ইসলাম ধর্মে নারীদের স্থান পুরুষের নিচে- এমন প্রাচীন ধ্যান-ধারণার বিলুপ্ত করে নারী-পুরুষের সমমর্যাদা প্রতিষ্ঠা করেন কামাল আতাতুর্ক। "স্বাধীনতার আগে তুরস্ক ছিল খেলাফতের অধীন একটি ধর্মীয় গোঁড়া রাষ্ট্র। জনগণ ছিল ধর্মান্ধ। তাদের মধ্যে মানবিক মূল্যবোধ এবং আধুনিক চেতনার অস্তিত্ব ছিল না।সেই তুরস্ককে একটি আদর্শ রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তুলতে গিয়ে কতটা ডিক্টেটর হয়ে উঠেছিলেন সেই দিকটার সঙ্গে পাঠকের পরিচয় করিয়ে দিতে চাই। মোস্তফা কামাল আতাতুর্কের রাজনীতির মৌলিক নীতি ছিল তুরস্কের পরিপূর্ণ স্বাধীনতা। বঙ্গবন্ধুও বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের পর মৌলিক নীতি ধার্য করেছিলে, চারটি আদর্শের ওপর। অর্থাৎ জাতীয়তাবাদ, ধর্মনিরপেক্ষতা, সমাজতন্ত্র ও গণতন্ত্রের ওপর। স্বাধীনতাত্তোর বঙ্গবন্ধুর উদারনৈতিক মনোভাবের সুযোগ নিয়ে দেশ বিদেশের ষড়যন্ত্রকারীরা বাংলাদেশ বিনির্মানের যুৎসই পরিকল্পনাগুলোকে অঙ্কুরেই বিনষ্ট করে দিতে তৎপর হয়ে উঠেছিলো। শেখ মুজিবুর রহমানের দ্বিতীয় বিপ্লবের কর্মসূচি রুখে দেয়ার একমাত্র পথই ছিলো তাঁকে হত্যা। আর সেই কঠিন উচ্চারণটিই আমরা খুনী মোশতাকের রাষ্ট্রপতির ভাষণে দেখতে পাই। তিনি নিজেই বলেন, শেখ মুজিবকে হত্যা ছাড়া অন্য কোন পথ সামনে খোলা ছিলো না তাই সেনাবাহিনী কতিপয় সূর্য সন্তান এগিয়ে এসেছেন এবং আমার ওপর দায়িত্ব ন্যস্ত করেছেন।"
বঙ্গবন্ধু হত্যাত্তোর মৌলবাদের যে উত্থান ঘটে তার রাশ টেনে ধরা খুব সহজ কাজ ছিলো না। যে কারণে একুশ বছর পর প্রথম মেয়াদে ক্ষমতায় আসলেও এ বিষয়ে সরকারের অবস্থানে নিরুত্তাপই লক্ষ্য করা যায়। "স্থান কাল পাত্র " নীতিতেই অগ্রসর হতে হয় শেখ হাসিনাকে। শেখ হাসিনার একুশ বছর পর ক্ষমতায় আসার মূলে শুধু রাজনৈতিক আন্দোলন সংগ্রাম অর্থাৎ ভোট ও ভাতের আন্দোলন কাজ করেছে ভাবলে মস্তবড় একটা ভুল হবে। ওই ক্ষমতায় আসার মূলে বিশাল ভুমিকা রেখেছিলো, বিরাট এক সাংস্কৃতিক আন্দোলন। মৌলবাদ বিরোধী সংগ্রাম। শহীদ জননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বাধীন
ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির আন্দোলন সর্বোপরি
গণআদালতে গোলাম আযমের ফাঁসির রায় মৌলবাদের বিরুদ্ধে নতুন প্রজন্মের একটি জাগরণ পরিলক্ষিত হয়েছিলো। ২০০৮ সালের নির্বাচনে মহাজোটের বিজয়ের পর যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের যে ক্ষেত্র তৈরি হয়েছিলো, তার আরেকটা বিরাট প্রমাণ যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দন্ডিত কাদের মোল্লার ফাঁসির দাবিতেশাহবাগে গণজাগরণ মঞ্চের অভ্যুদয়। পরবর্তীতে হেফাজতের উত্থান এবং নিমিষেই পতনের মূলেও সাংস্কৃতিক আন্দোলনের ফলশ্রুতি। বিদ্যমান পরিস্থিতিতেও সেই সাংস্কৃতিক আন্দোলনের বড় বেশি প্রয়োজন। রাজনৈতিক আন্দোলনের প্রতি প্রজন্মের বিশেষ করে ছাত্রতরুণদের ঐকান্তিক মোহ কাজ করে। যা মূলত মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও স্বাধীনতার মূল্যবোধ থেকেই উদ্ভূত। আগামী নির্বাচনকে সামনে রেখে মৌলবাদের থাবা গোটা জাতিকে অস্থির করে তুলবে এতে কোন সন্দেহ নেই। রাষ্ট্র ক্ষমতার প্রতিপক্ষ অবশ্যই একটি নেতৃত্ব শূন্যতার উপলব্ধি করছে। করাটাই স্বাভাবিক। এ প্রসঙ্গে একটু পরে আলোকপাত করবো। তার আগে তুরস্কের স্বাধীনতাত্তোর মৌলবাদ দমনের কিছু ঘটনার উদ্ধৃত করবো।
তুরস্কের রাষ্ট্রপ্রধানের মসনদে বসেই কামাল আতাতুর্ক স্বদেশে নারীদের বাধ্যতামূলক বোরকা প্রথা বিলুপ্তি করে বলেছিলেন, 'আমি লিঙ্গ বৈষম্য স্বীকার করি না, সমাজের উন্নয়নের জন্য উভয়ের অংশগ্রহণ ও অবদান একান্ত অনস্বীকার্য।"
কামাল আতাতুর্ক তুরস্কের জাতির পিতা তারপরও এ সিদ্ধান্তকে তাঁর বন্ধুরাও মনে করেছিল, এটি একটি আত্মঘাতি ফর্মুলা, যা আতাতুর্কের বিনাশ করবে। এ ধারনা কল্পনাপ্রসূত ছিলো না, কেননা, কামাল আতাতুর্ক যেখানে হাত বাড়িয়েছিলেন, সেখানেই পেয়েছিলেন অন্ধকারের জীব মৌলবাদীদের বিরোধিতা।
কিন্তু সেই কুসংস্কার, নৃশংসতা ও গোঁড়ামীর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়ে নিজেকে পৌঁছে দিয়েছিলেন, আধুনিকায়নের মহারথের নির্বান স্বর্গে।
তুরস্কের সঙ্গে বাংলাদেশের মিল অমিলগুলো মাঝেমধ্যে আমার হ্রদপিন্ডে ঝড় তোলে। তুরস্কের জাতির পিতার ন্যায় বাংলাদেশের জাতির পিতাও যেখানে হাত বাড়িয়েছিলেন, সেখানেই পেয়েছিলেন মৌলবাদীদের বিরোধিতা। মৌলবাদের রক্ষক ভক্ষকরা স্বাধীনতা বিরোধী হিসাবে পরিত্যক্ত ঘোষিত হলেও মাত্র সাড়ে তিন বছরের ব্যবধানে অর্থাৎ বঙ্গবন্ধু হত্যার পরক্ষণেই আওয়ামী লীগ নেতৃত্বের হাতেই মৌলবাদের প্রকাশ্য উত্থান লক্ষ্য করা যায়। পুর্নাঙ্গ খোলসটি খোলে জেনারেল জিয়াউর রহমানের উত্থান ঘটার সঙ্গে সঙ্গে।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশ বিনির্মানের সংস্কার কাজে অভীষ্ট লক্ষ্য অর্জনের জন্য মৌলবাদীদের শক্তহাতে দমন করলে শেখ হাসিনাকে চারদশকের মাথায় যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করার প্রয়োজন পড়তো না। বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার দেশ বিদেশের সমালোচনার মুখে পড়ে কামাল আতাতুর্কের ভাষায় বলতেই পারেন যে, "এসব অসুর দমন না করে বাংলাদেশকে সুন্দর সমৃদ্ধশালী করবার কোন বিকল্প ছিল না।"
এর প্রতিক্রিয়া হেফাজতের তান্ডবে, চাঁদে কিংবা ভুমিকম্পে জোরজবরিমূলজ লক্ষ্য করানোর অপচেষ্টা প্রতীয়মান হলেও বাস্তবিক প্রতিক্রিয়া আমরা এখনো দেখতে পাইনি। তবে প্রতিক্রিয়া তীব্রতা কতটা ভয়াবহ হতে পারে তা, মৌলবাদী ধর্মান্ধ গোষ্ঠীর হুঙ্কারে নয়, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক কিংবা দলটির শীর্ষ নেতারা যখন বলেন, বিএনপি ক্ষমতায় এলে দেশে রক্তের গঙ্গা বা স্রোত বয়ে যাবে, তখন সাধারণ জনগণ আমরা উদ্ধিগ্ন বা উৎকন্ঠিত না হয়ে পারি না। ক্ষমতাসীন নেতাদের বক্তব্য প্রতীয়মান হয় যে, নিজামী-মুজাহীদ-কাশেম-কাদের মোল্লা আর সাকা চৌধুরীসহ শীর্ষস্থানীয় নেতৃবর্গের ফাঁসি কার্যকর হলেও মৌলবাদের লেলিহান শিখা নিভেনি বরং তাদের সমর্থক গোষ্ঠীর মনে দাউদাউ করে জ্বলছে। তারা ক্ষমতার পালাবদলের অপেক্ষার প্রহর গুনছে।
কামাল আতাতুর্কের স্বাধীনত্তোর একেকটি কথা সেদেশের জনগণের জন্য একেকটি দর্শন। যেমন তিনি বলেছেন, মানুষের পশুবৃত্তিকে ধ্বংস করে নানন্দিক সৌকর্ষে ঋদ্ধ করার ক্ষেত্রে সংস্কৃতির কোন বিকল্প নেই। সংস্কৃতিই সংস্কারের বাহন। "
আমাদের নাট্যকার ও অভিনেতা মামুনুর রশীদের ভাষায় এদেশে রুচির দুর্ভিক্ষ চলছে। এই মন্তব্যের একতরফা প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করা যায়নি - পাল্টা আক্রমনাত্মক প্রতিক্রিয়ায় করেছেন অনেকে। এর অর্থ হচ্ছে রুচির দুর্ভিক্ষের মূল উৎপাটন করা সহজ নয়। মামুনুর রশীদ হয়তো মন্তব্যটি করার আগে ভুলে গিয়েছিলেন যে, নাট্যাভিনেতা সাদেক বাচ্চুর মতো অনেকেই হিরো আলমের ছবিতে অভিনয় করেছেন। আমাদের মহামান্য সস্ত্রীক প্রেক্ষাগৃহে গিয়ে ছবি দেখে যে দেশসেরা নায়ক সাকিব খানকে বুকে জড়িয়ে কোলাকুলি করেছেন, সেই সাকিব খানের সঙ্গেও হিরো আলমের ছবি দর্শকরা হজম করেছে। সাকিব খানের ফেইসবুক পেইজে মহামান্যের সঙ্গে তার ছবি দেখে আমার মনে হয়ে ছিলো, এটি নিশ্চয়ই ঈদ উৎসবের কোন কোলাকুলির ছবি।
সংস্কৃতিকে আদর্শ যে একটি জাতিগঠনে অপরিহার্য উপাদান, তা কামাল আতাতুর্কের মতো বঙ্গবন্ধুও আপাদমস্তক বিশ্বাস করতেন। কিন্তু দেশ ও জাতিগঠনের দায়িত্বটি শুধুই রাষ্ট্রনায়ক কিংবা রাজনীতিবিদদের দায়িত্ব নয়। দেশের ভেতরে ও বাইরে স্ব স্ব ক্ষেত্রে অবদান রাখা দেশবরেণ্য কিংবা বিশ্ববরেণ্য ব্যক্তিদেরও একটি নৈতিক দায়িত্বই শুধু নয়, দেশপ্রেমিক নাগরিক হিসেবেও কর্তব্য। একটি দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের প্রতি ভিন দেশেরও যে শ্রদ্ধা ভক্তি প্রদর্শন একটি শিষ্টাচার, সেটা আমাদের মর্মমূলেই উপলব্ধ। এটিও একটি সাংস্কৃতিক সভ্যতা। যা যুগযুগ ধরে প্রতিপালিত হয়ে আসছে।
কিন্তু যখন আমরা দেখতে পাই, শান্তিতে নোবেল বিজয়ী ডঃ মোহাম্মদ ইউনুস সেই সাংস্কৃতিক সৌহার্দ্য নিজের দেশের প্রতিই প্রদর্শন করা থেকে বিরত থাকেন, তখন, স্বাধীনতা বিরোধী অপসংস্কৃতির ধারক বাহকরা - তাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখতেই পারেন যে, এই দেশে তাদের দলে গোষ্ঠীতে নেতা শূন্যতার বাস্তবতাটি সত্যাসত্য একটি বাস্তবতা। তা দূরীভূতকরণের জন্য ডঃ ইউনুস হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হতে পারেন। যদি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বদৌলতে সম্ভব হয়।
কারো আমলে আছে কিনা, জানিনা। ডঃ ইউনুস নোবেল প্রাইজ লাভের খবরে আমার কর্মস্থলে আনন্দের বন্যা বয়ে গিয়েছিলো। সে সময়ের সাড়াজাগানো দৈনিক বাংলাবাজার পত্রিকা ব্যানার লিড করেছিল। আনন্দে গা ভাসিয়ে আমিই লিখেছিলাম সেই লিড স্টোরিটি। কিন্তু পরক্ষণে বিষয়টি আমলে না নিলেও বিভিন্ন দুর্যোগ সংকটকালীন ডঃ ইউনুসের নিস্প্রভ ভুমিকা আমাকে দারুণ একটি প্রশ্নে জিজ্ঞাসু করে তোলে। তার সম্মুখীন হয়েই একটি প্রশ্ন করতে ইচ্ছে করে যে, হে মহান নোবেল বিজয়ী বিশ্ববরেণ্য ডঃ মুহাম্মদ ইউনুস, আপনি পৃথিবীর সবচেয়ে বড় পুরস্কারটি পাওয়ার পরও কেন বাংলাদেশের জাতীয় স্মৃতিসৌধে ও কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে একটিবার পদধূলি দিলেন না? প্রথমটির সঙ্গে জড়িয়ে আছে ত্রিশ লাখ শহীদের রক্ত আর আড়াই লাখ মা-বোনের সম্ভ্রম আর দ্বিতীয়টির সঙ্গে জড়িয়ে আছে, সালাম, বরকত,রফিক, জব্বারের রক্ত - ভাষা শহীদদের রক্ত। নিশ্চয়ই নোবেল বিজয়ী ডঃ ইউনুস আপনি মায়ের গর্ভ হতে ভুমিষ্ঠ হওয়ার পর প্রথম মুখে যে শব্দটি উচ্চারণ করেছিলেন, সেটি নিশ্চয়ই 'মা"? যা আপনার মায়ের ভাষা। আর বাংলাদেশটাও আপনার মাতৃভূমি। যাহোক, আপনার
মাতৃভাষার প্রয়োজন পড়েনা। নোবেল অনুষ্ঠানের বক্তৃতায় দিব্যি ইংরেজিতেই বলেছেন। বঙ্গবন্ধুকে কখনও ধারণ দূরে থাক স্মরণও করেননি। আপনি কখনও বাংলাপ্রীতি দেখাতে চাইবেনও না, যেমনটি বঙ্গবন্ধুর সব প্রথা ভেঙে জাতিসংঘে বাংলা ভাষায় বক্তৃতা করে বাঙালীকে আলোড়িত করেছিলেন। ওয়ান ইলেভেনের নায়ক আমাদের সাবেক সমর নায়ক মঈন ইউ আহমেদ তার আত্মকথনে লিখেছেন, ফখরুদ্দীনের আগে আপনাকেই প্রধান উপদেষ্টা হওয়ার জন্য প্রস্তাব করা হয়েছিলো। আপনি সে সময়ে একটি দল গঠনের প্রক্রিয়ায় অপ্রকাশ্যে যুক্ত ছিলেন বলে সম্মত হননি। যাহোক বাংলাদেশের উত্তপ্ত রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে আবারও আপনার নামটি উচ্চারিত হচ্ছে। উৎসুকের অভাব নেই। মার্কিন মুল্লুকের দৌড়ে আপনিই সর্বসর্বা এতে কোন সন্দেহও নেই। কিন্তু বাংলাদেশের প্রশ্নে যে মার্কিন মুল্লুকই শেষ কথা নয়, সেটা আপনার বোঝার মতো সক্ষমতা নেই, এটা আমি অন্তত বিশ্বাস করতে চাই না। আমার কথা শুনে এক উৎসুক সচেতন রাজনৈতিক পর্যবেক্ষণ আশরাফ খান গতকল্য বলছিলো, "ডঃ মুহাম্মদ ইউনুস প্রধানমন্ত্রী হলে নিশ্চয়ই স্মৃতিসৌধ ও শহীদ মিনারে শহীদদের শ্রদ্ধা প্রদর্শন করতে যাবেন- কী বলেন ভাই?" এমন প্রশ্নের জবাব আমি দেয়ার আগেই পাশে বসা এক জুনিয়র ব্যাংকার সৌমিত্র চৌধুরী বলে উঠলেন, "আরে ভাই স্মৃতি সৌধে তো নিজামী-মোজাহীদ জাতীয় পতাকা উড়িয়েই গিয়েছিলেন।" হাহাহা করে হাসিয়া দারুণ মজা নিলো শহীদুল ইসলাম নামীয় এক টগবগে তরুণ।
স্বাধীনতা বিরোধী প্রসঙ্গটির অবতারণা আবার এসে গেলো। প্রকৃতপক্ষে স্বাধীনতা আমরা অর্জন করলেও আজো সাংস্কৃতিক মুক্তির সংগ্রামে সফল হতে পারেনি।
ইতিহাস গবেষণা করতে গিয়ে আমার চোখের সামনে তুরস্কের সাংস্কৃতিক সংগ্রামের প্রেক্ষিত জ্বলজ্বল করে ভেসে উঠছে। মনে হচ্ছে তুরস্কের স্বাধীনতাত্তোর অবস্থাটাই আমাদের বাংলাদেশে বিরাজ করছে। বঙ্গবন্ধু কন্যা এ মুক্তি সংগ্রামের পথে অনেক অসম্ভবকে সাধন করে ফেলেছেন। কিন্তু সামনে চূড়ান্ত একটি শথ পরিক্রমায় উত্তীর্ণ হতেই হবে। নিজেকে অবতীর্ণ করতে হবে তুরস্কের কামাল আতাতুর্কের প্রাকৃতমনস্ক চিন্তাধারায়।
১৯২৩ সালের ২৯ অক্টোবর তুরস্কের স্বাধীন রাষ্ট্র অভ্যুদয় ঘটে।
দেশের পূর্বতন কুসংস্কারমূলক ব্যবস্থা আমূল পরিবর্তন করতে হলে একদলীয় শাসন ছাড়া বিকল্প কোন পথ কামাল আতাতুর্কের সামনে ছিল না।
রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়েই কতগুলো স্পর্শকাতর সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে তা কঠোরভাবে বাস্তবায়ন করেন। ধর্মীয় লেবাস পড়ে লোকেরা জনগণের মনে ধর্মীয় উন্মাদনা সৃষ্টির চেষ্টা করছিল, তার বিরুদ্ধে ১৯২৩ সালে তিনি পোশাক পরিবর্তন সম্পর্কিত আইন জারি করলেন। ১৯২৫ সালে টুপি আইন প্রনয়ণ করে ফেজ টুপির পরিবর্তে পশ্চিমা ধাঁচের টুপি প্রচলন করলেন। পোশাক নিষিদ্ধকরণ আইন ১৯৩৪ এর মাধ্যমে ধর্মভিত্তিক পোশাক তথা ঘোমটা ও টারবানের পরিবর্তে স্যুটের প্রচলন করেন। ছাত্রছাত্রীদের জন্যও প্রাচীন কষ্টকর পোশাকের পরিবর্তে প্রচলন করলেন আধুনিক পোশাক। ১৯২৫ সালে তুরস্কের সবচেয়ে রক্ষনশীল এলাকা কাস্তামনুতে এক জনসভায় পানামা হ্যাট পরিধান করে বক্তৃতা করেন। খেলাফত যুগের অবৈজ্ঞানিক ও কষ্টকর পোশাক ছুঁড়ে দিয়ে প্রবর্তন করেন নতুন ধাঁচের পোশাক। কামাল আতাতুর্ক সেই দশকের প্রেক্ষাপট বিবেচনায় নারীদের আধুনিক ও নতুন পোশাকে তাদের ইচ্ছা অনুসারে সজ্জিত হবার ধারণায় বিশ্বাসী ছিলেন। নিজের স্ত্রী লতিফি উসাকলিগিল ইসলামিক প্রথা অনুযায়ী তাঁর মস্তক আবৃত রাখলেও হিজাব ফেলে দেন। স্ত্রী বিভিন্ন অনুষ্ঠানে নারীদের জন্য নির্ধারিত আধুনিক পোশাকে সজ্জিত হয়ে ছবি তুলতেন। পরবর্তীতে আতাতুর্কের পালিত কন্যা সাবিহা গোকেন ও আফেত ইনানের পোশাক পরিচ্ছদ ও চালচলন আধুনিক তুরস্কের নারীদের অনুসরণীয় আদর্শ হয়ে ওঠে। নারীদের সামাজিক মর্যাদা প্রতিষ্ঠা ও ক্ষমতায়নের ক্ষেত্রে কামাল আতাতুর্কের উদ্যোগ ও সফলতা ছিল ঈর্ষনীয়। সমাজের সর্বস্তরে যাবতীয় অধিকার সুসংহত করে নারীদের প্রকৃত মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করেন। সুইস মানবাধিকার নীতির অনুসরণে দেওয়ানি কার্যবিধি প্রণয়ন করে নারী-পুরুষের বৈষম্য দূর করা হয়।
১৯২৬ সালের মার্চে ইতালিয়ান দণ্ডবিধি অনুসরণে তুর্কী দণ্ডবিধি আইন পাশ করা হয়। ওই বছরের ৪ অক্টোবর থেকে ইসলামি আদালত বন্ধ করে ইসলামি কানুন আইনের পরিবর্তে সুইস দেওয়ানি কার্যবিধি অনুসরণে ধর্মনিরপেক্ষ দেওয়ানি আইন প্রচলন করেন কামাল আতাতুর্ক।
১৯৩০ সালে কামাল আতাতুর্ক একটি গণতান্ত্রিক আন্দোলনের সূচনা করতে মোল্লাতন্ত্রমুক্ত একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাজনৈতিক দল রিপাবলিকান পার্টি প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নিলে কুসংস্কার জগতের প্রাচীন দলগুলো ধর্মীয় অনুভূতির আড়ালে প্রচণ্ড বিরোধিতা শুরু করে। মৌলবাদীরা ইসলাম গেল - গেল চিৎকারে রীতিমতো বিদ্রোহ শুরু করে। তারা সর্বস্তরে শরিয়াহ আইন প্রচলনের দাবি তুলে। সংস্কার কাজে অভীষ্ট লক্ষ্য অর্জনে বিরোধীদের কামাল আতাতুর্ক শক্ত হাতে তখন দমন করতে কুণ্ঠিত হননি। তিনি মনে করতেন অনেকে সমালোচনা করলেও অসুর দমন না করে তুরস্ককে সুন্দর ও সমৃদ্ধশালী করার কোন বিকল্প নেই। আরবি ও পার্সি পড়তো পারতো দশভাগ লোক। ১৯৩১ সালে তিনি তুর্কী ভাষা এসোসিয়েশন প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৩৩ সালে ইস্তাম্বুল ইউনিভার্সিটিকে আধুনিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে রূপান্তর আদেশ জারি করেন। রাজধানীতে প্রতিষ্ঠা করেন আঙ্কারা ইউনিভার্সিটি। আধুনিক সাহিত্য, সংস্কৃতি, বিজ্ঞানের বিভিন্ন ক্ষেত্রে এতোই ঋদ্ধ করে গড়ে তোলা হয় যে, তুরস্ক সত্যিকার অর্থেই আধুনিক হয়ে ওঠার পথ খুঁজে পায়।
আতাতুর্ক সংস্কৃতিকে একটি আদর্শ জাতি গঠনে অপরিহার্য উপাদান বলে মনে করতেন। তাঁর ভাষায় -"Culture is the foundation of the Turkish Republic." মোট কথা তিনি বিশ্বাস করতেন, সংস্কৃতি সংস্কারের বাহন। মানুষের পশুবৃত্তিকে ধ্বংস করে নান্দনিক সৌকর্যে ঋদ্ধ করতে সংস্কৃতির কোন বিকল্প নেই। তুরস্কের ইতিহাস ও ঐতিহ্যকে তুলে ধরে জাতিকে গৌরবময় ও উদ্বুদ্ধ করার জন্য আদনার সাইগানকে দিয়ে ওজসয় (Ozsoy) লেখান এবং সেমিহা বারকোসিকে দিয়ে তুরস্কের ইতিহাসের প্রথম অপেরা আঙ্কারা হাউজে প্রদর্শন করেন। ক্লাসিকাল ওয়েস্টার্ন মিউজিক, অপেরা, থিয়েটার, নাট্যশালা গড়ে তোলেন তুরস্কের আনাচে-কানাচেতে। দেশীয় নৃত্যের উন্নয়নে বিশেষ ভুমিকা রাখেন। কামাল আতাতুর্কের মধ্যে কোন দ্বৈততা বা লুকোচুরি কিংবা প্রতারণা ছিল না। তিনি যা বিশ্বাস করতেন তাই বলতেন, আর যা বলতেন তাই করতেন। এ বিশ্বাস প্রতিষ্ঠার জন্য নিজের সমস্ত শক্তি প্রয়োগ করতেন। তিনি কোরআনকে তুর্কী ভাষায় অনুবাদ করে ১৯৩২ সালে জনসমক্ষে পাঠ করেন।
কামাল আতাতুর্ক ছিলেন কুসংস্কারের উর্ধ্বে মানবিক মূল্যবোধ ও বাস্তবতার নিরিখে প্রজ্জ্বলিত একজন বিশ্ব মানব। তাঁর ভাষায়, দেশ ও বিশ্ব উভয়ের শান্তিই প্রকৃত শান্তি। ১৯৩৮ সালে Yalova ভ্রমণকালে আতাতুর্ক অসুস্থ হয়ে পড়েন। লিভার সিরোসিস ধরা পড়ে। ইস্তাম্বুলে নেয়া হয় তাঁকে। ১৯৩৮ সালের ১০ নভেম্বর মাত্র ৫৭ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন তিনি। আঙ্কারার এথনোগ্রাফি মিউজিয়ামে সমাহিত করা হয় তাঁকে। তাঁর সকল স্থাবর অস্থাবর সম্পত্তি রিপাবলিকান পার্টির অনুকূলে দান করে যান। আতাতুর্কের নাম ও ছবি তুরস্কের সর্বত্র স্থাপিত। তুরস্কের সকল ব্যাংক নোটে ( মুদ্রা) জাতির পিতা হিসেবে কামাল আতাতুর্কের ছবি রয়েছে। স্কুল কলেজ অফিস আদালতে তাঁর ছবিই প্রদর্শিত। অধিকাংশ ইস্তাম্বুলসহ তুরস্কের বিভিন্ন শহরে বিশালাকৃতির আতাতুর্ক স্টাচুগুলো নেতার স্মৃতিকে প্রোজ্জ্বল করে তুলে। ১৯৮১ সালে তুরস্ক পার্লামেন্ট কামাল আতাতুর্কের স্মৃতি বা অনুরূপ কোন কিছুকে অপমান বা অবহেলা প্রদর্শনকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। ১৯৮১ সাল ছিল আতাতুর্কের জন্মশতবর্ষ। তুরস্ক মহাসমারোহে পালিত হয়। জাতিসংঘ ও ইউনেস্কো আতাতুর্ক বর্ষ ঘোষণা করে তাঁর জন্মশত বার্ষিকীর উপর রেজুলেশন গ্রহণ করে। নিউজিল্যান্ডের ওয়েলিংটনে আতাতুর্ক মেমোরিয়াল, অস্ট্রেলিয়ার রাজধানী ক্যানবেরাতেও অনুরূপ মেমোরিয়াল রয়েছে। ইসরায়েলে আতাতুর্ক ফরেস্ট, ইতালির রোমে আতাতুর্ক স্কোয়ার। ভারতের নয়া দিল্লি ও পাকিস্তানের ইসলামাবাদ ও বাংলাদেশের ঢাকায় কামাল আতাতুর্ক এভিনিউ রয়েছে। লন্ডনের বিখ্যাত মাদার তুসো মিউজিয়ামে কামাল আতাতুর্কের স্টাচু রয়েছে।
ইস্তাম্বুল আতাতুর্ক আন্তর্জাতিক বিমান বন্দর শুধু নয়, গোল্ডেন হর্ণের আতাতুর্ক সেতু, আতাতুর্ক ড্যাম, আতাতুর্ক স্টেডিয়াম এবং তাঁর জৌলসময় সমাধি অনিতকবির (Anitkabir) কামাল আতাতুর্ককে প্রত্যহ স্মরণের মনিকোঠা হতে প্রকাশে নিয়ে আসে। ১৯৮১ সালে তুরস্কের জাতির পিতা আতাতুর্কের জন্মশতবর্ষ উদযাপিত হয়েছিল। আর আমাদের স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবর্ষ উদযাপিত হয় ২০২১ সালে।
স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী আর মুজিব শতবর্ষ একই সময় আবির্ভূত হয়েছিলো। তখন উচ্ছ্বাস উদ্দীপনায় একটি ভিন্ন মাত্রা যোগ করেছিল। করোনার কারণে বিশ্বনেতৃবৃন্দের সমাগম না ঘটলেও বিখ্যাত সব রাষ্ট্রনায়কদের স্বাগতমূলক বানী আমাদের সুমহান মর্যাদাকে আরও প্রোজ্জ্বল করেছিলো। ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সফর ঠেকাতে না পারলেও মৌলবাদীরা দেশের বিভিন্ন স্থানে যে তাণ্ডব ও সন্ত্রাস চালিয়েছে তা বিশ্ববাসীর কাছে আমাদের দেশের ভাবমূর্তিকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। তখন প্রাণ চলে যায় অনেকের। ওদের হাত থেকে রেহাই পায়নি সংবাদকর্মীরা এমনকি বহনকারী যানবাহনও।
তুরস্কের মতো বাংলাদেশও একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র।
কুসংস্কার, ধর্মীয় গোঁড়ামী, মানবাধিকার বিরোধী কর্মকাণ্ড, প্রাগৈতিহাসিক আইন ইত্যাদি সম্পূর্ণ দূরীভূত করে বাংলাদেশকেও আধুনিক, গণতান্ত্রিক এবং ধর্মনিরপেক্ষ জাতীয়তাবাদী রাষ্ট্রে পরিণত করতে হবে। এক্ষেত্রে কামাল আতাতুর্কের ন্যায় জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর কন্যা শেখ হাসিনাকেও কঠোর থেকে কঠোর হতে হবে। সংস্কৃতির মাধ্যমে প্রয়োজনীয় সংস্কার করতে হবে। ফিরিয়ে আনতে হবে সামাজিক মূল্যবোধ। লেখকঃ সিনিয়র সাংবাদিক, কলামিস্ট ও ইতিহাস গবেষক।