মানবতাবিরোধী অপরাধে আমৃত্যু কারাদণ্ডপ্রাপ্ত দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর মরদেহ নিয়ে রাতভর জামায়াত-শিবিরের তাণ্ডব চালিয়েছে বলে জানিয়েছেন ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি) কমিশনার খন্দকার গোলাম ফারুক। মঙ্গলবার (১৫ আগস্ট) সকালে ডিএমপি মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি এ কথা জানান।খন্দকার গোলাম ফারুক বলেন, আমৃত্যু কারাদণ্ডপ্রাপ্ত দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী সোমবার (১৪ আগস্ট) রাত ৮টা ৪০ মিনিটে মারা যান। তার মরদেহ নিয়ে জামায়াত-শিবির গতকাল তাণ্ডব চালিয়েছে। পুলিশের ওপর আক্রমণ করে, গাড়ি ভাঙচুর করে বেশ কয়েকজন সিনিয়র পুলিশ কর্মকর্তাদের ওপর হামলা করেছে।
ফজরের নামাজের পর তারা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ) দখল করে নিলো। ফেসবুকে লাইভে সবাইকে এখানে চলে আসার কথা বললো। পরে বাধ্য হয়ে সীমিত শক্তি প্রয়োগ করা হয় আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি রক্ষা করার জন্য।
রাতের হামলা ও ভাঙচুরের বিষয়টি বিবেচনা করে বুধবার (১৬ আগস্ট) ঢাকায় সাঈদীর গায়েবানা জানাজার অনুমতি দেওয়া হবে না বলেও জানান ডিএমপি কমিশনার খন্দকার গোলাম ফারুক।
ঘটনার বিবরণে তিনি বলেন, বিএসএমএমইউয়ে গতকাল রাত ৮টা ৪০ মিনিটে মানবতাবিরোধী অপরাধে আমৃত্যু কারাদণ্ডপ্রাপ্ত দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী হার্ট অ্যাটাক জনতি কারণে মারা যান। রাতে তার মরদেহ হস্তান্তরকে কেন্দ্র করে জামায়াত-শিবির ও তার স্বজনরা নাটক করেছে এবং তাণ্ডব চালিয়েছে।
তিনি মারা যাওয়ার পর হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বিষয়টি তার দুই ছেলেকে জানায়। পরে তার দুই ছেলে মরদেহ পিরোজপুর নেওয়ার জন্য কারাগার কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলেন।
এর মধ্যে জেল কর্তৃপক্ষ মরদেহের ময়নাতদন্ত করার প্রস্তুতি সম্পন্ন করে। সেই অনুসারে ম্যাজিস্ট্রেট নিয়ে আসা হয়। ম্যাজিস্ট্রেট এসে মরদেহের সুরতহাল সম্পূর্ণ করেন। যখন ময়নাতদন্তের জন্য মরদেহ ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হবে সেই মুহূর্তে তার ছেলেরা জোর দাবি জানান, তারা ময়নাতদন্ত ছাড়া মরদেহ নিয়ে যেতে চায়।
এ বিষয়ে জেল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে তাদের অনেক সময়ক্ষেপণ হয়। পরে সোমবার রাত ১টার দিকে তারা জেল কর্তৃপক্ষের অনুমোদন পায়।
ডিএমপি কমিশনার বলেন, এর পর মরদেহের গোসল শেষে পরিবার প্রস্তুতি নেয় মরদেহ পিরোজপুর নিয়ে যাওয়ার। তখন বিএসএমএমইউ ও শাহবাগে আগে থেকেই অবস্থান নেওয়া কয়েক হাজার জামায়াত-শিবিরকর্মী দাবি তুলে জানাজা পড়ে মরদেহ নিতে চাই। তখন আমরা তাদের বলি আপনারা এখানে জানাজা পড়তে পারেন। আমরা তাদের আরও বলি মঙ্গলবার জাতীয় শোক দিবস, আমাদের ব্যস্ততা আছে, আপনারা এখন জানাজা পড়ে মরদেহ নিয়ে যেতে পারেন। রাত সোয়া ২টার দিকে তারা জানাজার পরিবর্তে মোনাজাত করে আধা ঘণ্টা। তারা বলে আমরা জানাজা পড়ব না মোনাজাত করেছি, পরে আমরা গায়েবানা জানাজা পড়বো। এ ধরনের সিদ্ধান্ত নিয়ে তারা মোনাজাত করে। কিন্তু যখন মরদেহ গাড়িতে করে নিয়ে যাওয়া শুরু হয়, তখন হাজার হাজার জামায়াত-শিবিরকর্মী লাশবাহী গাড়ির সামনে শুয়ে পড়ে। তারা কোনো মতে এ মরদেহ পিরোজপুরে নিয়ে যেতে দিবে না। এ সময় লাশবাহী গাড়ির সঙ্গে থাকা পুলিশ অফিসার ও পুলিশ সদস্যদের ওপর হামলা করে জামায়াত-শিবিরকর্মীরা। একইসঙ্গে তারা গাড়ি ভাংচুরও শুরু করে। এ হামলায় রমনার ডিসিসহ বেশ কয়েকজন সিনিয়র অফিসার আহত হন। তারা পুলিশের চার থেকে ৫টি গাড়ি ভাঙচুর করে এবং দুটি মোটরসাইকেল আগুন ধরিয়ে দেয়। আমরা ধৈর্যসহকারে এ তাণ্ডব সহ্য করি যে, তারা মরদেহ নিয়ে যেতে চাচ্ছে নিয়ে যাক। তারপরেও আমরা কোনো শক্তি প্রয়োগ করেনি।
ডিএমপি কমিশনার আরও বলেন, ফজরের নামাজের পরে তাদের আবারও অনুমতি দেওয়া হলো জানাজা পড়ার। কিন্তু ফজরের নামাজের পরে তারা আমাদের অফিসারদের বের করে বিএসএমএমইউ দখলে নিয়ে নিলো। তারা মরদেহ পিরোজপুর নিতে দিবে না।
এর মধ্যে তারা ফেসবুকে প্রচার করতে শুরু করলো সারা দেশ থেকে জামায়াত-শিবিরের নেতাকর্মী ও সমর্থকদের শাহবাগে আসার জন্য। তখন আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি অবনতি হওয়ার আশঙ্কায় তাদের ওপরে আমরা অত্যন্ত সীমিত আকারে শক্তি প্রয়োগ করি।
আমরা টিয়ারসেল নিক্ষেপ করে বিএসএমএমইউ মুক্ত করে সাঈদীর মরদেহ পিরোজপুরে পাঠানোর ব্যবস্থা করি। এইটা সীমিত শক্তি প্রয়োগ করে করা হয়েছে, কারণ হাসপাতালে রোগীদের স্বাস্থ্যের বিষয় বিবেচনা করে প্রথম থেকে শক্তি প্রয়োগে আমরা বিরত ছিলাম কিন্তু তাদের তাণ্ডবে বাধ্য হয়ে আমরা সীমিত শক্তি প্রয়োগ করি। ইতোমধ্যে পিরোজপুর মরদেহ চলে গেছে, দাফন সম্পন্ন করার প্রক্রিয়া চলমান আছে।
পরিস্থিতি যে এমন ভয়াবহ হবে পুলিশ তা আগে কেন জানিতে পারেনি, এটা গোয়েন্দা ব্যর্থতা কিনা জানতে চাইলে ডিএমপি কমিশনার বলেন, আমরা গোয়েন্দা তথ্য পেয়েছিলাম জামায়াত-শিবিরের নেতাকর্মীরা জড়ো হচ্ছেন। সাঈদীর দুই ছেলে প্রথম থেকে আমাদের আশ্বস্ত করেছিলেন আমাদের বাবার মরদেহ আমরা নিয়ে যাবো কোনো ধরনের সমস্যা হবে না আমরা যেভাবে বলবো এখানে সেভাবেই হবে। আমরা তাদের ওপর বিশ্বাস করে প্রথম থেকে কোনো প্রকার শক্তি প্রয়োগ করি নাই। যেহেতু তারা তাদের নেতার মরদেহ নিয়ে যাওয়ার জন্য কেউবা মৃত্যুর সংবাদ শুনে আবার অনেকে মরদেহ দেখার জন্য এসেছেন তাই মানবিক কারণে আমরা প্রথম থেকে কোনো ধরনের অ্যাকশন নেইনি। কিন্তু জামায়াত-শিবির যে তাদের চরিত্রটা পাল্টায়নি, এটা তারা আবারও প্রমাণ করলো। বিগত ২০১২-২০১৩ সালে তারা যেভাবে পুলিশকে জীবন্ত পুড়িয়ে মারা, হেলমেট দিয়ে পিটিয়ে পুলিশের মাথা থেতলিয়ে দেওয়ার মতো চরিত্রের বহিঃপ্রকাশ তারা আবারও করলো।
এর আগে গুজব ছড়ানো হয়েছে সাঈদীকে চাঁদে দেখা গেছে। তেমনি আগামীকালের ভূমিকম্প নিয়ে সারা দেশে গুজব ছড়ানো হয়েছে এ বিষয়ে এক প্রশ্নের জবাবে ডিএমপি কমিশনার বলেন, আমাদের সাইবার ইউনিট সক্রিয় আছে। তারা যে বিভিন্ন গুজব ছড়াচ্ছিল সেই তথ্য আমরা প্রতিনিয়ত পাচ্ছিলাম। এছাড়া সারা দেশ থেকে নেতাকর্মীদের জোর হওয়ার বিষয়ে যেসব প্রচারণা ফেসবুকে ছড়িয়েছিল সেসব তথ্যও আমরা পাচ্ছিলাম। সেই প্রেক্ষাপটে ভোরে আমাদের হালকা শক্তি প্রয়োগ করে তাদের ছাত্র ভঙ্গ করতে হয়েছে।
কারণ সাইবার ওয়ার্ল্ডে তারা যেভাবে তৎপর ছিল আমাদের কাছে গোয়েন্দা তথ্য আসে যে তারা সারা দেশ থেকে নেতাকর্মীদের জড়ো করে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটাতে পারে।আগামীকাল জামায়াত-শিবির গায়েবানা জানাজা করবে বলে ঘোষণা দিয়েছে। এ গায়েবানা জানাজাকে কেন্দ্র করে ডিএমপির কোনো প্রস্তুতি আছে কিনা জানতে চাইলে ডিএমপি কমিশনার আরও বলেন, তারা গতকাল রাতে যে তাণ্ডব চালিয়েছে, তারপরে আগামীকাল গায়েবানা জানাজার করতে দেওয়ার অনুমতি দেওয়া হবে না। আমরা এ অনুমতি তাদের দেবো না।