ঢাকা, বৃহস্পতিবার ২১ই নভেম্বর ২০২৪ , বাংলা - 

সেকালের গণিকালয়, একালের পাপিয়ালয়!

সোহেল সানি

2021-02-25, 12.00 AM
সেকালের গণিকালয়, একালের পাপিয়ালয়!

এককালে পরিবার নিয়ে বিদেশ গমনের প্রথা প্রচলিত ছিল না। পরস্ত্রীগমন নিন্দিত থাকাতে, প্রায় সকল আমলা, উকিল- মোক্তারের এক একটি উপপত্নী অত্যাবশকীয় ছিল। সুতরাং তাঁদের বাসস্থানের সন্নিহিত স্থানে   সংস্থাপিত হতো গণিকালয়। গ্রীসদেশে প্রাচীণকালে যেমন বুদ্ধিজীবী পন্ডিতরা বেশ্যালয়ে একাট্টা হয়ে সদালাপী হয়ে উঠতেন, সেইরূপ প্রথা এ দেশেও প্রচলিত ছিলো।যাঁরা ইন্দ্রিয়াসক্ত নন, তাঁরাও পরস্পর আমোদে  গা ভাসাতে গণিকালয়ে যেতেন। সন্ধ্যা থেকে রাত প্রহর পর্যন্ত বেশ্যালয়ে লোক পূর্ণ থাকত। লোকে পূজার রাতে যেমন প্রতীমা দর্শন করে বেড়াতেন, বিজয়ার রাতেও তেমনি বেশ্যা দেখে বেড়াতেন।
এমন বিবরণ উদ্ধৃত করতেও লজ্জাবোধ হচ্ছে। কিন্তু লজ্জাবোধ করে প্রকৃত অবস্থার প্রতি চোখ  মুদিয়ে থাকলে কী হবে! তদনুরূপ অবস্থা তখন এ দেশের অনেক নগরেই বিরাজমান ছিল। যেমন, যশোহরে পদস্থ আমলা উকিলরা কোন নবাগত ভদ্রলোকের কাছে পরস্পরের পরিচয় পর্বে -"ইনি তাঁর রক্ষিতা স্ত্রীলোকের পাকাবাড়ি করে দিয়েছেন", এই বলে  জাহির করতেন।  পাকাবাড়ি করে দেয়া যেন একটা মানসম্ভ্রমের ব্যাপার ছিলো।
যশোর শুধু নয়, বঙ্গদেশের ভদ্রসন্তানেরাও প্রকাশ্যে দূষিত-চরিত্রের নারীদের সঙ্গে মিশতে লজ্জাবোধ করত না।
আর এখনকার চিত্রটা কি? হ্যাঁ এখন অপ্রকাশ্য রঙ্গভূমিতে কলকাতার ন্যায় ঢাকা নগরীর ভদ্রলোকেরা মদ্যপ অবস্থায় ওই শ্রেণির স্ত্রীলোকদের সান্নিধ্যে নৃত্যগীতে শামিল হচ্ছেন। তাঁরা সর্বাঙ্গে টাকা ছিটিয়ে উৎসাহ যুগিয়ে চলেন। পাপিয়ার মতো এমন স্ত্রীলোকও থাকে, নামে তারা বিবাহিতা, কিন্তু আসলে তারা বিগহির্ত উপায়ে অর্থোপার্জনে লিপ্ত যৌন কর্মী। তাদের সামাজিক অবস্থা প্রকাশ্যে উন্নত হওয়ায় অসংকোচে ভদ্রবেশীদের মাঝে অবাধ যাতায়াতও রয়েছে। তিনতারা বা  পাঁচতারা রেস্তোরাঁয়  মহোৎসবে নৃত্যগীত করে এবং ভদ্রকুলকামিনীদের অপেক্ষা অধিক সমাদরলাভ করে। ক্যাসিনো ও পাপিয়া কাহিনি প্রকাশের পর দেশবাসীর কাছেও যা পরিস্কার হয়ে গেছে।   পিতামাতা দেখছেন যে তাঁদের সহস্র সতর্কতা সত্ত্বেও সন্তানরা  কিশোর-কিশোরীদের দলে ভিড়ে যাচ্ছে এবং এমন অনেক বিষয় শিক্ষা নিচ্ছে যা তাঁদের জানা উচিত নয়। মায়ের অবিশ্রান্ত যত্ন ও বিরামহীন পরিশ্রমের গুণে এ অধঃপতন থেকে ক'জন সন্তানকে রক্ষা করা যাচ্ছে?
অতীতে অজ্ঞ অশিক্ষিতদের প্রবঞ্চনা করে পাপকর্মে লিপ্ত হতে বাধ্য করত। এখন শিক্ষিত তরুণ-তরুণীরা স্বপ্রনোদিত হয়েও পাপকর্মে লিপ্ত হচ্ছে।  মদ্যপায়ীরা গীতিবাদ্যের অনুরাগী হয়।
রাজাদের যুগের একটি বর্ণনা এমন যে, উৎসুক শ্রোতারা রাজাদের ন্যায় নিজেদেরও রাজা ভেবে সুগায়ক- সুগায়িকাদের গীতবাদ্য শুনেন। হঠাৎ একজনের মন কেড়ে নিল অল্পবয়স্কা কোনো বালিকা। একপ্রকার বালিকাটিকে সে কিনেই নিল। লোকটির প্রাসাদোপম বাড়িতে বালিকাটি নিয়মিত দাসী দলের মধ্যে পরিগণিতা হয়ে থাকলো। লোকটির মনোরঞ্জনে মাঝেমধ্যেই বালিকাটি নৃত্যগীত পরিবেশন করত। ক্রমে তার বয়স ১৪/১৫ বছর হয়ে গেলো। একদিন গৃহিণী বললেন," এ বালিকা এখন বয়ঃপ্রাপ্ত হতে চলেছে, তাকে সবার অলক্ষ্যে রাখা উচিত।" কিন্তু কর্ণপাত করলো না লোকটা। তৎপরে তাকে সুরাপান করিয়ে বন্ধুদের আড্ডায় আমোদ-প্রমোদে লিপ্ত হতে বাধ্য করলেন। একরাতে নিজের বাড়িতেই আসর বসালেন। অপূর্ব রূপসী ও অসাধারণ সুকন্ঠীর নৃত্যগীতে সবাই বিমোহিত হল। একজন বললো সে কেন নগ্ন নৃত্য করছে না। সুরাপানে তখন সবার মনপ্রাণ প্রফুল্ল। আদেশ অনুযায়ী সুন্দরী তরুণী একখানা কালাপেড়ে সূক্ষ্মধূতি পরে আসলো সবার সম্মুখে, যেন স্বর্গবিদ্যাধরী অবতীর্ণা হলেন। শ্রোতাদের ঢুলুঢুলু নয়নে এরূপ দৃষ্ট হলো। বিমোহিত হয়ে কেউ কেউ আপন আপন চরণ নিজ বশে রাখতে পারলেন না।  প্রথমাবধি এক রাষ্ট্রবিজ্ঞবর ভাবগম্ভীর ছিলেন। কিন্তু নিজেকে সামলাতে পারলেন না। নাচানোর ছলে নিজেই নাচতে লাগলেন। যে সমাজে সমাজপতি একটা দাসীশ্রেণীস্থ তরুণীদের সুরাপান করিয়ে তার সঙ্গে হাস্য পরিহাস করতে লজ্জাবোধ করেন না, যে  সমাজে শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তিদের নিজ বাড়িতেও নিমন্ত্রিত ভদ্রমন্ডলীর মধ্যে এরূপ আমোদপ্রমোদ চলতে পারে, সে সমাজে সাধারণের নীতির অবস্থাটা কিরূপ আশা করা যায়? আমরা তো সেই সমাজেরই উত্তরাধিকার।

লেখকঃ সিনিয়র সাংবাদিক ও কলামিস্ট।
5:24 AM

Sohel, আজ 5:24 AM -এ-এ পাঠিয়েছেন
ক্যান্টনমেন্টের বাড়ি দখলমুক্তকরণ উন্নয়নের পথে একটি মাইলফলক  

 সোহেল সানি

ব্যাপক উন্নয়ন সাধারণ মানুষের মাঝে শেখ হাসিনার জনপ্রিয়তা বাড়িয়েছে। তিনি একজন সুদক্ষ প্রধানমন্ত্রী হিসাবে বিদেশী রাষ্ট্রপ্রধানদের নজর কেড়েছেন। বাংলাদেশ উন্নয়নের রোল মডেল হিসেবে প্রশংসিত হচ্ছে। কিন্তু অভাবনীয় উন্নয়নের পরেও আওয়ামী লীগকে কেনো রাতের আঁধারে ভোট কাটার অভিযোগ মাথায় চাপাতে হচ্ছে? তাহলে কি  ২০০৯ সালে যে তুমুল জনপ্রিয়তা নিয়ে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসীন হয় - সেই জনপ্রিয়তায় ধস নেমেছে?
আওয়ামী লীগের নির্বাচনী কূটকৌশলে প্রতীয়মান হচ্ছে - যে নেতারা ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বরের অবাধ নিরপেক্ষ নির্বাচনে যে জনপ্রিয়তা নিয়ে বিজয়ী হন, সেই জনপ্রিয়তায় নিজেদের ব্যর্থতার কারণেই ধস নামে। কারো কারো দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, সন্ত্রাস, স্বেচ্ছাচারিতায় গোটা দলের ওপরই মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জনপ্রিয়তা আকাশচুম্বী হলেও কমে যাচ্ছে দলের প্রতি জনগণের আস্থা।
ক্ষমতার টানা তিন মেয়াদ! শেষ মেয়াদও অতিক্রমের পথে।  মন্ত্রী-এমপিদের জনপ্রিয়তা ধস নেমেছে এটা আঁচ করতে পেরেই হয়তবা প্রধানমন্ত্রীকে নির্বাচন কৌশলে কুটপন্থা অবলম্বন করতে হয়। নির্বাচন নিয়ে যে কালিমা গায়ে মাখতে হচ্ছে তা দলের নেতাদের জন্য।
দেশে শক্তিশালী বিরোধী দল থাকার ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন প্রধানমন্ত্রী। এটি আশার কথা। যাহোক
মানুষ গণতন্ত্রের অপেক্ষা উন্নয়নকেই বেশি প্রাধান্য দিচ্ছে। এ কারণে মানুষ বিরোধী দলের আন্দোলনে আগ্রহ দেখাচ্ছে না। শেখ হাসিনার জনপ্রিয়তার কল্যাণেই আওয়ামী লীগ সরকারে টিকে আছে। শেখ হাসিনা ছাত্রলীগ-যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগে শুদ্ধিঅভিযান চালিয়ে নতুন নেতৃত্ব নির্বাচন করেছেন।  কৃষকলীগ, শ্রমিক লীগেও নতুন নেতৃত্ব এসেছে। ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের উত্তর দক্ষিণের কমিটিও ঘোষিত হয়েছে। কিন্তু সাংগঠনিক কার্যক্রম চোখে পড়ছে না।  প্রাণঘাতী করোনাও এ ক্ষেত্রে বড় একটা কারণ। সব সাংগঠনিক কর্মকাণ্ডই মুখ থুবড়ে পড়ে আছে- এরকম অজুহাত দাঁড় করিয়ে পার পেয়ে যাচ্ছেন নেতাকর্মীরা। হোমওয়ার্ক কর্মসূচি দিয়েও মানুষের কাছে নেতারা পৌঁছে যেতে পারতেন। কিন্তু সে ধরনের কোন কর্মসূচি সংগঠনগুলোর নেই। বরং বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মীদের হত্যা ধর্ষণ ও চাঁদাবাজির মতো জঘন্য কর্মকাণ্ডে যুক্ত হওয়ায় আওয়ামী লীগের ওপর আঘাত হানছে। ইতিপূর্বে ছাত্রলীগের   ইতিহাস-ঐতিহ্যকে ম্লান করে দিচ্ছে কতগুলো ধর্ষণসহ অপ্রীতিকর ঘটনায়। বিভিন্নরকম বাধাবিপত্তির মুখেও শেখ হাসিনার ক্ষমতায় টিকে থাকার নেপথ্যে মূলত কাজ করছে  শেখ হাসিনার উন্নয়ন?
এটা ঠিক কিন্তু তারচেয়েও বড় ঠিক আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় টিকে আছে একটি বড় পদক্ষেপের জন্য।   সবচেয়ে সেই বড় পদক্ষেপটি হচ্ছে- সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার হাত থেকে ক্যান্টনমেন্টের বাড়িটি অবমুক্ত করা।
আমার মতে এই দখলমুক্তির মধ্য দিয়ে গণতন্ত্র নিরাপদ জীবনে ফিরে এসেছে। সত্যিকার অর্থে গণতন্ত্র মাঝেমধ্যে আহত হলেও অন্তত হত্যার শিকার হয়নি। আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ হাসিনার ও বিএনপি প্রধান বেগম খালেদা জিয়ার মধ্যে পার্থক্য যদি নিরূপণ করা হলে, তা কেমন করে করা যায়? এই পার্থক্যই বিএনপিকে বর্তমান অবস্থায় নিয়ে গেছে। আর আওয়ামী লীগ বার পার পেয়ে যাচ্ছে।
যেমন, বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে বিএনপি-জামাত যখন বাস,দোকানপাটে পেট্রোল বোমা মারায় লিপ্ত তখন শেখ হাসিনা বিশ্বের সর্ববৃহৎ বার্ণ হাসপাতালে প্রতিষ্ঠা করেন। খালেদা জিয়ার সরকারের আমলে দেশ যখন দুনীতিতে হ্যাট্রিক করে শেখ হাসিনার নাম তখন বিশ্বের সৎ প্রধানমন্ত্রীর তালিকার শীর্ষে উঠে আসে। খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন বিএনপি জামাত যখন কল্পনায়  মওলানা সাঈদীকে আকাশে দেখে, তখন শেখ হাসিনা মহাকাশে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট পাঠায়। খালেদা জিয়ার সরকার যখন বিদ্যুৎ এর খাম্বা তৈরি করে তখন শেখ হাসিনা পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন করেন।
বিএনপি জামাত সরকার যখন সারের দাবিতে বিদ্রোহ করা কৃষকের মিছিলে গুলি করে হত্যা করে, তখন শেখ হাসিনা সরকার বিনামূল্যে সার বিতরণ করে।
বিএনপি জামাত যখন বাংলা ভাই শায়খ আঃ রহমানের আবিষ্কার করে শেখ হাসিনা তখন দেশকে জঙ্গিমুক্ত করে।
খালেদ জিয়া সন্ত্রাসীদের মদদ দেন, শেখ হাসিনা তখন সাকিব মাশরাফিদের খোঁজেন। খালেদা জিয়া যখন বলেন পদ্মা সেতু সম্ভব নয়, শেখ হাসিনা তখন তা দৃশ্যমান করেন।
বিএনপি যখন যুদ্ধাপরাধীদের বাঁচাতে এক হয়, শেখ হাসিনার সরকার তখন একেক করে তাদের ফাঁসি কার্যকর করে।  
বিএনপি ঐক্য  ফ্রন্ট যখন চিৎকার করে জনগনকে বলে মাগো তোমার একটি ভোটে বেগম খালেদা জিয়ার মুক্তি হবে, শেখ হাসিনা তখন বলেন, মাগো তোমার একটি ভোটে বাংলাদেশের উন্নয়ন হবে (অবশ্য জনগণ এখন ভোট দিতেও আসে না)।
প্রকৃতপক্ষে গণতন্ত্র নয়, সাধারণ মানুষের কাছে বড় হয়ে দাঁড়িয়েছে আমূল বদলে যাওয়া দেশের চেহারাটা। কিন্তু এতো সরকারের এতো উন্নয়নের পরেও দল হিসাবে আওয়ামী লীগের জনপ্রিয়তা বাড়েনি বরং ক্রমে কমেছে। ২০০৯ সালের নির্বাচনে টু-থার্ট মেজরিটি পাওয়া সেই আওয়ামী লীগের এখন কী আছে? নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরাই ভোট দিতে যায় না। সর্বশেষ দুটি নির্বাচনের চিত্র বলে দেয় নির্বাচন নিয়ে জনগণেরও আর মাথা ব্যাথা নেই। কিন্তু গণতন্ত্রের জন্য, সুশাসনের জন্য এটা আশার কথা নয়। আওয়ামী লীগকেই সবার আগে তা ভাবতে হয়।
শেখ হাসিনার ওপর ভর করে সরকার চলছে। কিন্তু দলে রয়েছে সাংগঠনিক স্থবিরতা, কোন্দল, হানাহানি, দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি। সেনাবাহিনীর অভ্যন্তরে অসন্তোষ সৃষ্টি করে ফায়দা লোটার চেষ্টায় লিপ্ত রয়েছে আল জাজিরা টিভিসহ বিদেশি একটি চক্র।
এই পরিস্থিতি নিয়ে সর্বাগ্রে আওয়ামী লীগকে চিন্তা করতে হবে। জনমনে সৃষ্টি মিশ্র প্রতিক্রিয়া অর্থাৎ বিভ্রান্তি বিতর্ক দূর করতে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিতে হবে। কেননা অতীতে অবৈধ ও অসাংবিধানিকভাবে ক্ষমতা দখলকারীরা সেনাবাহিনীকেই ব্যবহার করেছে একরকম মিথ্যা প্রচার-প্রচারণা ছড়িয়ে। প্রধানমন্ত্রী সম্প্রতি দেশে শক্তিশালী বিরোধী দল থাকার ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন। নিশ্চয়ই এটি আশা কথা।

লেখকঃ সিনিয়র সাংবাদিক ও কলামিস্ট।