জাতীয় নির্বাচনের সময় এগিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে নির্বাচনকে কেন্দ্র করে আন্তর্জাতিক পর্যায় থেকে নানাবিধ কূটনৈতিক তৎপরতা বেড়ে চলেছে। এসব তৎপরতায় সরকারের মধ্যে এক ধরনের অস্বস্তি ও ক্ষোভ বাড়ছে।দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে গত বছর থেকেই আন্তর্জাতিক পর্যাযের কূটনৈতিক তৎপরতা শুরু হতে দেখা যায়। চলতি বছর এই তৎপরতা আরও জোরালো হয়ে উঠেছে এবং আগামী দিনগুলোতে আরও বাড়তে পারে বলেও সরকারের নীতিনির্ধারকরা মনে করছেন।কূটনৈতিক তৎপতায় যে ইস্যুগুলো উঠে আসছে, সেগুলোর মধ্যে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন এবং মানবাধিকার পরিস্থিতি প্রাধান্য পাচ্ছে। তবে সরকারের দিক থেকে বার বার বলা হচ্ছে, আগামী নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হবে এবং দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতির কোনো অবনতি হয়নি।
সম্প্রতি বাংলাদেশে নিযুক্ত বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূতদের নির্বাচন কেন্দ্রিক তৎপরতা দৃশ্যমান হয়ে উঠেছে। আবার বিভিন্ন দেশ থেকেও কূটনৈতিক প্রতিনিধিরা আসছেন। আগামী সপ্তাহে যুক্তরাষ্ট্রের দুজন গুরুত্বপূর্ণ ও উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তার আসার কথা রয়েছে। তাদের একজন বেসামরিক নিরাপত্তা, গণতন্ত্র এবং মানবাধিকার বিষয়ক আন্ডার সেক্রেটারি উজরা জেয়া। অন্য জন দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়া বিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লু। তিনি কিছু দিন আগেও বাংলাদেশে এসেছিলেন। আবার প্রায় একই সময় ইউরোপীয় ইউনিয়নেরও একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিনিধিদলেরও ঢাকায় আসার কথা রয়েছে। এসব প্রতিনিধিদলের সফর এবং সরকারের সঙ্গে আলোচনায় নির্বাচন ইস্যুই প্রধান্য পাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
এর আগে গত জুনে ইউরোপীয় পার্লামেন্টের ৬ জন সদস্য ইউরোপীয় ইউনিয়নের পররাষ্ট্র বিষয়ক প্রধানের কাছে চিঠি দিয়ে বাংলাদেশে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন নিশ্চিত করতে অবদান রাখার অনুরোধ করেন। এর পর পরই সরকারের মন্ত্রীরা এ ঘটনা এবং চিঠির বক্তব্যের নিন্দা জানান।জাতীয় সংসদে ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেটের ওপর সাধারণ আলোচনায় অংশ নিয়ে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য এবং কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক এই ঘটনার নিন্দা জানিয়ে বলেন, তারা এটা বলতে পারে না। আমাদের দেশের নিজস্ব আইন আছে, সংবিধান আছে; সেভাবেই আমাদের দেশে নির্বাচন হবে। এখানে মানবাধিকার লঙ্ঘন হচ্ছে বলা হয়, এসব অভিযোগের কোনো ভিত্তি নেই।
সরকার ও ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের একাধিক সূত্র জানায়, নির্বাচনকে ইস্যু করে এসব কূটনৈতিক তৎপরতা ও কূটনীতিকদের বিভিন্ন বক্তব্যে সরকারের নীতিনির্ধারকরা অনেকটাই ক্ষুব্ধ। নির্বাচনসহ দেশের নিজস্ব বিষয় নিয়ে এ ধরনের কূটনৈতিক তৎপরতা ও বক্তব্য অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ বলে তারা মনে করছেন। তবে ক্ষোভ থাকলেও কৌশলগত কারণে বিশেষ করে কূটনৈতিক সম্পর্ক ঠিক রাখতে এসব বিষয়কে সরাসরি এড়িয়েও চলতে পারছে না সরকার। যার ফলে সরকারের মধ্যে এক ধরনের অস্বস্তিও রয়েছে।
আবার নির্বাচন ইস্যুর পাশাপাশি মানবাধিকার বিষয়ও কূটনৈতিক তৎপরতায় উঠে আসছে। তবে নির্বাচনকে সামনে রেখে উদ্দেশ্যমূলকভাবেই বিষয়টি সামনে নিয়ে আসা হচ্ছে বলে সরকারের নীতিনির্ধারকরা মনে করছেন। তাদের মতে, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বাংলাদেশের বর্তমান সরকারের নীতি, কৌশল এবং অবস্থানকে কোনো কোনো দেশ ভালো চোখে দেখছে না। এ কারণেই আন্তর্জাতিক পর্যায় থেকে কোনো কোনো দেশ আগামী নির্বাচন সংক্রান্ত বিষয়গুলোকে ইস্যু করার চেষ্টা করছে, বিভিন্ন বিষয়ে প্রশ্ন তোলা হচ্ছে। তবে সরকার এ বিষয়গুলোকে স্বাভাবিকভাবে নিচ্ছে না। ফলে কখনও কখনও সরকারের নীতিনির্ধারকরা ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করছেন বলেও ওই সূত্রগুলো জানায়।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে সরকারের এক মন্ত্রী বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তো তার বক্তব্যে সরকারের অবস্থান তুলে ধরেছেন। যারা আমাদের দেশের নির্বাচন, মানবাধিকার নিয়ে কথা বলছেন প্রধানমন্ত্রী তাদের নিজের দেশের চিন্তা আগে করতে বলেছেন। এর পরে তো আর কিছু বলার থাকে না।
গত ৬ জুলাই জাতীয় সংসদের ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেট অধিবেশনের সমাপনী বক্তব্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, রোহিঙ্গারা তাদের দেশে যখন অত্যাচার-নির্যাতিত হচ্ছিল, গণহত্যার শিকার হচ্ছিল; আমরা তাদের আশ্রয় দেই, প্রথম যখন আশ্রয় দেই তখন কে ছিল? ...আমরা মানবিক কারণে যখন এতগুলি লোকের দায়িত্ব নিতে পারি, এর থেকে মানবাধিকার সংরক্ষণ আর কী হতে পারে, সেটাই আমার প্রশ্ন। ...অন্য দেশের নির্যাতিত মানুষকে আশ্রয় দেওয়া আওয়ামী লীগ সরকার মানবাধিকার লঙ্ঘন করবে কেন? কীভাবে করবে, এ কথা বলে কীভাবে?
প্রধানমন্ত্রী আরও বলেছিলেন, সারা বিশ্বে তো বহু জায়গায় বহু মানুষ খুন হচ্ছে। আমেরিকায় তো স্কুলে গিয়ে প্রতিদিন গুলি করে শিশুদের হত্যা করছে, শপিংমলে হত্যা হচ্ছে, রাস্তায় হত্যা হচ্ছে...। ...তাদের নিজের দেশের মানুষের মানবাধিকার আগে রক্ষা করা উচিত। তারা নিজের দেশের মানুষকে বাঁচাবে কী করে, সেই চিন্তা আগে করুক, সেটাই তাদের করা উচিত, যার যার দেশের।