২০০৪ সালের ২১ আগস্ট। বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়। সেখানে চলছিল সন্ত্রাসবিরোধী শান্তি সমাবেশ। সমাবেশে প্রধান অতিথি ছিলেন বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। অস্থায়ী ট্রাকমঞ্চে দাঁড়িয়ে বক্তৃতা দিচ্ছিলেন তিনি। বক্তৃতা শেষ হতেই বিস্ফোরণ হতে থাকে একের পর এক গ্রেনেড। বিকট শব্দ।কিছু বুঝে ওঠার আগেই ১৩টি গ্রেনেড বিস্ফোরণে মুহূর্তেই বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউ পরিণত হয় মানুষের রক্ত-মাংসের স্তূপে। অতর্কিতে গ্রেনেড হামলায় মারা যান আওয়ামী লীগের মহিলাবিষয়ক সম্পাদক আইভি রহমানসহ ২৪ জন। আহত হন শেখ হাসিনাসহ পাঁচ শতাধিক নেতাকর্মী। সাংবাদিকরাও আহত হন।ঘটনার পরদিন অর্থাৎ ২২ আগস্ট মতিঝিল থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) ফারুক আহমেদ বাদী হয়ে মামলা করেন। ওই মামলা প্রথমে তদন্ত শুরু করে পুলিশ। অবশ্য এরমধ্যে আওয়ামী লীগ নেতা আব্দুল জলিল ও সাবের হোসেন চৌধুরী আরও দুটি মামলা করেছিলেন। পরে এসব মামলা বিশেষ ট্রাইব্যুনালে স্থানান্তর করা হয়।তৎকালীন বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার এ ঘটনার প্রথম থেকেই হামলাকে ভিন্ন খাতে নেওয়ার চেষ্টা করে বলে অভিযোগ ওঠে। সাজানো হয় ‘জজ মিয়া’ নাটক। ২০০৭ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় গ্রেনেড হামলা মামলার পুনঃতদন্ত শুরু হয়। এরপর বেরিয়ে আসতে থাকে অনেক তথ্য। তদন্ত শেষে সিআইডির এএসপি ফজলুল কবীর ২০০৮ সালের ১১ জুন দুটি মামলার অভিযোগপত্র জমা দেন। একটি হত্যা, অন্যটি বিস্ফোরকদ্রব্য আইনে।এতে বিএনপি নেতা আবদুস সালাম পিন্টু, তার ভাই মাওলানা তাজউদ্দিন ও হরকাতুল জিহাদ (হুজি) নেতা মুফতি হান্নানসহ ২২ জনকে আসামি করা হয়। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর রাষ্ট্রপক্ষের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে মামলাটি অধিকতর তদন্তের নির্দেশ দেন আদালত। ২০১১ সালের ৩ জুলাই তারেক রহমানসহ ৩০ জনকে আসামি করে সম্পূরক চার্জশিট দাখিল করা হয়। এ নিয়ে মামলায় মোট আসামির সংখ্যা হয় ৫২ জন।
মামলা থেকে বাদ দেওয়া হয় যে সব আসামি
আসামিদের মধ্যে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে করা মামলায় জামায়াতে ইসলামীর তৎকালীন সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদের ফাঁসি কার্যকর হয়। এছাড়া সিলেটে ব্রিটিশ হাইকমিশনার আনোয়ার চৌধুরী হত্যাচেষ্টার মামলায় হুজি নেতা আবদুল হান্নান ও শরীফ শাহেদুল ইসলাম বিপুলের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়। ফলে এ মামলা থেকে তাদের নাম বাদ পড়ে।
হাইকোর্টে ডেথ রেফারেন্স
গ্রেনেড হামলার দুই মামলার রায়সহ ৩৭ হাজার ৩৮৫ পৃষ্ঠার নথি হাইকোর্টের সংশ্লিষ্ট শাখায় আসে ২০১৮ সালের ২৭ নভেম্বর। পরে আসামিদের ডেথ রেফারেন্স ও আপিলের শুনানির জন্য মামলার পেপারবুক তৈরির নির্দেশ দেন হাইকোর্ট। সেই আদেশের ধারাবাহিকতায় পেপারবুক প্রস্তুত করা হয়।
মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ১৯ জন
বিচারিক আদালতের রায়ে ১৯ আসামিকে মৃত্যুদণ্ড ও এক লাখ টাকা করে অর্থদণ্ড দেওয়া হয়। তারা হলেন সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর, সাবেক উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টু, মেজর জেনারেল (অব.) রেজ্জাকুল হায়দার চৌধুরী, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আবদুর রহিম, হানিফ পরিবহনের মালিক মো. হানিফ, শীর্ষ জঙ্গি মাওলানা তাজউদ্দিন।মাওলানা শেখ আবদুস সালাম, মাওলানা শেখ ফরিদ, মাওলানা আবু সাইদ, মুফতি মঈনউদ্দিন শেখ ওরফে আবু জান্দাল, হাফেজ আবু তাহের, মো. ইউসুফ ভাট ওরফে মাজেদ ভাট, আবদুল মালেক, মফিজুর রহমান ওরফে মহিবুল্লাহ, আবুল কালাম আজাদ ওরফে বুলবুল, মো. জাহাঙ্গীর আলম, হোসাইন আহমেদ তামিম, রফিকুল ইসলাম ওরফে সবুজ ও মো. উজ্জ্বল ওরফে রতন। এরমধ্যে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আবদুর রহিম কারাবন্দী অবস্থায় মারা যান।
যাবজ্জীবন দণ্ডপ্রাপ্ত ১৯ জন
বিচারিক আদালতের রায়ে ১৯ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড ও ৫০ হাজার টাকা করে অর্থদণ্ড দেওয়া হয়। তারা হলেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান, বিএনপি নেতা হারিছ চৌধুরী, কাজী শাহ মোফাজ্জল হোসেন কায়কোবাদ, আরিফুল ইসলাম আরিফ, শীর্ষ জঙ্গি মুফতি আবদুর রউফ, হাফেজ ইয়াহিয়া, মুফতি শফিকুর রহমান, মুফতি আবদুল হাই, মাওলানা আবদুল হান্নান ওরফে সাব্বির, মুরসালিন, মুত্তাকিন, জাহাঙ্গীর বদর, আরিফ হাসান ওরফে সুমন ওরফে আবদুর রাজ্জাক, আবু বকর সিদ্দিক ওরফে হাফেজ সেলিম হাওলাদার, মো. ইকবাল, রাতুল আহমেদ, মাওলানা লিটন, মো. খলিল ও শাহাদত উল্লাহ ওরফে জুয়েল।
সাজাপ্রাপ্ত আরও ১১ জন
দুটি মামলায় বিভিন্ন মেয়াদে দণ্ডিত ১১ জন হলেন মেজর জেনারেল (অব.) এ টি এম আমীন, লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব) সাইফুল ইসলাম জোয়ারদার, লেফটেন্যান্ট কমান্ডার (অব) সাইফুল ইসলাম ওরফে ডিউক, সাবেক আইজিপি আশরাফুল হুদা, সাবেক আইজিপি শহীদুল হক, সাবেক ডিআইজি খান সাঈদ হাসান, ডিএমপির সাবেক ডিসি (পূর্ব) ওবায়দুর রহমান খান, সাবেক আইজিপি খোদা বক্স চৌধুরী, জোট সরকার আমলের তদন্ত কর্মকর্তা সাবেক এএসপি আবদুর রশিদ, সাবেক এএসপি মুন্সী আতিকুর রহমান ও সাবেক পুলিশ সুপার রুহুল আমীন।
দণ্ডপ্রাপ্তরা কে কোথায়
দণ্ডিত আসামির মধ্যে তারেক রহমান, হারিছ চৌধুরীসহ ১৮ জনকে মামলার নথিতে পলাতক দেখানো হয়েছে। এরমধ্যে তারেক রহমান ২০০৮ সাল থেকে লন্ডনে আছেন। হারিছ চৌধুরী ২০০৭ সালে এক-এগারোর পটপরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে সিলেট সীমান্ত দিয়ে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান। বর্তমানে তার অবস্থান সম্পর্কে কোনো তথ্য নেই। মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি তাজউদ্দিন বর্তমানে দক্ষিণ আফ্রিকায় আছেন বলে জানা গেছে।
হানিফ পরিবহনের মালিক মো. হানিফ, মেজর জেনারেল (অব.) এ টি এম আমিন ও লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব.) সাইফুল ইসলাম জোয়ারদার ও কায়কোবাদ বিদেশে আছেন। তাদের বর্তমান অবস্থান সম্পর্কে কিছু জানা যায়নি। গ্রেনেড হামলায় সরাসরি অংশ নেওয়া দুই জঙ্গি মুরসালিন ও মুত্তাকিন অস্ত্রসহ ধরা পড়ার পর ভারতের কারাগারে আছেন বলে জানা গেছে।