ঢাকা, বৃহস্পতিবার ২১ই নভেম্বর ২০২৪ , বাংলা - 

সাজা হতেপারে বিএনপির অনেকের

স্টাফ রিপোর্টার ।।দৈনিক সমবাংলা

2023-10-08, 12.00 AM
 সাজা হতেপারে বিএনপির অনেকের

বিএনপি জামায়াতসহ কয়েকটি  রাজনৈতিক দলের বেশ কিছু নেতা কর্মীদের আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগেই সাজা হয়ে যেতে পারে।এমনটাই আভাস পাওয়াগেছে আদালত পাড়ায়। এদের বিরুদ্ধে নাশকতা, ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ,চুরি ছিনতাই লুটপাটের মতো বহু অভিযোগ রয়েছে। এসব অভিযোগের প্রেক্ষিতে দায়ের করা মামলায় ধরাশায়ী হতে যাচ্ছেন সরকার বিরোধী অনেক নেতা কর্মী। সরকার পতনের দাবিতে রাজপথে বিএনপি ও  জামায়াত  ও সমমনা দলগুলো এবং বিএনপি অঙ্গ সংগঠনগুলো আন্দোলন করছে। তবে এসব দলের নেতাকর্মীদের বেশি সময় দিতে হচ্ছে আদালতে। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বিভিন্ন রাজনৈতিক সভা, সমাবেশে অভিযোগ করে আসছেন, নির্বাচনী বছরে হঠাৎ করে দলটির নেতাকর্মীদের নামে মামলা, গ্রেফতারি পরোয়ানা, দণ্ড দিয়ে রায় ঘোষণা বেড়ে গেছে।বিএনপির হিসাবে, ২০০৯ থেকে ২০২৩ পর্যন্ত দলটির নেতাকর্মীদের নামে যেসব মামলা হয়েছে, তার সংখ্যা প্রায় দেড় লাখ এবং এসব মামলার আসামি ৩৬ লাখের বেশি। এসব মামলায় বিএনপি, যুবদল, স্বেচ্ছাসেবক দল, কৃষক দল ও ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় নেতাদের মধ্যে শতাধিক আসামি।

 

বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া ও মহাসচিব মির্জা ফখরুল থেকে শুরু করে শীর্ষ পর্যায়ের সব নেতাই কোনো না কোনো মামলার আসামি। এরমধ্যে দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া ও ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান সাজাপ্রাপ্ত। অন্যদিকে এক মামলায় জামায়াত আমির ও সেক্রেটারিরও বিচার শুরু হয়েছে। অন্যদিকে একটি মামলায় জামায়াতের বর্তমান আমির ও সেক্রেটারিরও বিচার শুরু হয়েছে।বিএনপি এসব মামলাকে আন্দোলন দমাতে সরকারের কৌশল হিসেবে বলে দাবি করছে। অন্যদিকে, ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ ও সংশ্লিষ্টদের দাবি সহিংসতা কিংবা ভাঙচুরসহ বিভিন্ন অপরাধে এসব মামলা হয়েছে।সম্প্রতি ছয়টি মামলায় বিএনপি ও এর অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনের ৪৪ জন নেতাকর্মীর কারাদণ্ড হয়েছে। জানা গেছে, আরও দুই শতাধিক মামলার শুনানি চলছে। এর মধ্যে অন্তত ৩০টির বিচার শেষ পর্যায়ে। ১৭০টি মামলায় সাক্ষ্যগ্রহণ চলছে। এসব মামলায় কেন্দ্র থেকে শুরু করে থানা ও ওয়ার্ড পর্যায়ের গুরুত্বপূর্ণ নেতারা রয়েছেন।২০১৮ সালের নির্বাচনের আগে দলটির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে দুই মামলায় সাজা দেন ঢাকার বিশেষ আদালত। আরও তিনটি মামলার বিচার চলছে। ৭ বছর আগে মানি লন্ডারিং মামলায় তারেক রহমানের প্রথম সাজা হয়। এরপর আরও চারটি মামলায় তার সাজা হয়েছে। বিদেশে থাকা অবস্থায় সবশেষ গত ২ আগস্ট দুর্নীতির মামলায় তার ৯ বছরের কারাদণ্ড হয়। একই মামলায় তারেক রহমানের স্ত্রী জোবায়দা রহমানকেও তিন বছর কারাদণ্ড দেওয়া হয়। মাত্র ১৬ কার্যদিবসে মামলাটি নিষ্পত্তি হয়।ঢাকার বিভিন্ন আদালতে গত আট মাসে ছয়টি মামলায় বিএনপি ও এর অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনের ৪৪ জন নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে রায় হয়েছে। তারা মূলত ঢাকা মহাগর, থানা ও ওয়ার্ড পর্যায়ের গুরুত্বপূর্ণ নেতাকর্মী। এর মধ্যে আট বছর আগে গুলশান এলাকায় বাসে আগুন দেওয়ার মামলায় গত বছরের ৩০ নভেম্বর ঢাকা মহানগর যুবদলের (উত্তর) আহ্বায়ক শরীফ উদ্দিনসহ (জুয়েল) তিন বিএনপি নেতাকে কারাদণ্ড দেন আদালত। ১০ বছর আগে সবুজবাগে ককটেল বিস্ফোরণসহ নাশকতার মামলায় গত ১৯ জুন বিএনপি নেতা, সাবেক ওয়ার্ড কাউন্সিলর হামিদুর রহমানসহ সাতজনের দুই বছর কারাদণ্ড দেন আদালত। আর ১০ বছর আগে মুগদা এলাকায় বাসে আগুন দেওয়ার অভিযোগে করা মামলায় গত ৩ এপ্রিল বিএনপির আরও সাত নেতাকর্মীর কারাদণ্ড দেন আদালত।

 

 

 

গত ৭ আগস্ট যুবদলের সাংগঠনিক সম্পাদক ইসহাক সরকারসহ ২১ জনের কারাদণ্ড দেন ঢাকার সিএমএম আদালত। ২০১৩ সালে কোতোয়ালি থানা সংলগ্ন এলাকায় গাড়ি ভাঙচুরের অভিযোগের মামলা ছিল এটি। গত ১৭ আগস্ট সজীব ওয়াজেদ জয়কে অপহরণ ও হত্যাচেষ্টার ষড়যন্ত্রের অভিযোগে করা মামলায় সাংবাদিক শফিক রেহমান, আমার দেশ-এর ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মাহমুদুর রহমান, জাসাস সহ-সভাপতি মোহাম্মদ উল্লাহসহ পাঁচজনের কারাদণ্ড দেন ঢাকার সিএমএম আদালত। সবশেষ গত ১৮ আগস্ট রমনা থানার একটি মামলায় আবুল কালাম আজাদ নামে একজন বিএনপি কর্মীকে সাজা দেন আদালত। গত ৭ সেপ্টেম্বর তিন শতাধিক মামলার আসামি ঢাকা মহানগর যুবদলের (উত্তর) সাবেক সভাপতি এস এম জাহাঙ্গীরকে হাজিরা শেষে আদালতের হাজতখানায় নিয়ে যায় পুলিশ।

 

 

 

এছাড়া, স্থায়ী কমিটির দুই সদস্য রফিকুল ইসলাম মিয়া, ইকবাল হাসান মাহমুদ ও ঢাকা মহানগর উত্তর বিএনপির আহ্বায়ক আমানউল্লাহ আমান এরই মধ্যে দণ্ডপ্রাপ্ত। ইকবাল হাসান মাহমুদের বিরুদ্ধ গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হয় সম্প্রতি।বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির আইনবিষয়ক সম্পাদক ব্যারিস্টার কায়সার কামাল বলেন, নির্বাচন কোন লেভেলে হচ্ছে বা হচ্ছে কি না বলা যাচ্ছে না। আমরা রাজপথে আছি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে। শেখ হাসিনা পদত্যাগ না করা পর্যন্ত বিএনপি কোনো নির্বাচনে অংশ নেবে না। বর্তমান সরকার চেষ্টা করছে এক পাক্ষিক নির্বাচন করার জন্য অর্থাৎ বিএনপিকে ছাড়া আগের মতো নির্বাচন করতে চায়। সে কারণে তারা নতুন আরেকটা ছল-চাতুরির আশ্রয় নিচ্ছে।তিনি বলেন, জরুরি অবস্থার সময়ে খালেদা জিয়া, বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানসহ বিএনপির যে সব নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে মামলা হয়, সেই মামলাগুলো এখন সচল হচ্ছে। অন্যদিকে, জরুরি অবস্থার সময় শেখ হাসিনাসহ আওয়ামী লীগের প্রত্যেক নেতার বিরুদ্ধে হওয়া মামলা কোয়াস বা বাতিল করা হয়েছে। মেরিট কিন্তু সেইম। যেমন নাইকো মামলায় খালেদা জিয়ার নামে কেস নম্বর ২০, আর ১৯ নম্বর কেসটি হলো প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার। ১৯ নম্বর মামলা হাইকোর্টে কোয়াস হয়ে গেছে। সেটার বিরুদ্ধে এখন পর্যন্ত আপিল করেনি দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। আগামী নির্বাচন একতরফা করার জন্য প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে সরাসরি হস্তক্ষেপের মাধ্যমে দুদককে ব্যবহার করে মামলার অভিযোগও করেন তিনি।কায়সার কামাল বলেন, আমরা পত্রপত্রিকার মাধ্যমে দেখলাম যে, পুলিশ সদর দপ্তর থেকেও পুরোনো মামলার সেল গঠন করা হয়েছে। সেই সেলের কাজটা কী, বিএনপির বিরুদ্ধে পুরোনো যে সব মামলা আছে সেগুলো কীভাবে দ্রুত সমাধান করা যায়। সেটা আরেকটা অপকৌশল। সরকার পুলিশ বাহিনীকে জনগণের মুখোমুখি দাঁড় করাচ্ছে। কারণ যে কাজ পুলিশের করার কথা না সে কাজ পুলিশ করছে বিরোধী দলকে দমন করার জন্য।

 

 

 

কায়সার কামাল আরও বলেন, ২০১৮ ও ২০১৪ সালের মতো নির্বাচন করার জন্য সরকার উঠে পড়ে লেগেছে এবং তারা একতরফাভাবে করার চেষ্টা চালাচ্ছে। বিএনপির মানবাধিকার কমিটির সদস্য সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার ফজলুল করিম মন্ডল  বলেন, গত ১৫ বছরে বিএনপি ও এর অঙ্গ সংগঠনের পাঁচ শতাধিক নেতাকর্মী গুম হন এবং হত্যার শিকার হন হাজার হাজার কর্মী। এসব ঘটনা বিচারের আওতায় আনা হয়নি। বিচারহীনতা এবং দুর্বল বিচার ব্যবস্থার কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, বিএনপি ও তার অঙ্গ সংগঠনের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে লাখ লাখ মামলা দায়ের করে তাদের গ্রেফতার ও হয়রানি করা হচ্ছে।তিনি আরও বলেন, আমরা বলছি পাঁচশ গুম কিন্তু প্রকৃত সংখ্যা আরও বেশি হবে। পাঁচ থেকে দশ জনের সংসারে একটি করে মামলা বা আসামি আছে বলেও জানান তিনি।

 

 

 

বিদেশি বিভিন্ন গণমাধ্যম ও দলের বরাত দিয়ে তিনি জানান, দলটির প্রায় ৫০ লাখ কর্মীর অর্ধেকই (প্রায় ২৫ লাখ) রাজনৈতিক মামলার শিকার। সবচেয়ে সক্রিয় নেতা ও সংগঠকরা ডজনখানেক বা তারও বেশি মামলার আসামি। মোটা দাগে এসব মামলায় আসামি ৩৬ লাখের বেশি। আর কারাগারে আটক ২০ হাজার। গত আগস্টে বিএনপির ধারাবাহিক আন্দোলন কর্মসূচি শুরু হওয়ার পর নতুন করে মামলা হয়েছে আরও কয়েক হাজার।এদিকে জামায়াত সমর্থিত সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সাবেক সহ-সভাপতি অ্যাডভোকেট মো. সাইফুর রহমান  বলেন, রাজনৈতিকভাবে জামায়াতের বিরুদ্ধে সরকার যে মামলাগুলো করেছে, যদি ২০১৩-১৪ সাল থেকে ক্রমবর্ধমান হিসাব করি, আমার মনে হয় দেশে যত রাজনৈতিক দল আছে, তারমধ্যে সবচেয়ে বেশি মামলা রয়েছে জামায়াত-শিবির নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে। এসব মামলা রাজনৈতিক প্রতিহিংসায় করা হয়েছে এবং ধারাবাহিকভাবে এগুলো তারা অব্যাহত রেখেছেন।

 

 

 

তিনি আরও বলেন, নির্বাচন ঘনিয়ে আসার কারণে যে কাজটি তারা করছে, আমরা যতটুকু জানতে পেরেছি, পেন্ডিং মামলাগুলোকে দ্রুত নিষ্পত্তি করছে, যাতে নেতাকর্মীরা নির্বাচনে কোনো কাঙ্ক্ষিত ভূমিকা না রাখতে পারেন। আমার মনে হয় রাজনৈতিক বিবেচনায় করা এসব মামলা প্রচলিত আইনের ভিত্তিতে কোনোটাই পরিচালিত হচ্ছে না।

 

 

 

বিএনপি ও জামায়াতের অভিযোগের বিষয়ে সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সম্পাদক অ্যাডভোকেট আব্দুন নুর দুলাল বলেন, যেকোনো অপরাধীর বিরুদ্ধে আইন তার নিজস্ব গতিতে চলছে। জননেত্রী শেখ হাসিনা বিচার বিভাগের লোক না, তিনি হচ্ছেন শাসন বিভাগের লোক। এখন বিচার বিভাগ স্বাধীন একটা অর্গান। বিচার বিভাগকে শাসন বিভাগ থেকে আলাদা করা হয়েছে অনেক আগেই। বিচার বিভাগের ওপর কারও নিয়ন্ত্রণ নেই। উনি (শেখ হাসিনা) তার বাবার বিচারে এমনকি যুদ্ধাপরাধীদের বিচারেও কোনো হস্তক্ষেপ করেননি।

 

 

 

তিনি বলেন, সমস্ত বিচার হয়েছে সাধারণ কোর্টে, ট্রায়াল থেকে শুরু করে আপিল, রিভিউ এবং রাষ্ট্রপতির কাছে ক্ষমা চাওয়া- সবকিছুতেই তারা সুযোগ-সুবিধা পেয়েছেন। সুতরাং রাজনৈতিক কারণে প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে কোনো মামলায় সাজা দেবেন সেই নেত্রী শেখ হাসিনা না। তিনি আইনের শাসনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল, বিচার বিভাগের প্রতি শ্রদ্ধাশীল, রাজনৈতিক কারণে কারও ওপর কোনো মামলা এবং নির্বাচনের আগে কোনো মামলা সামনে নিয়ে আসা হচ্ছে, এটা কখনোই ঠিক না। এটা কখনোই শেখ হাসিনার সরকার করবে না।এসব অভিযোগ অস্বীকার করে অ্যাটর্নি জেনারেল আবু মোহাম্মদ (এএম) আমিন উদ্দিন  বলেন, ‘যারা এটা বলছেন, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের নির্দেশে বিএনপি নেতাদের বিরুদ্ধে করা মামলা সচল হচ্ছে তারা সম্পূর্ণ ভুল বলছেন। আদালতের প্রতি, বিচার ব্যবস্থার প্রতি কোনো শ্রদ্ধাবোধ নেই তাদের। কারও কথায় বিচার বিভাগ চলে না। বাংলাদেশের বিচার বিভাগ সম্পূর্ণ স্বাধীন। ২০০৭, ২০০৮ এবং ২০১০ সালের মামলাগুলোর সব শুনানি শুরু হয়েছে তিন বছর আগে। মামলাগুলো কি সারাজীবন এভাবেই থাকবে, শুনানি করতে হবে ।