহত হন ১৫৭৬ সালে। দাউদ খান কররানী বন্দী হয়।                                                                মোগল জেনারেল খান জাহানের নির্দেশেনহত্যা করা হয়। তাঁর মাথা দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন করে দিল্লীতে সম্রাট আকবরের কাছে পাঠানো হয়য়। ১৫৭৮ সালে খান জাহান মারা যান। দাউদ খান কররানী নিহত হলে বাংলায় মোগল আধিপাত্য নিশ্চিত করতে ত্রিশ বছরের বেশি সময় লাগে।
খান জাহানের উত্তরসুরীরা ফরিদপুর বা ফতেহাবাদ,দিনাজপুর, রংপুর ঘোড়াঘাট এলাকায় আফগান আমীরদের কাছে হেরে যান। ঢাকা ও ময়মনসিংহ ঈসা খান মসনদ ই আলা প্রবল শক্তিশালী ছিলেন। খিজিরপুর বা নারায়ণগঞ্জ এগার সিন্ধুতে ঘাঁটি ছিল ঈসা খানের। দাউদ খানের অনুসারী শ্রীধর খুলনায় স্বাধীনতা ঘোষণা করেন।
মহারাজা বিক্রমাদিত্য উপাধি লাভ করেন। তাঁর পুত্র প্রতাপাদিত্য উপাধী নেন। বরিশালে জমিদার কন্দর্পনারায়ণ নিজের আধিপাত্য বিস্তার কররেন। নোয়াখালী লক্ষণ মানিক্য ক্মতাশালী ছিলেন। খান জাহান আলীর মৃত্যুপর ইসমাইল কুলী মোগলদের প্রতিনিধি ছিলেন।                                                                       সম্রাট আকবর বিহারের গভর্নর মুজাফফর খান তুরবতিকে বাংলার গভর্নর করেন। বাংলার আফগান কর্মচারীরা বিদ্রোহ কররে। ১৫৮০ সালে টান্ডায় মোগল মোজাফফর খানকে হত্যা করে সৈন্যরা। আকবরের প্ররতিনিধি টোডরমল ও তারসুন খান বিহারে আসেন। ১৫৮০ সালে শাহবাজ খানকে কিছুদিন পর আজম খান কোকা যোগ দেন টোডরমল ও শাহবাজ খানের সাথে। বিদ্রোহী মাসুম খান কাবুলি,পাবনায় শক্তিশালী ঘাঁটি করেন। মোগল আক্রমনের কারণে ঈশা খাঁ ঘাঁটিতে আশ্রয় নেন। মানসিংহ ছিলেন বিহারের গভর্নর ১৫৮৭-৯০।
১৫৯৪ সালে তাঁকে বাংলায় গভর্নর করা হয়। তিনি টান্ডা থেকে রাজমহলে রাজধানী স্থানান্তর কররেন। রাজমহলের নামকরণ করেন আকবর নগর। শাহবাজ খান ও মানসিংহের বার বার প্রয়াস সত্ত্বেও নিজেকে নিরাপদে রাখেন ঈসা খাঁ। মোগল সৈন্যদের তিননি পরাভূত করেন।
১৫৯৮ সালে মানসিংহ বাংলা ত্যাগ করেন। ১৫৯৯ সালে ঈসা খাঁও মারা যান। মুসা খান দায়িত্বে আসেন। মানসিংহ এর পুত্র প্রতাপ সিংহ এবং পৌত্র মহাসিংহ বাংলায় আসেন। উসমান খানসহ আফগান নেতা ১৬০০ সালে প্রতাপ সিংহ ও মহাসিংহের ওপপর আক্রমন চালায়। ১৬০১ সালে মানসিংহ আবার বাংলায় আসপনপন। ভাওয়ালে মোগল ঘাঁটিতে ওসমান খান আক্রমন করে। মানসিংহ শুনে যাত্রা করেন ভাওয়ালের উদ্দেশ্যে। উসমান খান পালিয়ে যান। মুসা খানকেও পরাস্ত করেন মানসিংহ। আরাকানের মগ জলদস্যুরা ঢাকা আক্রমন চালায়। তাদেরও শেষ করে দেন মানসিংহ। কেদার রায় মগদের সাথে যোগ দিয়ে শ্রীনগর মোগল ঘাঁটি আকক্রমণ করেন। মানসিংহ সৈন্য পাঠিয়ে পরাস্ত করেরেন। কেদার রায়কে বিক্রমপুরে বন্দী করেন। তাঁর মৃত্যু হয়। আকবর অসুস্থ হয়ে পড়লে মানসিংহ ১৬০৫ সালে আগ্রায় চলে যান। ১৬০৫ সালে আকবর মারা গেলে জাহাঙ্গীর সিংহাসনে বসেন। মানসিংহকে তিনি পুনরায় বাংলায় প্রেরণ করেন।
১৬০৬ সালে কুতুবউদ্দিন খান কোককা ও ১৬০৮ সালে জাহাঙ্গীর কুলী খান মোগল প্রতিনিধি হিসাবে বাংলায় আসেন। বর্ধমান শহরের মেহের উন নিশা নুরজাহান বেগমের স্বামী শের আফগানকে হত্যা করার কারণে কুতুবউদ্দিন কে বাংলায় প্রেরণ  কররেন জাহাহাঙ্গীর। সম্রাট জাহাঙ্গীর নূরজাহানের প্রেমে আসক্ত ছিলেন। কুতুবউদ্দিন বাংলায় শের খানকে হত্যা কররেন। নূরজাহানকে দিল্লীতে প্রেরণ করেরেন। বেগমের মর্যাদালাভ কররপন। তিনি নূরমহল,পরে নূরজাহান বেগম উপাধী ধারণ করেন।                                                              ১৬০৮ সালে ইসলাম খান চিশতিকে বাংলায় প্রেরণ করা হয়। তাঁর কারণে নবযুগের সূচনা হয়। ১৬০৮ সালে বাংলার রাজধানী করেন ঢাকাকে। ১৬১২ সালে ঢাকার নাম দেন জাহাঙ্গীরনগর। রাজমহল থেকে ঢাকায় রাজধানী নিয়ে আসা হয়। বিক্রমপুর, সোনারগাঁও, গৌড়, রাজমহল,পান্ডুয়া, টান্ডা, নদীয়া, লক্ষণবতী, কলকাতা, চন্দ্রদীপ।                                   গিয়াসউদ্দীন আজম শাহ ১৩৯০ থেকে ১৪১১ সাল পর্যন্ত বাংলা শাসন করেন। তাঁর পিতা সিকান্দার শাহ। ১৩৬৫ সালে পান্ডুয়ায় আদিনা মসজিদ নির্মান করেন। সিকান্দার শাহ'র শেষ জীবন কাটে অত্যন্ত দুঃখ-দুর্দশার মধ্যে। সৎ মায়ের কারণে তাঁর পুত্র গিয়াসউদ্দীন পিতা সিকান্দার শাহ'র বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেন।
১৩৮৯ সালের সেই পান্ডুয়ার গোয়ালপাড়া নামক স্থানের যুদ্ধে পিতা সিকান্দার পরাস্ত হবার পর মৃত্যুর মুখে পতিত হন। পুত্র গিয়াসউদ্দীন আজম শাহ সিংহাসনে বসে ১৩৯০ থেকে ১৪১১ সাল পর্যন্ত বাংলায় রাজত্ব করেন। ন্যায় বিচার ও ন্যায় নিষ্ঠার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হিসাবে আজম শাহ নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন।                                               ১৩৩৮ সালে ফখরুদ্দীন মোবারক শাহের ক্ষমতাগ্রহণের মধ্য দিয়ে বাংলায় তুর্কী ও আফগান শাসনামলের অবসান ঘটেছিল।
১১৯২ সালে মুইজ আল- দীন মুহাম্মদ ঘোরী তরাইনের দ্বিতীয় যুদ্ধে পৃথ্বিরাজকে পরাজিত করার পর উত্তর ভারতে মুসলিম আধিপাত্য প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। বিশ্বস্ত প্রতিনিধি হিসাবে কুতুবউদ্দিন আইবেককে ভারতে রেখে গজনীতে ফিরে যান। ১১৯৩ সালে কুতুবউদ্দিন আইবেক দিল্লীকে রাজধানী করে শাসনের কর্তৃত্ব বিহারের সীমানায় প্রসারিত করেন। আফগানিস্তানের গারামসি এলাকায় সাধারণ পরিবারে জন্ম নেয়া বেঁটে দৈহিকগড়নের ইখতিয়ার উদ্দীন মুহাম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজী ঘোরী দরবারের দিওয়ান-ই আর্দ-এ চাকরী নিলেও অনিয়মানুবর্তিতার কারণে পদচ্যুত হন। অযোধ্যার গভর্নর মালিক হুসাম আলাউদ্দিন কিছু জমি দান করলে জীবনের মোড় ঘুরে যায়। কুতুব উদ্দীন আইবেক কর্মকান্ডে খুশী হয়ে তাঁকে খিলাত খেতাব দেন। ইখতিয়ার বিহার বা মগধ আক্রমন করে উদন্তপুরীর প্রধান বৌদ্ধ দুর্গ জয় করেন। সামরিক ঘাঁটি স্থাপন করেনন। কুতুবউদ্দিন ওই সময় কালিঞ্জর দুর্গ জয় করে বদাউন এ অবস্থান করছিলেন। ইখতিয়ার খবর পেয়ে আইবেকের কাছে ছুটে যান। সঙ্গে নিয়ে যান কুড়িটি হাতিসহ নানারকমের স্বর্ণ রতœ ও অর্থ মুদ্রা। উপঢৌকনাদি পেয়ে আইবেক ইখতিয়ারকে বাঙলা দখল করে তা শাসন করার দায়িত্ব অর্পন করেন (লক্ষ্মণাবতী)।  
পশ্চিম বাংলায় এসময় রাজত্ব করছিলেন লক্ষ্মণ সেন। রাজধানী নদীয়ায় বসে। বৌদ্ধ ধর্মের প্রভাবে হিন্দু ধর্মের রীতিনীতি লোপ পেতে থাকে ওই সময়। বংশের প্রথম রাজা আদিশূর কনৌজ থেকে পাঁচজন ব্রাক্ষণকে বাংলায় আমন্ত্রণ জানালে ৫৯ জন নারী-পুরুষসহকারে বাংলায় আসেন। এদের বংশধররা বিক্রমপুরের ৩৬ টি গ্রামে বসতি গড়ে তোলে। ইলিয়াস শাহীবংশের শাসনামলে দাস-দাসী ক্রয়-বিক্রয় হত। সুলতান ফখরুদ্দীন মোবারক শাহ বাংলায় নিজেকে স্বাধীন সুলতান হিসাবে ঘোষণা করেছিলে।লেখকঃ সিনিয়র সাংবাদিক ও কলামিস্ট।