তাসীন আওয়ামী লীগের ভ্যানগার্ড হিসেবে পরিচিত ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন বাংলাদেশ ছাত্রলীগ। সংগঠনটিতে স্থিরতা ফিরছে না কোনোভাবেই। বছরের পর বছর যাচ্ছে, একের পর এক কমিটি পরিবর্তন হচ্ছে। কিন্তু কোনো কিছুতেই অস্থিরতা কাটছে না ঐতিহ্যবাহী এ সংগঠনে। বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে বহিষ্কার হন আগের কমিটির শোভন-রাব্বানি। এরপর দায়িত্বে আসেন জয়-লেখক। তাদের বিরুদ্ধে ‘বিবৃতিনির্ভর কমিটি গঠন’, কেন্দ্রীয় সংসদের সভা না ডাকাসহ নানান অভিযোগ ওঠে। তারই ধারাবাহিকতা যেন চলছে বর্তমান সংগঠনে। কেন্দ্রের সঙ্গে সংগঠনটির কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ ইউনিটের সম্পর্কের টানাপোড়েন চলছে কয়েক মাস ধরেই। শুরুতে এ টানাপোড়েন শীতল থাকলেও সেটি এখন প্রকাশ্যে এসেছে।যদিও কেন্দ্র বলছে, ছাত্রলীগের সব ইউনিটের সঙ্গে তাদের ‘খুব ভালো’, ‘ভ্রাতৃত্বের বন্ধন’ রয়েছে। কারও সঙ্গে মনোমালিন্য নেই। তবে ইউনিটগুলো বলছে ভিন্ন কথা। বিশেষ করে ১ সেপ্টেম্বর হওয়া ছাত্রলীগের ছাত্রসমাবেশ ঘিরে এ টানাপোড়েন আরও প্রকট হয়েছে। এতে ছাত্রলীগের অভ্যন্তরে বিশৃঙ্খলার শঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা।কেন্দ্রের সঙ্গে টানাপোড়েন চলতে থাকা ইউনিটগুলোর দাবি, কেন্দ্র সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে এসব ইউনিটের সঙ্গে কোনো সমন্বয় করে না, স্বেচ্ছাচারিতা, যোগ্যদের বাইরে পছন্দের ব্যক্তিদের সুবিধা দেওয়া ও প্রমোট করা হচ্ছে। ঢাকার ইউনিটগুলোতে বেশি হস্তক্ষেপ করছে কেন্দ্র। এছাড়া কেন্দ্রের বিরুদ্ধে তারা বিভিন্ন আর্থিক অসহযোগিতার কথাও তুলছেন।বাংলাদেশ ছাত্রলীগের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ইউনিট ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণ। এছাড়া ছাত্রলীগের ঢাকায় কিছু কলেজ ইউনিট রয়েছে। আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের গুরুত্বপূর্ণ কর্মসূচিতে লোকবল সরবরাহ করার মূল দায়িত্ব থাকে এসব ইউনিটের।
গত ১ সেপ্টেম্বরের ছাত্র সমাবেশের আগে ছাত্রলীগের পক্ষ থেকে বলা হয়, যে ইউনিট সবচেয়ে বেশি উপস্থিতি দেখাতে পারবে তাদের পুরস্কৃত করা হবে। কিন্তু সমাবেশের দিন কেন্দ্র সেটি করেনি। এছাড়া অন্য বছর ছাত্রলীগের এ ধরনের সমাবেশে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও ঢাকার দুই মহানগরের সভাপতি এবং সাধারণ সম্পাদকের বক্তব্যের সুযোগ দেওয়া হলেও এবার তা না দেওয়ায় কেন্দ্রের ওপর ক্ষুব্ধ তারা।এ বিষয়ে ঢাকা মহানগর দক্ষিণ শাখার সভাপতি রিয়াজ মাহমুদ জাগো নিউজকে বলেন, প্রধানমন্ত্রীর সামনে যাওয়া ও বক্তব্য রাখা আমাদের খুবই সৌভাগ্য ও আবেগের বিষয়। অন্য সময় যারা নেতৃত্বে ছিলেন তারা বক্তব্য রাখার সুযোগ পেয়েছিলেন। এবার আমরা বঞ্চিত হয়েছি। এছাড়া কেন্দ্রীয় সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক নেত্রীর সঙ্গে অনেকবার দেখা করলেও আমাদের দেখা করতে দেওয়া হয়নি। আমাদের পরম আবেগের, সম্মান ও ভালোবাসার ব্যক্তির কাছ থেকে বঞ্চিত হচ্ছি আমরা।
এদিকে ৬ সেপ্টেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি মাজহারুল কবির শয়নের ব্যক্তিগত ভেরিফায়েড ফেসবুক অ্যাকাউন্ট থেকে একটি পোস্ট করা হয়। সেই পোস্ট সামাজিক মাধ্যমে আলোচনার জন্ম দিয়েছে। সেটি শেয়ার করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সাধারণ সম্পাদক তানভীর হাসান সৈকত, ঢাকা মহানগর উত্তর শাখার সভাপতি রিযাজ মাহমুদ, সাধারণ সম্পাদক সাগর আহমেদ শামীম, দক্ষিণ শাখার সভাপতি রাজিবুল ইসলাম বাপ্পী, সাধারণ সম্পাদক সজল কুন্ডুসহ কেন্দ্র ও বিভিন্ন ইউনিটের অনেক নেতাকর্মী। পোস্টটিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগ সভাপতি তৃণমূলের নেতাকর্মীদের ত্যাগের কথা বর্ণনা করেন। এতে বর্তমান কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের ‘বিলাসবহুল’ জীবনযাপনের ইঙ্গিতও দেন তিনি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সভাপতি ওই পোস্টে লেখেন, ‘কেন্দ্রীয় কমিটির কাজ কেন্দ্রীয় বিষায়াদি সম্পাদন করা, সারাদেশের ইউনিটগুলোর মাঝে সমন্বয় সাধন করা, কর্মসূচি প্রণয়ন করা ও শৃঙ্খলা-গঠনতন্ত্রের রক্ষাকবচ হিসেবে কাজ করা। এর বাইরে ৩০০ জন কেন্দ্রীয় নেতা দ্বারা ব্যক্তিগতভাবে পাঁচজন কর্মী সংগঠন করা বর্তমান কাঠামোতে সম্ভব নয়। ছাত্রলীগের প্রাণ হলো তৃণমূল তথা বিভিন্ন ইউনিট, যারা মাত্র কয়েকদিন আগেই সম্মিলিতভাবে লাখো কর্মীর সমাগম করে দেখিয়েছে। এরাই সংগঠনের প্রাণ। এরা দামি ফ্ল্যাটে থাকে না, দামি গাড়িতে ঘোরে না, এরা নিজের পরিবারকে ঠকিয়ে, পেটে ক্ষুধা রেখে, টিউশনির টাকা জমিয়ে, ছেঁড়া স্যান্ডেল-ঘর্মাক্ত জামা পরে রাজপথে জীবন উৎসর্গ করার ব্রত নিয়ে সংগঠনকে টিকিয়ে রাখে।’
দ্বন্দ্ব আরও আগে থেকেই
বাংলাদেশ ছাত্রলীগের ৩০তম সম্মেলন হওয়ার পর কমিটির সবার মধ্যে ভালো সম্পর্ক দেখা গেলেও তা মাস না পেরুতেই দূরত্ব ও পরষ্পরবিরোধী অবস্থানে যায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক মুসলিম হল শাখার সভাপতি আনোয়ার হোসেন নাইমের রুম ভাঙচুর করা নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের অনুসারীদের বহিষ্কার করে কেন্দ্র। এতে বিশ্ববিদ্যালয় শাখার নেতৃত্ব ক্ষুব্ধ হয়। কিছুদিন পর শহীদুল্লাহ হলের সামনে একটি চাঁদাবাজির ঘটনায় ঢাবি ছাত্রলীগের কয়েকজন কর্মীকে আবারও বহিষ্কার করে কেন্দ্র। পরে বিশ্ববিদ্যালয় শাখার নেতারা একই অভিযোগে অমর একুশে হল শাখার সাধারণ সম্পাদককে অব্যাহতি দেন।আগস্ট মাসে ঢাকা মেডিকেলে দোকানের চাঁদাবাজি নিয়ে দুই গ্রুপের সংঘর্ষের ঘটনায় কেন্দ্রীয় সভাপতি সাদ্দাম হোসেনের কয়েকজন অনুসারীকে অব্যাহতি দেয় বিশ্ববিদ্যালয়।
জুলাই মাসে ছাত্রলীগের একটি কর্মসূচিতে বিশ্ববিদ্যালয় সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের বক্তব্যের পর কেন্দ্রীয় সংসদের সিনিয়র সহ-সভাপতি ও যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদকের বক্তব্য দেওয়ার কথা বললে ঢাবি শাখার সভাপতি তাৎক্ষণিক কেন্দ্রীয় সভাপতির সঙ্গে বাগবিতণ্ডায় জড়ান। পরে কেন্দ্র তাদের অবস্থান থেকে সরে আসে।
এদিকে ঢাকায় দুটি মহানগর শাখা থাকলেও সেখানে থাকা গুরুত্বপূর্ণ কলেজগুলো আছে কেন্দ্রের অধীনে। ফলে শাখাগুলোর পক্ষে নিয়মিত শিক্ষার্থীদের নিয়ে প্রোগ্রাম করা কঠিন হয়ে পড়ে। কলেজগুলো মহানগরের নিয়ন্ত্রণে দেওয়াসহ কয়েকটি অভ্যন্তরীণ কাজে কেন্দ্রীয় সংসদের সঙ্গে তাদের মনোমালিন্য ও দূরত্ব তৈরি হয়। সর্বশেষ ঢাবি ছাত্রলীগ সভাপতির ফেসবুক পোস্ট নিয়ে তারা সবাই এক। তারা তাদের দাবি নিয়ে আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের সঙ্গে বসবেন বলেও জানিয়েছেন।
হঠাৎ জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় শাখাকে প্রাধান্য দেওয়া নিয়ে প্রশ্ন
কমিটি ঘোষণার ছয় মাস না পেরুতেই বিতর্কিত ঘটনার শিরোনাম হয় জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় (জবি) ছাত্রলীগ। গত বছর ১ জানুয়ারি ঘোষণা করা কমিটি একই বছরের ১ জুলাই স্থগিত করে কেন্দ্র। আবার একই বছরের ৫ ডিসেম্বর সে কমিটি পুনর্বহাল করে কেন্দ্র। এটি ঘটে ৩০তম সম্মেলনের আগের দিন। এ কমিটির বিরুদ্ধে চাঁদাবাজি, মারধর, হামলাসহ নানান অভিযোগ ছিল। কিন্তু তাদেরই ১ সেপ্টেম্বর সমাবেশে প্রধানমন্ত্রীর কাছে বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতি তুলে দেওয়ার সুযোগ দেন ছাত্রলীগের বর্তমান সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক। এতে বঞ্চিত হয় রাজশাহী, জাহাঙ্গীরনগর, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়সহ ছাত্রলীগের অনেক ঐতিহ্যবাহী ইউনিট।
বঞ্চিতরা বলছেন, এসব ইউনিটের সংগঠনে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের চেয়ে অতীতে ত্যাগের অনেক ইতিহাস রয়েছে। এমনকি ছাত্রসমাবেশে জবি শাখার চেয়ে অনেক শাখার উপস্থিতিও বেশি ছিল।এ বিষয়ে কথা বলতে চাইলে ইউনিটগুলোর নেতারা আনুষ্ঠানিক বক্তব্য দিতে রাজি হননি। তবে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো তারাও সে সুযোগটি চান বলে জানান।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক শেখ ওয়ালী আসিফ ইনান বলেন, আমরা সব ইউনিটকেই আমাদের সবার আবেগের জায়গা প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করার সুযোগ করে দিতে চাই। এবার জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় শাখা দেখা করার সুযোগ হলেও পরেরবার ক্রমান্বয়ে বাকিদের সুযোগ করে দেওয়ার চেষ্টা করবো।সামগ্রিক বিষয়ে ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক শেখ ওয়ালী আসিফ ইনান বলেন, বাংলাদেশ ছাত্রলীগ অনেক বড় একটি সংগঠন। আমাদের সব ইউনিটের সঙ্গে সুসম্পর্ক রয়েছে। কারও হয়তো মান অভিমানের জায়গা থাকতে পারে। আমরা সেগুলো মিটিয়ে ফেলার চেষ্টা করবো। কারও সঙ্গে আমাদের কোনো দূরত্ব কিংবা মনোমালিন্য নেই। আমরা এক হয়ে কাজ করছি এবং করবো।