বহুল প্রতীক্ষিত ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের (উড়ালসড়ক) উদ্বোধন হলো। শনিবার (২ সেপ্টেম্বর) বিকেল সাড়ে তিনটার দিকে বিমানবন্দরের কাওলা প্রান্তে ফলক উন্মোচনের মাধ্যমে দেশের প্রথম এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের উদ্বোধন করেছেন।যানজটে গতিহীন রাজধানী ঢাকার সড়ক গতিময় করতে এ মেগাপ্রকল্প বাস্তবায়ন করলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জ্যেষ্ঠ কন্যা। ২০১১ সালের ১৯ জানুয়ারি প্রথম চুক্তি সইয়ের এক যুগ পরে নানা চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে আলোর মুখ দেখলো এ প্রকল্প। প্রধানমন্ত্রী ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের কাওলা প্রান্তে এসে বিকেল ৩টা ৩০ মিনিটে ফলক উন্মোচনের মাধ্যমে উড়ালসড়কটি উদ্বোধন করেন। এ সময় তার সঙ্গে ছিলেন ছোট বোন শেখ রেহানা, সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র আতিকুল ইসলাম।আজ দ্বার খুললেও এ সড়কে যান চলাচল শুরু হবে আগামীকাল রোববার (২ সেপ্টেম্বর) সকাল ছয়টা থেকে।
প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিমানবন্দরের কাওলা থেকে ১০ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে ফার্মগেট আসতে সময় লাগবে ১০ মিনিট। এক্সপ্রেসওয়েতে গাড়ির সর্বোচ্চ গতিসীমা থাকবে ঘণ্টায় ৬০ কিলোমিটার। সড়কটিতে পাড়ি দিতে সাধারণ যাত্রীদের আগে দেড় থেকে দুই ঘণ্টা সময় নষ্ট হতো। এখন থেকে সেটি আর হবে না।
জানা গেছে, উত্তরার কাওলা থেকে ফার্মগেট পর্যন্ত ১৫টি সংযোগ সড়ক থাকলেও দুটির কাজ শেষ না হওয়ায় তেরটি সংযোগ সড়ক দিয়ে যান চলাচল করবে।
যানজট নিরসনে এই একপ্রেসওয়েকে সহজ সমাধান হিসেবে দাবি করা হলেও পরিকল্পনাবিদরা বলছেন অন্য কথা। তাদের দাবি, এয়ারপোর্ট থেকে এ সড়ক দিয়ে দ্রুত আসা গেলেও ভূমি সড়কে গাড়িগুলো নামার পর যানজট হবে।
এক্সপ্রেসওয়ের ওপর দিয়ে থ্রি-হুইলার, মোটরসাইকেল বাইসাইকেল, পথচারীরা চলাচল করতে পারবে না। চার চাকা বা এর অধিক চাকার যান ছাড়া এ সড়কে অন্য কোনো যান চলাচল করতে পারবে না। কোথাও থেমে ছবিও তোলা যাবে না।
চার ক্যাটাগরিতে (শ্রেণি) টোল আদায় হবে এ উড়ালসড়ক থেকে। এর জন্য কয়েকটি ক্যাটাগরি করা হয়েছে। ক্যাটাগরি-১: কার, ট্যাক্সি, জিপ, স্পোর্টস ইউটিলিটি ভেহিক্যাল, মাইক্রোবাস (১৬ সিটের কম) ও হালকা ট্রাকের (৩ টনের কম) টোল ৮০ টাকা।
ক্যাটাগরি-২: মাঝারি ট্রাক (৬ চাকা পর্যন্ত) ৩২০ টাকা; ক্যাটাগরি-৩: ট্রাক (৬ চাকার বেশি) ৪০০ টাকা, ক্যাটাগরি-৪: সব ধরনের বাসের (১৬ সিট বা তার বেশি) টোল ১৬০ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে।
কোথায় কোন র্যাম্প
হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরের দক্ষিণে কাওলা থেকে ফার্মগেট পর্যন্ত অংশ যান চলাচলে জন্য প্রস্তুত হয়েছে এ প্রকল্পের। এ অংশের মেইন লাইনের দৈর্ঘ্য ১১ দশমিক ৫ কিলোমিটার ও র্যাম্পের দৈর্ঘ্য ১১ কিলোমিটার। র্যাম্পসহ মোট দৈর্ঘ্য ২২ দশমিক ৫ কিলোমিটার। এ অংশে ওঠা নামার জন্য মোট ১৫টি র্যাম্প থাকবে। এর মধ্যে এয়ারপোর্টে দুটি , কুড়িলে তিনটি, বনানীতে চারটি, মহাখালীতে তিনটি, বিজয় সরণিতে দুটি ও ফার্মগেটে একটি।
এর মধ্যে ১৩ টি র্যাম্প যান চলাচলের জন্য উন্মুক্ত করা হবে। উত্তর হতে দক্ষিণ অভিমুখী যানবাহন উঠবে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের দক্ষিণে কাওলা; প্রগতি সরণি ও বিমানবন্দর সড়কের আর্মি গলফ ক্লাব হতে। নামবে বনানী কামাল আতাতুর্ক অ্যাভিনিউ; মহাখালী বাস টার্মিনালের সামনে; ফার্মগেট প্রান্তে ইন্দিরা রোডের পাশে।
দক্ষিণ হতে উত্তর অভিমুখী যানবাহন উঠবে বিজয় সরণি ওভারপাসের উত্তর এবং দক্ষিণ লেন; বনানী রেল স্টেশনের সামনে থেকে। নামবে মহাখালী বাস টার্মিনালের সামনে; বনানী কামাল আতাতুর্ক অ্যাভিনিউয়ের সামনে বিমানবন্দর সড়ক, কুড়িল বিশ্বরোড ও বিমানবন্দর ৩য় টার্মিনালের সামনে। তবে মহাখলীতে একটি ওঠার র্যাম্প ও বনানীতে সড়ক ভবনের পাশের ওঠার র্যাম্প আপাতত বন্ধ থাকছে।
যে সুবিধা আনছে এ প্রকল্প
প্রকল্পটি নির্মাণের সুবিধার্থে তিনটি ভাগে ভাগ করা হয়েছে। একটি এয়ারপোর্ট-বনানী-রেলস্টেশন পর্যন্ত; অপরটি বনানী রেলস্টেশন-মগবাজার পর্যন্ত ও মগবাজার-চিটাগাং রোডের কুতুবখালী পর্যন্ত। উত্তরাঞ্চল থেকে আসা যানবাহনগুলো ঢাকাকে পাশ কাটিয়ে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে যেতে পদ্মা সেতুগামী বঙ্গবন্ধু এক্সপ্রেসওয়েতে সরাসরি উঠে যাবে। অন্যরুটে দিয়ে যাবে চট্টগ্রাম ও সিলেটে।
এক্সপ্রেসওয়ের ট্রাফিক পদ্ধতি সঠিক না হলে যানজট কমার চেয়ে বাড়বে বলে মন্তব্য করেছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের অধ্যাপক ড. আকতার মাহমুদ। তিনি বলেন, এই এক্সপ্রেসওয়ের উদ্দেশ্য ছিল শহরের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে গাড়িগুলো যানজট ছাড়া চলাচল করতে পারবে। এক্সপ্রেসওয়ের একটা চরিত্র আছে। যেখানে গাড়িগুলো বাধাহীনভাবে চলে যেতে পারবে। তবে এখানে দেখা গেছে অনেক জায়গায় র্যাম্প নামানো হয়েছে। এতে করে হয়ত বাণিজ্যিক সুবিধা বাড়বে। তবে শহরের মধ্যে যেসব জায়গায় র্যাম্প থাকবে সেখানে ট্রাফিক পদ্ধতি ঠিক না করা গেলে যানজট বাড়বে।
সরকারের মেগাপ্রকল্পর অসুবিধা নিয়ে নিজের মত প্রকাশ করে পরিবহন বিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. এম শামসুল হক বলেছেন, এখনকার বাস্তবতায় এই এক্সপ্রেসওয়ে দৃশ্যমান, টেকসই ও পিক আওয়ারে সমাধান দিতে পারবে না। এই এক্সপ্রেসয়ের বেশি সুবিধা পাবে ব্যক্তিগত যান। ২০১৩ সালে যখন এটি হওয়ার কথা ছিল তখনকার প্রেক্ষাপট এক রকম ছিল। আর এখন সেটা ভিন্ন রকম। ফার্মগেট অংশে যে যানবাহনগুলো নামবে তারা একটা সুবিধা পাবে। কারণ, এরপর মানিক মিয়া এভিনিউতে বড় একটা রাস্তা আছে বলেও উল্লেখ করেন বুয়েটের দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক এ পরিচালক।
এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের (উড়ালসড়ক) প্রকল্পের ৬৫ শতাংশের বেশি কাজ হয়েছে। যে অংশের উদ্বোধন হলো সেখানকার সব ধরনের কাজও শেষ হয়েছে। প্রকল্পের পরিচালক এ এইচ এম এস আকতার জানিয়েছেন, রোববার ভোর ৬টা থেকে এক্সপ্রেসওয়ে খুলে দেওয়া হবে।
তিনি বলেন, ঢাকা শহরের মধ্যে দিয়ে এমন প্রকল্প বাস্তবায়নে বিভিন্ন ধরণের সমস্যা থাকে। বাকি অংশের কাজ চলমান। সমস্যাগুলোও কেটে যাবে।
প্রসঙ্গত, ২০১১ সালের ১৯ জানুয়ারি চুক্তি সই হওয়া প্রকল্পের মেয়াদ ধরা হয়েছে ২০১১ সালের জুলাই থেকে ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত। পরবর্তীতে
প্রকল্পের বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান ফার্স্ট ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে কোম্পানি লিমিটেডের সঙ্গে বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষের ১৫ ডিসেম্বর ২০১৩ তারিখে সংশোধিত চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। প্রকল্পটি থাইল্যান্ডভিত্তিক প্রতিষ্ঠান ইটালিয়ান থাই ডেভেলপমেন্ট পাবলিক কোম্পানি লিমিটেড ৫১ শতাংশ ও চীনভিত্তিক প্রতিষ্ঠান শোনডং ইন্টারন্যাশনাল ইকোনোমিক গ্র্যান্ড টেকনিক্যাল কো-অপারেশন গ্রুপ ৩৪ শতাংশ ও সিনোহাইড্রো কর্পোরেশন লিমিটেড ১৫ শতাংশ যৌথ উদ্যোগে নির্মিত হচ্ছে। প্রকল্পের মূল দৈর্ঘ্য ১৯ দশমিক ৭৬ কিলোমিটার। র্যাম্পসহ মোট দৈর্ঘ্য ৪৬ দশমিক ৭৩ কিলোমিটার।
প্রকল্পের মোট ব্যয় ৮৯৪০ কোটি টাকা যার ২৭ শতাংশ বাংলাদেশ সরকার ভিজিএফ হিসেবে বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানকে প্রদান করবে। তবে ভূমি অধিগ্রহণ, নকশা বদল, অর্থ সংস্থানের জটিলতায় চারবার সময় বৃদ্ধির ফলে ব্যয় বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৩ হাজার ৮৫৮ কোটি টাকায়।